ইতিবাচক রাজনীতির ধারা বেগবান হোক

প্রভাষ আমিন
 | প্রকাশিত : ১৯ নভেম্বর ২০১৭, ১২:২৮

হঠাৎ করেই সরগরম রাজনীতি। বহুদিন ধরেই বিএনপি রাজনীতিতে প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল। দিনে প্রেসক্লাবে কোনো দোকানের অনুষ্ঠানে নেতাদের বিপ্লব, নয়াপল্টনে দৈনিক ব্রিফিং আর রাতে গুলশানে আড্ডাÑ এই ছিল তাদের রাজনীতি। জনগণের সাথে প্রায় কোনো সম্পর্কই ছিল না। ২০১৫ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বর্ষপূর্তিতে টানা অবরোধ, সহিংসতা, পেট্রোল বোমা, আগুন, হত্যার রাজনীতির ইতি টেনে ইতিবাচক ধারায় ফেরার যে চেষ্টা, সেই চেষ্টায় কেটে গেছে অনেকটা সময়। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো স্বীকার করেনি বটে; কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং তার বর্ষপূর্তিতে যা করেছে; তা যে তাদের জন্য ভালো হয়নি; সেই উপলব্ধি বিএনপির হয়েছে বলেই মনে হয়। তাই নিজেদের হারানো ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতেই গত আড়াই বছর ধরে তাদের প্রাণান্তকর চেষ্টা। সেই চেষ্টায় তারা অনেকটাই সফল। বিএনপি প্রমাণ করতে পেরেছে, সন্ত্রাস-সহিংসতার রাজনীতি তারা পেছনে ফেলে এসেছে। বারবার চেষ্টা করলেও সরকারের আস্থা অর্জন করতে তাদের অনেক সময় লেগেছে। বারবার চেয়েও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি তারা। ১৮ মাসেরও বেশি সময় পর গত ১২ নভেম্বর ২৩ শর্তে অনুমতি মেলে। সমাবেশে লোক কম হয়েছে না বেশি হয়েছে, তা নিয়ে দুই দলের মধ্যে পাল্টপাল্টি আছে।

তবে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের জনসভায় লোকসংখ্যা কম না বেশি এ নিয়ে তর্ক করা অহেতুক। এ দুটি দল চাইলে একদিনের নোটিশে কয়েক লাখ লোকের সমাবেশ ঘটাতে পারে। আর দুই কোটি লোকের ঢাকা শহরে কয়েক লাখ লোকের সমাবেশ ঘটানো বিশাল কিছু নয়। আর ১৬ কোটি মানুষের দেশে ১০ লাখ লোকের সমাবেশও নিশ্চয়ই নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের নির্ধারক নয়। সংখ্যা নয়, যেটা নজর কেড়েছে; তা হলো বিএনপি নেতা-কর্মীদের উচ্ছ্বাস। অনেকদিন পর তারা বিনা বাধায় শান্তিপূর্ণভাবে একটি সমাবেশ করতে পেরেছে। তাদের সবার মধ্যেই এই রাজপথে নামতে পারার আনন্দটা ছিল চোখে পড়ার মতো।

শান্তিপূর্ণ, তবে বিনা বাধায় হয়েছে এমনটি বলা যাবে না। সরকার বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিলেও আওয়ামী লীগ তার পুরনো কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছিল। সরকারি দলের অঘোষিত হরতালে দুর্ভোগে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। সমাবেশে যাতে লোক সমাগম বেশি হতে না পারে সে জন্য অদৃশ্য ইশারায় গণপরিবহন গায়েব হয়ে গিয়েছিল। ঢাকার আশপাশের মানুষ নির্বিঘেœ সমাবেশে আসতে পারেনি। ঢাকার মানুষকেও সমাবেশে যেতে হয়েছে পায়ে হেঁটে। সমাবেশকে ঘিরে সংলগ্ন এলাকায় যানজট আর নগরজুড়ে পরিবহন শূন্যতার ফাঁদে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় বলে, তারা রাজনীতি করে সাধারণ মানুষের জন্য!

