অবসরপ্রাপ্ত বিচারক আইনের ঊর্ধ্বে নন: হাইকোর্ট

প্রকাশ | ১৪ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:৪২ | আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৭, ১৯:২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনুসন্ধান বন্ধে দুদকে দেয়া চিঠিটি সুপ্রিম কোর্টের নয় বলে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। এটি আপিল বিভাগের প্রশাসনিক চিঠি বলে মন্তব্য করেছে উচ্চ আদালত। এই চিঠি দেয়ায় সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা খর্ব হয়েছে এবং অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারক আইনের ঊর্ধ্বে নন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় দেন। রায়ে সাতটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে রুল নিষ্পত্তি করে দিয়েছে আদালত।

এ রায়ের ফলে সুপ্রিম কোর্টের ওই চিঠি অবৈধ এবং বিচারপতি জয়নুলের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। 

রায়ে আদালত বলেছে, ‘এটা আপিল বিভাগের প্রশাসনিক চিঠি। সুপ্রিম কোর্টের মতামত নয়। এই চিঠিতে জনমনে সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদার খর্ব করেছে। আদালত দুদকসহ অন্যান্য তদন্ত সংস্থাকে সর্তক করে দিয়ে বলেছে, কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত করার সময় যেন সর্তক থাকে। কারণ এর সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের তথা বিচার বিভাগের মর্যাদা জড়িত। রাষ্ট্রপতি ছাড়া আর কেউ দায়মুক্তি পেতে পারেন না। সুপ্রিম কোর্টের এই চিঠি জনগণের মাঝে এই বার্তা দিয়েছে যে, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির ফৌজদারি কর্মকাণ্ডে দায়মুক্তি পেতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রাষ্ট্রপতি ছাড়া কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন।

আদালতে দুদকের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। এছাড়া বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন। পাশাপাশি এ মামলার অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন।

রায় ঘোষণার পর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, সাতটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে রুল নিষ্পত্তি করে দিয়েছে আদালত। আদালত বলেছে, এই চিঠিকে কোনোক্রমে সুপ্রিম কোর্টের চিঠি বলা যাবে না। এটা আপিল বিভাগের একটি অফিসিয়াল চিঠি। এ রায়ে প্রমাণিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের ওই চিঠি অবৈধ। এই চিঠির আইনগত ভিত্তি নেই। এই চিঠি দেয়া ঠিক হয়নি।

রায়ের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এ চিঠি দিয়ে জনমনে একটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। মনে হবে বিচারকরা আইনের ঊর্ধ্বে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন, একমাত্র রাষ্ট্রপতি ছাড়া। প্রেসিডেন্ট উনার কার্যমেয়াদে কাজটা করবেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আইনের ঊর্ধ্বে নন। কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির গন্ধ পেলে দুদক সেটা অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারবে।

বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে রায়ে কী বলা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালত বলেছে দুদক সাত বছর ধরে অনুসন্ধান করছে, এ ব্যাপারে কোর্ট অসন্তুষ্ট। একটা অনুসন্ধান করতে কেন সাত বছর লাগবে? যখন একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করবে তখন তার ডিগনিটি ও প্রেস্ট্রিজসহ সুপ্রিম কোর্টের প্রেস্ট্রিজ সম্পর্কে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা অথবা দুদককে খেয়াল রাখতে হবে যাতে জনমনে বিভ্রান্তি না ঘটে এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি যেন হয়রানির শিকার না হন।

রায়ের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘রায়ে এটা বুঝলাম, চিঠিটা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি হতে পারে। এ চিঠি দেয়া ঠিক হয়নি। এটাকে কোনোক্রমেই সুপ্রিম কোর্টের চিঠি বলা যাবে না। আমরা বলতে পারি ওই চিঠি অবৈধ।’

আদালতের দেয়া সাতটি পর্যবেক্ষণ

আপিল বিভাগের প্রশাসনিক ক্ষমতায় আলোচিত চিঠি দেওয়া যথাযথ হয়েছে কি না, সে বিষয়ে জারি করা রুলের বিচার চলতে পারে।

(২) এ চিঠি দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিছু অপ্রাসঙ্গিক ও নিজ এখতিয়ার বহির্ভূত যুক্তি গ্রহণ করেছে, যা কর্তৃপক্ষকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

(৩) এ চিঠি আপিল বিভাগ তার প্রশাসনিক ক্ষমতায় দিয়েছে। এটা কোনোভাবেই সুপ্রিম কোর্টের মতামত হিসেবে বলার সুযোগ নেই।

(৪) এ চিঠি জনগণের কাছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা ও ভাবমূর্তিকে খর্ব করেছে।

(৫) ওই চিঠি জনগণের মধ্যে বার্তা দিয়েছে যে সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে দায়মুক্ত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছাড়া আর কেউ দায়মুক্তি পেতে পারে না। তবে রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র তার পদে বহাল থাকাবস্থায় এ দায়মুক্তি পাবেন।

(৬) সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে সাত বছর ধরে অনুসন্ধান কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ব্যর্থতা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।

 (৭) ভবিষ্যতে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান বা তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থা বা কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই বিশেষ নজর রাখতে হবে। যাতে অকারণে তাদের মর্যাদাহানি না ঘটে বা হয়রানির শিকার না হন। মনে রাখতে হবে এরসঙ্গে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও গৌরব জড়িত।   

আদালতে শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের দেয়া চিঠির বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। অন্যদিকে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের পক্ষে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন শুনানি করেন। দুদকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, অ্যাডভোকেট প্রবীর নিয়োগী ও সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন তাদের মতামত দেন।

দুদকে জয়নুল আবেদীনের দাখিল করা সম্পদ বিবরণীর সুষ্ঠু যাচাই ও অনুসন্ধানের কথা উল্লেখ করে তার চাকরির (বিচারপতি হিসেবে) মেয়াদ, সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র (যোগদানপত্র, অবসর গ্রহণের তারিখ সংবলিত কাগজপত্র) ও চাকরি সূত্রে বিভিন্ন (বেতন, ভাতা, অবসর সুবিধা ইত্যাদি) খাতে গৃহীত অর্থের বিবরণী (অর্থবছর হিসেবে) চেয়ে গত ২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে চিঠি দেয় দুদক।

বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দুর্নীতি বিষয়ে অনুসন্ধানের স্বার্থে চলতি বছরের ২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়ে চিঠি দেয় দুদক। এর জবাবে গত ২৮ এপ্রিল আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দুদকে পাঠায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘বিচারপতি জয়নুল আবেদীন দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনকালে তিনি অনেক মামলার রায় প্রদান করেন। অনেক ফৌজদারি মামলায় তার প্রদত্ত রায়ে অনেক আসামির ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে।’

সুপ্রিম কোর্টের দেয়া চিঠিটি হাইকোর্টের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট বদিউজ্জামান তরফদার। গত ৯ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের দেয়া চিঠি কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট।

সুপ্রিম কোর্ট থেকে দেয়া চিঠিটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সরকারের পক্ষ থেকেও জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এরপর গত ৩১ জুলাই বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে মোট ২৩ ফর্দ নথি দুদকের কাছে সরবরাহ করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

(ঢাকাটাইমস/১৪নভেম্বর/এমএবি/জেবি)