ইতিহাসের আয়নায় বর্তমানের হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িকতা

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১৫ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:৪০

রংপুরে হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় সারাদেশের মানুষ নিন্দা জানাচ্ছে। প্রশাসনের তাৎক্ষণিক তৎপরতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যাদের ঘরবাড়ি ভাঙা বা আগুনে পুড়ে গেছে, তাদের নতুন ঘর বানানোর কাজ চালাচ্ছে সরকার। শেষ মুহূর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ এতটাই তৎপর ছিল যে, হাবিবুর রহমান নামের একজন গুলিতে মারাও গেছে, আহত হয়েছে অনেক। সাম্প্রতিককালে এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরে হামলার ঘটনা ঘটেছিল। সরকার তখনো কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছিল।

নাসিরনগরের হামলায়ও গরীব হিন্দু মানুষের ঘরবাড়ি পোড়া গিয়েছিল। প্রথমে মনে হয়েছিল ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা ধর্মীয় কারণে উত্তেজিত হয়ে হিন্দুদের ঘরবাড়িতে হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু সময়ের আয়নায় এটা পরিষ্কার হয়েছে যে, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতাধর দুই ব্যক্তির রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বলি হয়েছিল সাধারণ হিন্দু জনগণ আর বদনামের ভাগীদার হয়েছে দেশের শান্তিপ্রিয় বাঙালি মুসলমান সমাজ। ঘটনাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য বাইরে থেকে লোক এনে টুপি পড়িয়ে সে হামলা চালানো হয়েছিল। স্থানীয় মুসলমানেরা বরং হিন্দুদের উদ্ধার করতে এগিয়ে এসেছিল বলে সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল।

রংপুরের ঘটনায়ও রাজনৈতিক শক্তি জড়িত। এ হামলায় স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি জামাত-শিবির জড়িত বলে পুলিশ জানিয়েছে। নাসিরনগর আর রংপুরের ঘটনা ভিন্ন জায়গায় হলেও একটা বিষয় খুব কমন। ধর্ম ও সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার। নির্দিষ্ট একটা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ফেসবুক ব্যবহার করে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকে সহিংস করে তোলে। সে সহিংসতায় যারা ঘর-বাড়ি এবং প্রাণ হারায় এরা খুব গরীব এবং সাধারণ হিন্দু আর মুসলমান। যে রাঘব বোয়ালেরা পরিকল্পনা করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চায় কিংবা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তাদের কিছুই হয় না।

নাসিরনগরের পর রংপুরের ঘটনা প্রমাণ করে, এমন ঘটনা সামনে হয়ত আরও ঘটতে পারে। কারণ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ছিল, আছে এবং সহসাই এরা নির্মূল হবে এমনটি ভাবার তেমন কোনো কারণ বা লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই অশুভ শক্তি সুযোগ পেলেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার উপাদানকে কাজে লাগিয়ে মাঝে মাঝে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এত গভীরে হয়, সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝে উঠা মুশকিল। সাধারণ মানুষ শুধু ভিকটিম হয়।

বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের একটা অংশকে ধর্মের কথা বলে বোকা বানিয়ে কী পরিমাণ অরাজকতা সৃষ্টি করা যায়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ। হেফাজতে ইসলাম আর জামাত এক বিষয় নয় এটা সত্য। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে মতিঝিলে যে ভীষণ অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল, তাও অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। মতিঝিলেও কিন্তু হেফাজতে ইসলামের কোনো বড় বা মাঝারি মানের নেতার প্রাণহানি ঘটেনি। এতিম খানা, মাদ্রাসায় পড়া ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে উস্কানি দিয়ে, ভুল বুঝিয়ে মতিঝিলে আনা হয়েছিল।

রাতের আঁধারে একশনে না গিয়ে উপায় ছিল না পুলিশের। ইসলামকে বাংলাদেশে হেফাজত করতে মতিঝিলের সে সহিংস সমাবেশ আয়োজন করার দরকার ছিল না। ইসলাম এদেশের মানুষের হৃদয়ে আছে। আরব থেকে ইসলাম এসে এ অঞ্চলের মানুষকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি দিয়েছিল। জাত-পাতের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে নিম্নবর্গের মানুষের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করেছিল ইসলাম। তাই হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ইসলাম রক্ষা হবে, আর বাকিদের হাতে ইসলামের ক্ষতি হবে এমন মনে করার কোনো কারণ বা যুক্তি নেই। আর হেফাজতের নেতৃবৃন্দের সাথে যে বিএনপি-জামাতের গোপন আঁতাত হয়েছিল, সেটিও পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে। হেফাজতের সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগ সরকারকে ফেলে দিতে চেয়েছিল জামাত-বিএনপি জোট। নারী কেলেঙ্কারিতে কলঙ্কযুক্ত ব্যক্তি, এক সময়ের ‘প্রগতিশীল’, সাম্প্রতিককালে জামাত ঘরানার বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠা ফরহাদ মজহার তার একাধিক ভাষণে হেফাজতের মতিঝিল কাণ্ডের মুল পরিকল্পনাকারী এবং এর সুফলভোগকারীদের পরিচয় গর্বভরে প্রকাশ করেছেন।

ইতিহাস সাক্ষী, আমাদের প্রাণপ্রিয় ধর্ম ইসলামকে বারবার পুঁজি করে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। ইসলামের নামে ইসলাম-বিরোধী কর্মকাণ্ডের ইতিহাস জামাতের অনেক দিনের। জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি জামাতের কর্মকাণ্ড বিচার করলে এর ধর্মাশ্রয়ী ভয়ংকর চেহারা ধরা পড়ে সহজে। মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াতে আবুল আলা মওদুদির মাধ্যমে জামাতের গোড়াপত্তন করেছিল ব্রিটিশ বেনিয়ারা। অথচ জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ এর ব্যানারে ঐতিহাসিক মদিনা সনদের আলোকে মুসলমান আলেমরা সৈয়দ আহমাদ মাদানি হুজুরের নেতৃত্বে সম্মিলিত ভারতবর্ষের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল বহু আগে থেকে। এমনকি কংগ্রেসের জন্মও হয়েছিল সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। কংগ্রেসের বিপরীতে সম্প্রদায়গত তাড়না থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল মুসলিম লীগের। একই জামাত পরে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সহযোগী শক্তি হিসেবে আমাদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে।

ইতিহাসের আরেক পাঠে আমরা দেখি, হিন্দু সমাজে মুসলমান-বিরোধী আবহ তৈরি হয়েই ছিল। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের পতনে খুশি হয়েছিল সে সময়কার হিন্দু এলিট শ্রেণি। বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের দোসর ছিল জগতশেঠ আর রায় দুর্লভরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-পরবর্তী ব্রিটিশ সরকারের শাসন আমলে প্রশাসনিক নানা পদে আসীন ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। মুসলমান জমিদারদের কাছ থেকে জমিদারি কেড়ে নিয়ে, মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে অবহেলা আর বৈষম্য দিয়ে মানুষের মাঝে হাহাকার সৃষ্টি করে রেখেছিল ব্রিটিশ ও হিন্দু প্রশাসকরা। এই বাস্তবতার অবসান ঘটানোর স্বপ্নেই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়েছিল। অর্থনৈতিক আধিপত্য হারানোর ভয়ে কলকাতার এলিটরা আন্দোলন গড়ে তুললে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে সে জন্যও তৎপর ছিল কলকাতার হিন্দু সমাজের একটা অংশ। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার কী?, মুসলমানেরা কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা মাদ্রাসা ছাড়া কিছুই হবে না, জাতীয় অপমানজনক কথাবার্তা বলতেন কলকাতার ‘বাঙালি’ বাবুরা।

১৯৪৭ সালে বাঙালির আলাদা রাষ্ট্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন সে সময়কার তরুণ নেতা, পরবর্তীতে জাতির পিতা হয়ে উঠা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর অনুসারীরা , কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত এবং পাকিস্তানের স্বার্থান্বেষী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির যোগসাজশের জন্য বাঙালির সে রাষ্ট্র আর কায়েম করা যায়নি। ফলে আমাদেরকে বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের অংশ হতে হয়েছিল। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ৭৩ নং পৃষ্ঠায় এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বর্ণনা দিয়েছেন। পাকিস্তানের কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ভারতের জহরলাল নেহেরুর সাথে আঁতাত করে কলকাতা, দার্জিলিং, আসামের কাছাড়, করিমগঞ্জ ভারতকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। জিন্নাহ গং কলকাতাকে পাকিস্তানে রাখতে চাননি, কারণ এতে লাহোর, করাচীর মান-মরিয়াদা কমে যাবে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু এলিটরা কলকাতাকে ভারতে রেখে দিতে মরিয়া ছিল, কারণ ব্রিটিশ আমলে পূর্ববঙ্গের সম্পদ লুণ্ঠন করে বড় বড় দালান-কোঠা আর সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠেছিল কলকাতায়। এতদিনের গড়ে তোলা বৈধ-অবৈধ সম্পদ হাতছাড়া হবে, এটা মেনে নিতে পারছিলেন না তারা। একই কারণে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ মানতে পারেনি এই জমিদার ও এলিট শ্রেণি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ভালো করে পড়লে সে সময়ের পরিস্থিতি বুঝতে আমাদের কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

তাই সাম্প্রদায়িকতা কোনো একপাক্ষিক বা এক ধর্মের বিষয় নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতার জন্মদাতারা মুসলমান এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায় থেকেই আবির্ভূত হয়েছেন। শুধুই মুসলমানদেরকে ভিলেনের চেহারা দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা হিসেব করলে জীবনেও এর বিলোপ হবে না। ভারত ও পাকিস্তানের সেই স্বার্থান্বেষী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্তরসূরিরা এখনো বাংলাদেশে তৎপর। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামাতের কিছু নেতার বিচার হলেও জামাতকে দল হিসেবে এখনো নিষিদ্ধ করা হয়নি। তাই জামাত এখনো বাংলাদেশে তৎপর। যদিও নিবন্ধন বাতিল হয়ে মামলা এখন আদালতে প্রক্রিয়াধীন। জামাতের নিবন্ধন বাতিল হলেও এর কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে না সহজে। জনসমর্থন বড়জোর ২/৩ শতাংশ হলেও জামাতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নেটওয়ার্ক অনেক শক্তিশালী। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগেই বহু জামাত নেতা-কর্মীর অনুপ্রবেশ করেছে বলে পত্র-পত্রিকায় আমরা খবর দেখেছি। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এক যুদ্ধাপরাধী জামাত নেতার মেয়ে স্থান পাওয়া নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে।

ইসলামের নামে জামাত এবং সমমনা শক্তি যেমন সাম্প্রদায়িক তৎপরতা চালাচ্ছে, তেমনি হিন্দু সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশ নানা ব্যানারে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে। এই হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আইনজীবী গোবিন্দ প্রামাণিক। গোবিন্দ প্রামাণিক নিজের ভাষণ, বক্তৃতায় ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে স্লোগান দেন। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে গোবিন্দ প্রামাণিকের ভয়ংকর সব বক্তব্য আছে। গোবিন্দ প্রামাণিক হিন্দুদের পবিত্র রথযাত্রার সময় ত্রিশূল নিয়ে মুসলমানদের সাথে মারামারিতে লিপ্ত হওয়ার জন্য সরলপ্রাণ হিন্দুদের উস্কানি দেন (https://www.youtube.com/watch?v=7Csgv2CH3Ko)। ভারতের বিজেপি, শিবসেনার সাথে তার রয়েছে প্রত্যক্ষ গভীর সম্পর্ক। বাংলাদেশে প্রকাশ্যে ব্যানারে, ফেস্টুনে হিন্দি ভাষা এবং বিজেপির লোগো ব্যবহার করেন এই ব্যক্তি। নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘর-বাড়ি, মন্দিরে হামলার প্রতিক্রিয়ায় শাহবাগে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের উপর হামলা চালিয়েছিল কট্টর হিন্দুদের একটা দল। (https://www.youtube.com/watch?v=AwY26oF9wmI।

বাংলাদেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবী এবং ইতিহাসবেত্তা অধ্যাপক মুনতাসির মামুন এবং সাংবাদিক স্বদেশ রায় নিজ নিজ প্রবন্ধে ‘জাতীয় হিন্দু মহাজোট’ ও এর প্রধান নেতা গোবিন্দ প্রামাণিকের মুখোশ উন্মোচিত করেছেন। দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, আইনজীবী গোবিন্দ প্রামাণিককে জামাতের চর হিসেবে প্রমাণ করেছেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম নির্দেশদাতা, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসলে এই গোবিন্দ প্রামাণিক তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন বলে জানান মুনতাসির মামুন। স্বদেশ রায়ও তাঁর নিজের প্রবন্ধে হিন্দু কট্টরপন্থীদের বিষয়ে সরকার ও জাতিকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। স্বদেশ রায়কে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও, অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের বিচার দাবি করে গোবিন্দ প্রামাণিক হিন্দিতে লেখা ব্যানারসহ প্রেস কনফারেন্স পর্যন্ত করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। জাতীয় হিন্দু মহাজোটের কর্মকাণ্ডের খবর নিতে গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু হলে কিছুটা সময় চুপচাপ থাকলেও কদিন আগে আবার প্রেস কনফারেন্স করেছেন এই গোবিন্দ প্রামাণিক। প্রেস কনফারেন্সে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ভয়ংকর সব অভিযোগ করেছেন তিনি। অথচ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এই হিন্দু মহাজোট শিক্ষকদের জন্য হিন্দু শিক্ষক জোট, হিন্দু শিক্ষার্থীদের জন্য সনাতন বিদ্যার্থী পরিষদ নামে সব সাম্প্রদায়িক সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে। এভাবে একেকজন বাংলাদেশী বাঙালিকে শুধু হিন্দু পরিচয়ে ভাগ করে ফেলে স্বার্থান্বেষী কর্মকাণ্ড চালালে তাকে সাম্প্রদায়িক অপতৎপরতা বলে চিহ্নিত করা উচিত। বাঙালি হিন্দুদের একটা অংশকে এই অশুভ শক্তি সাম্প্রদায়িক শক্তিতে রূপান্তরের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। রাষ্ট্রকে তাই হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দমনে সচেষ্ট হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যদি রাষ্ট্র পরিচালনা আমরা চাই, তাহলে কে হিন্দু, কে মুসলমান সেটি প্রধান পরিচয় হতে পারে না। ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’, এই মহা মূল্যবান বাণী দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এটাও বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’। সবাই যে যার ধর্ম পালন করবে, সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে, এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।

কথায় কথায় সংখ্যালঘুর তকমা লাগিয়ে সুবিধা নেয়ার সংস্কৃতিও বন্ধ করতে হবে। না হলে সুষম বণ্টনের সমাজ সৃষ্টি হবে না। আমাদের সংবিধানে কে হিন্দু, কে মুসলিম সেটি বড় করে দেখা হয়নি। সবাইকে নাগরিক হিসেবে সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ধর্ম পরিচয়কে প্রধান করতে গিয়ে আমরা বরাবরই আমাদের বাঙালি পরিচয়কে ভুলে যাচ্ছি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ৪৯ নং পৃষ্ঠায় দুই নং অনুচ্ছেদ এর নিচের অংশে সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরুর সুবিধা-অসুবিধার রাজনীতি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স এনেছেন বঙ্গবন্ধু। তৎকালীন লেবার পার্টি থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া ক্লিমেন্ট এটলি ১৯৪৬ সালে একটি ভাষণ প্রদান করেছিলেন। এটলি সাহেবের বক্তৃতার একটা লাইন নিজের আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি লিখেছেন, ‘মিস্টার এটলি তাঁর বক্তৃতার এক জায়গায় যা বলেছিলেন, তাই তুলে দিলামঃ Mr Atlee declares that minorities can not be allowed to impede the progress of majorities. মিস্টার এটলি‘র বক্তৃতায় কংগ্রেস মহল সন্তোষ প্রকাশ করলেন’।

নিজেদের স্বার্থে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর আপত্তিজনক ও বিতর্কিত কথায়ও কংগ্রেস মহল খুশি হয়েছিল। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে পরিশুদ্ধ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। আইনের চোখে সবাই সমান, এ মহান কথার বাস্তবায়ন করতে হবে। সব ধর্মের সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উপড়ে ফেলতে হবে। ভারতের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আর পাকিস্তানের হয়ে যারা এদেশে কাজ করবে তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে দ্রুত। না হলে, বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের চার মূলনীতি-বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কায়েম করা যাবে না। বিজেপিসহ অন্যান্য কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলো ভারতে এতটাই সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে যে, দেশটি কদিন আগে সাম্প্রদায়িক সহিংস রাষ্ট্রের তালিকায় সারাবিশ্বে চতুর্থ স্থান ‘অর্জন’ করেছে। পাকিস্তান ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় উঠে গেছে বহু আগেই। এ দুটো রাষ্ট্রেরই জন্ম হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :