নারায়ণগঞ্জ-১: গাজীকে ঠেকাতে আ.লীগে ৪, বিএনপিতে এগিয়ে তৈমুর

প্রকাশ | ১৫ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:২০ | আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৭, ২১:০৮

মো. মাজহারুল ইসলাম রোকন, নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্যতম শিল্প এলাকা রূপগঞ্জ। এই উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা এলাকা নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-১ সংসদীয় আসন। বর্তমানে এখানকার সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক)। আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী হতে আগ্রহী ‘বহিরাগত’ গাজীর মনোনয়ন ঠেকাতে একাট্ট সাবেক এমপি কে এম সফিউল্লাহসহ দলের অন্য মনোনয়ন-প্রত্যাশীরা। এ ছাড়া দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জেরবার স্থানীয় আওয়ামী লীগ।

সরকারি দলের এমন বিশৃঙ্খলায় মাঠপর্যায়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির তিন শক্তিশালী মনোনয়ন-প্রত্যাশী। তাদের মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। কম-বেশি দ্বন্দ্ব আছে তাদের মধ্যেও।  
নারায়ণগঞ্জ-১ সংসদীয় আসন এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরোধ-বিভক্তি গড়িয়েছে সহিংসতায়। হত্যাকা-ের ঘটনায় আসামি হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ নেতারাও।

স্থানীয় এমপি গাজী দস্তগীর রূপগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা নন বলে তাকে মেনে নিতে পারছেন না এখানকার তৃণমূল পর্যায় থেকে ওঠে আসা দলের নেতাকর্মীরা। ফলে নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ। মামলা চলছে সেই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজী এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই।

এখানে তৃতীয়বারের মতো লড়তে সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজী আগামী নির্বাচনেও মনোনয়ন চাইবেন। সেই লক্ষ্যে কাজ করছেন তিনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী ডাক্তার শওকত আলীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে টানা দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন দস্তগীর গাজী।

আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেতে মনোনয়নের দৌড়ে মাঠে নেমেছেন দলে অন্তত আরো চারজন। সেক্টর কমান্ডার ফোরাম সভাপতি ও সাবেক সেনাপ্রধান সাবেক এমপি কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম), নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক আবদুল হাই, উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন মোল্লা এবং সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান ভুইয়া। তাদের মধ্যে তোফাজ্জল হোসেন মোল্লা স্থানীয় এমপি গাজীর সঙ্গে নানা কর্মসূচি পালন করছেন।

গত নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ডা. শওকত আলী। আর জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রার্থী ছিলেন জয়নাল আবেদীন মোল্লা। ওই নির্বাচনে হারার পর রূপগঞ্জ এলাকায় মাঠের রাজনীতি কিংবা নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা যায়নি এই দুজনকে।
এখানে স্থানীয় এমপির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান ভুইয়া একটি হত্যা মামলার আসামি। ২০১৬ সালে রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের আগে ১৩ এপ্রিল রাতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী তোফায়েল আহমেদ আলমাছ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী যুবলীগ সভাপতি আব্দুল জাব্বার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ব্যক্তি মারা যান। ঘটনার দিন রাতেই মহিলা লীগ নেতা মাকসুদা বেগম বাদি হয়ে রুপগঞ্জ থানায় শাহজাহান ভূইয়াসহ আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মীর নামে হত্যা মামলা করেন।

এসব ছাড়াও এমপি গাজী ও শাহজাহান ভূইয়ার লোকজনের মধ্যে এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও বৈধ-অবৈধ খাত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দস্তগীর গাজী ও ভারপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে অসাংগঠনিক ও অরাজনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ এনে অব্যাহতির প্রস্তাব করেন শাহজাহান ভুইয়া ও তার বলয়ের নেতাকর্মীরা। একই দিন উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের সভায় এমপি গাজী ও তোফাজ্জল হোসেন মোল্লা পাল্টা শাহজাহান ভুইয়ার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়ার প্রস্তুাব পাস করানো হয়।

এখানকার রাজনীতিতে কে এম সফিউল্লাহ, আবদুুল হাই ও শাহজাহান ভূইয়া চাচ্ছেন রূপগঞ্জে বহিরাগত কেউ যেন আর নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হতে না পারে। যে কারণে এসব মনোনয়ন-প্রত্যাশীরা এমপি গাজীকে ঠেকাতে একাট্টা।

অন্যদিকে এ আসন থেকে বিএনপির তিন শক্তিশালী মনোনয়ন-প্রত্যাশী পুরোদমে নির্বাচনী জনসংযোগ করে যাচ্ছেন। অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ছাড়া অন্য দুজন হলেন  কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান দিপু ভুইয়া ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনির। তবে নির্বাচনী প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় তৈমুর আলম খন্দকার। তিনি প্রায় প্রতিদিনই রূপগঞ্জের কোনো না কোনো এলাকায় জনসংযোগ করে যাচ্ছেন।

রূপগঞ্জের ভোলাব ইউনিয়ন এলাকার সাধারণ মানুষের জমি কিছু প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়ে বালু ভরাট করছে বলে এলাকাবাসীকে নিয়ে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন আন্দোলনে নামেন তৈমূর আলম। গত ৫ নভেম্বর জমি ভরাটকারী একজন ড্রেজার ব্যবসায়ী এলাকার ৪৯ জনের নাম উল্লেখসহ ১০০ জনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা করেন। ওই মামলায় ইন্ধনদাতা হিসেবে তৈমুর আলম খন্দকারকে অভিযুক্ত করা হয়। মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরও নিয়মিত রূপগঞ্জে জনসংযোগে রয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি তৈমুর।

একসময় পুরো নারায়ণগঞ্জ বিএনপির নিয়ন্ত্র্রক ছিলেন তৈমুর আলম। আন্দোলন-সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন তিনি। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি জেলা বিএনপির নতুন কমিটিতে সভাপতি করা হয় কাজী মনিরুজ্জামান মনিরকে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৈমুর আলম খন্দকার কারাগারে থাকায় বিএনপির মনোনয়ন পান কাজী মনির। নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন দস্তগীর গাজীর কাছে। কাজী মনির মুলত একজন শিল্পপতি। তিনি আন্দোলন-সংগ্রামের রাজনীতি কখনোই করেননি।

এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশা নিয়ে নিয়মিত কাজ করছেন দেশের একসময়কার বৃহৎ ধনী গুলবক্স ভুইয়ার নাতি কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান দিপু ভুইয়া। তিনিও সক্রিয় রয়েছেন নির্বাচনী প্রচারণা ও আন্দোলন-সংগ্রামে। রূপগঞ্জের আসনে তরুণদের কাছে জনপ্রিয় সুদর্শন দিপু ভুইয়া।

নারায়ণগঞ্জ বিএনপিতেও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে এবার জেলা কমিটিতে স্থান হয়নি তৈমুরের।  ২০০৯ সালে জেলা বিএনপির সম্মেলনে সভাপতি হন তৈমূর আলম খন্দকার ও সাধারণ সম্পাদক হন কাজী মনিরুজ্জামান মনির। সম্মেলনে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মাঝে কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তড়িগড়ি করে সভাপতি ও সেক্রেটারির নাম ঘোষণা করে সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন। এ কমিটি আর পূর্ণাঙ্গ হয়নি। দীর্ঘ ৭ বছর পর সর্বশেষ চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ২৬ সদস্যবিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়, যেখানে কাজী মনিরুজ্জামান সভাপতি ও অধ্যাপক মামুন মাহামুদকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এ কমিটিতে কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান দিপু ভুইয়াকে সদস্যপদে রাখা হলেও স্থান পাননি তৈমুর। তবে এই কমিটির কোনো প্রভাব পড়েনি তৈমুর আলমের জনসংযোগে।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, দলের ভেতরে যে বিরোধ চলছে তা শিগগির না মেটালে এর প্রভাব পড়বে আগামী নির্বাচনে।

(ঢাকাটাইমস/১৫নভেম্বর/মোআ)