এইটুকু দুর্ভোগ মেনে নিয়েও আমি বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া এবং বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে ইতিবাচকভাবেই দেখছি। আমার আশঙ্কা ছিল, শেষ পর্যন্ত সরকার বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেবে না। আমার আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করায় সরকারকে ধন্যবাদ। অতীতে আমাদের রাজনীতির যে সংঘাত, হানাহানি; তার তুলনায় রাজনীতির এই ইতিবাচক ধারা আশাবাদী হওয়ারই মতো। রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি থাকবে, আদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকবে। কিন্তু দ্বন্দ্বটা যেন সংঘাত না হয়, পাল্টাপাল্টি বক্তব্য যেন কুৎসা না হয়; এটা মনে রাখা জরুরি। আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুটি আলাদা দল। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের অবস্থান আলাদাই থাকবে। যেমন ৭ নভেম্বরকে বিএনপি পালন করে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে। আওয়ামী লীগের চোখে দিনটি মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস। দুই দল যার যার মত জনগণের সামনে তুলে ধরবে। জনগণ তাদের পছন্দটা বেছে নেবে। মতপ্রকাশ করা, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করা সবার সাংবিধানিক অধিকার।

সরকার হঠাৎ বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি কেন দিল? না দিলে কী হতো? না দিলে বিএনপি কিছু ব্রিফিং করতো, আমরা টক শোতে কিছু গরম গরম কথা বলতাম। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগ আন্তরিকভাবেই চায় আগামী নির্বাচনে বিএনপি আসুক।

২০১৪ সালে এই আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল। তবে আওয়ামী লীগ জানে বিএনপিকে ছাড়া আরেকটি নির্বাচন করা অত সহজ নয়। আগামী নির্বাচন কেমন হবে, কার অধীনে হবে; সেটা নিয়ে সামনে আরো অনেক আলোচনা হবে। তবে সরকারি দলের আন্তরিকতা দৃশ্যমান। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, আগামী নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার হবে না। এটা বিএনপির দাবি। অথচ আওয়ামী লীগের দাবি ছিল উল্টো। সেনা মোতায়েনের ব্যাপারেও বিএনপির দাবি মেনে ইতিবাচক সিদ্ধান্তই আসছে বলে মনে হচ্ছে।

শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবেন না, এই অবস্থানে অনড় থাকলেও সমাবেশে খালেদা জিয়ার বক্তব্যও ছিল ইতিবাচক। তিনি জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। ক্ষমতায় এলে প্রতিহিংসাপরায়ণ না হওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। তার সব কথাই আশাবাদী হওয়ার মতো। তবে খালেদা জিয়ার ভালো ভালো কথা শুনে আশাবাদী হওয়ার পাশাপাশি কিছু প্রশ্নও জেগেছে মনে। সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘বিএনপি হিংসার রাজনীতি করে না। আমরা দক্ষতা-যোগ্যতা দেখব। বিএনপি বা আওয়ামী লীগ বলে কিছু নেই। দক্ষতা-যোগ্যতা দেখা হবে।’ খুব ভালো কথা ম্যাডাম। কিন্তু ম্যাডাম আপনি তো আগে তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখন কি আওয়ামী লীগ-বিএনপি না দেখে দক্ষতা-যোগ্যতা দেখে নিয়োগ দিয়েছিলেন?

খালেদা জিয়া বলেছেন ‘আমরা সহিংসতার রাজনীতি করি না। আমরা আপনাদের (আওয়ামী লীগ) শুদ্ধ করব। আপনারা যে মানুষ মারেন, গুম, খুন করেন এগুলো বাদ দিয়ে আপনাদের শুদ্ধ বানাব।’ আহা খুব ভালো কথা। বর্তমান সরকার যে অবাধ ক্রসফায়ার আর গুমের সংস্কৃতি চালু করেছে; তা অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু ম্যাডাম, বাংলাদেশে অপারেশন ক্লিনহার্ট আর র‌্যাবের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- কিন্তু আপনার আমলেই শুরু হয়েছিল।

অতীতে বিএনপি ক্রসফায়ার করেছে, সহিংসতা করেছে, পেট্রোল বোমা মেরেছে বলেই ভবিষ্যতে তারা ইতিবাচক রাজনীতি করতে পারবে না; এমনটা আমি মনে করি না। তবে নিজের ভুল স্বীকার করে অপরকে শুদ্ধ করার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করলে তা আরো বিশ্বাসযোগ্য হতো। অতীতে বিএনপি ক্রসফায়ার করেছে বলেই এখন আওয়ামী লীগের গুম জায়েজ; এমন কুযুক্তিতে আমি বিশ্বাস করি না। অতীতে বিএনপি সংঘাত করেছে বলেই তাদের ইতিবাচক ধারায় চলাকে সন্দেহ করার মতো খুঁতখুঁতে আমি নই।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচকতার যে ধারা শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত থাকুক, আরো বেগবান হোক। সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে আদর্শ গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসুক দেশে।

প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :