নদীপাড়ের মানুষ (পর্ব-১)

বন্ধ উত্তরাঞ্চলের অনেক নৌরুট, বিপাকে কৃষক

প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে
 | প্রকাশিত : ১৪ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:০৩

‘আমাদের ছোট নদী চালে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে/পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি/দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পারি।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিশ্চয়ই যমুনার নদীর কথা বলেননি তার বিখ্যাত এই কবিতার পঙতিগুলোতে। এক সময়ের যৌবনা যমুনার দশা এখন রবি ঠাকুরের সেই কবিতার মতোই।

যমুনা সেতু তৈরি ও নদীশাসন করে পশ্চিমপাড়ে বাঁধ, গ্রয়েন, হার্ডপয়েন্ট নির্মাণের ফলে চরম নাব্য সংকটে যমুনা। ১৯৯৮ সালের পর থেকে যমুনা সেতুর উজানে নদী ভড়াট হয়ে চর জাগতে শুরু করে। এখন যমুনা সেতুর উজানে সিরাজগঞ্জ থেকে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত ২৩০ কিলোমিটার নদীতে ছোট বড় চরের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। নতুন আরও এক হাজার চর জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে।

যমুনার মূল উৎপত্তি পাশের দেশ ভারতে। উৎপত্তিস্থল থেকে যখন পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন এর গতি থাকে অনেক। পানির গতির কারণে ভারতের অংশের মাটি বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন টন আমাদের নদীতে পড়ে। এর ফলে ক্রমান্বয়ে নদী ভরাট হতে থাকে। নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে অল্প পানিতেই বন্যার সৃষ্টি হয়।

একসময়ের প্রমত্তা যমুনা নদী এখন নাব্য হারিয়ে বিভিন্ন রুটে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। যমুনার বুকে এখন ধূ ধূ বালু চর। মাইলের পর মাইল হেঁটে চরে বসবাসরত মানুষকে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতে হচ্ছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি হতে জামালপুরের মাদারগঞ্জ সদরের সাথে যোগাযোগে কোনোমতে যাত্রীবোঝাই নৌকা চলছে। এতে চলাচলে চরম দুর্ভোগ ছাড়াও বিভিন্ন নৌপথে মালামাল বহন বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে চরে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বিপনন নিয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে চরের কৃষকরা। চরে এখন নিয়মিত চাষ হচ্ছে মরিচ, আলু, বাদাম, গোম, ভুট্টাসহ প্রায় সব রকমের ফসল।

বগুড়ার সারিয়াকান্দির উপর দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদী এক সময় গভীর ছিল। বছরজুড়ে নদীপথে বড় বড় পাল তোলা নৌকা ছাড়াও জাহাজ চলাচল করত। এখন সেই যমুনার গভীরতা হারিয়ে গেছে। ফলে একদিকে যেমন বর্ষা মৌসুমে অল্প পানিতেই নদীর কুল উপচে পড়ে বন্যার পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। আবার সেই সাথে প্রবল স্রোতে নদী ভাঙনে ব্যাপক বিস্ত্রীর্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় বহু মানুষ হয়ে পড়ে গৃহহীন। নদীপথ চালু রাখতে ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে সে নদীর গভীরতা হারিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, এককালে যমুনা নদীর গভীরতা থাকায় বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরের সাথে জাহাজ, কার্গো ও পাল তোলা বড়বড় নৌকা দেশের উত্তরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত। একারণে পণ্য পরিবহনে খরচ কম হতো। এবং উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য সহজে ও অল্প খরচে দেশের শিল্প এলাকায় পৌঁছাতে সক্ষম হওয়ায় কৃষকেরা পণ্যের নায্যমূল্য পেতেন। এখন পলি আর বালিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়েছে। দেখা দিয়েছে অসংখ্য ছোট বড় বালুর চর।

এসব বালুচরের কারণে বর্ষা মৌসুমেও নৌকা চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এছাড়াও উজান থেকে নেমে আসা সামান্য ঢলের পানিতেই নদী পরিপূর্ণ হয়ে নদীতে অকাল বন্যা দেখা দেয়। বন্যার পর পরেই নদীতে নতুন নতুন চর জেগে উঠায় নৌকা আর চলে না। ফলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য সহজে বাজারজাত করা যায় না। আবার বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজনে হাট-বাজার, অফিস আদালত, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজে সময়মত আসা তাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছে। চরাঞ্চলের মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। নদী নাব্য হারিয়ে যাওয়ায় চরে তাদের বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। নদীতে না চলছে নৌকা আবার ধূ ধূ বালুতে না চলছে কোনো যানবাহন। মাইলের পর মাইল তপ্ত বালুতে না যাচ্ছে হেঁটে পথ চলা।

সারিয়াকান্দি সদরের সাথে চরাঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য যুগযুগ ধরে এই এলাকার কালিতলা ঘাটে নৌঘাট থাকলেও যমুনা নদী বালুতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় পণ্যবাহী কোনো নৌকা সেখানে ভিড়ছে না। স্বপ্ল পরিসরে নৌকা চলাচল করলেও খাল পাড় হয়ে আসতে যাত্রীদের নৌকা থেকে নেমে ঠেলে পাড় করতে হয়। তাও আবার ঘাটে পৌঁছুতে সময় লাগছে তিন চার গুণ। ডুবোচরের ভয়ে সন্ধ্যার পরপরেই নৌচলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

অন্যদিকে ইউরিয়া সার ও অন্যান্য মালামাল বোঝাই নৌকা কালিতলা ঘাটে ভিড়ছে না। তবে এসব পণ্যবাহী নৌকা সদর থেকে পাঁচ ছয কিলোমিটার ভাটিতে মথুরাপাড়া ঘাটে ভিড়ছে। এতে সময় ও খরচ পড়ছে বেশি।

পাকুরিয়া চরের মাসুদ হাসান, সাবজল হোসেন, আব্দুল মান্নান, আফজাল হোসেন, রহমত আলী ঢাকাটাইমসকে জানান, আগে এ যমুনা নদীর পথে নিয়মিত দেশের বিভিন্ন বন্দর থেকে তেল সারসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে জাহাজ চলাচল করায় এটা জাহাজ গড়ান নদী হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত রয়েছে। নদীর গভীরতা হারিয়ে যাওয়ায় গত বছরের বন্যার পর থেকে আর কোনো জাহাজ কার্গো উত্তর দিকে যাতায়াত করছে না। এখন নদীর এমন অবস্থা জাহাজ তো দূরের কথা পণ্য বোঝাই নৌকা নিয়ে হাটে ঘাটে যাওয়াই কঠিন।

কাজলা ইউনিয়নের চকরথিনাথ চরের সাহের আলী, বেণীপুর চরের আব্দুস সালাম, নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পায়ে হেঁটে বালু পথ পাড়ি দেয়া দুরূহ হয়ে পড়েছে। সারিয়াকান্দি সদরে আসতে আগে সকালে বাড়ি হতে বের হয়ে আবার দুপুরের মধ্যেই বাড়ি ফেরা যেত। আর এখন সকালে বাড়ি হতে বের হয়ে রাতের আগে বাড়ি ফেরা যায় না। একারণে আমরা সাত আট মাস ধরে সারিয়াকান্দি হাটে আসা যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।

নয়াপাড়া চরের সেকেন্দার আলী ঢাকাটাইমসকে জানান, বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়ায় আগে বাড়ি থেকেই স্কুলে লেখাপড়া করত। কিন্তু এখন অনেক পথ হেঁটে চর পাড়ি দিয়ে স্কুলে পৌঁছা কঠিন হয়ে পড়ায় ছাত্রছাত্রীদের অন্যের বাড়িতে রেখে পড়া শিখাতে হচ্ছে।

বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেকশন অফিসার ময়েজ উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে জানান, যমুনা নদী ড্রেজিং করার জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। তবে বাঙালি নদী ড্রেজিংয়ের জন্য একটি আদেশ ইতোমধ্যেই তাদের দপ্তরে এসেছে। বগুড়ার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদীর ২৩ পয়েন্টে ২০ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ের জন্য ফাইল প্রস্তুত হচ্ছে।

(ঢাকাটাইমস/১৪নভেম্বর/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :