চলে যাওয়া মানেই হারিয়ে যাওয়া নয়!

দিলরুবা শরমিন
 | প্রকাশিত : ১৯ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:৫৪

২০০০ সালে প্রথম জানলাম চলে গেল! আমার মা চলে গেল ২০০০ সালে। তাকে স্পর্শ করছিলাম আর ভাবছিলাম– নাহ এই তো তুমি। এই তোমার চুল–চোখ–মুখ মন্ডল–তোমার হাত–তোমার সর্বাঙ্গ! এই তোমার জঠর। যার মাঝে আমি ভ্রুণ ছিলাম। মানব সন্তান হিসেবে জন্মেছিলাম। আজ আমার বয়স হয়েছে বটে কিন্তু অন্তঃপুরের আমি আজো সেই ছোট্ট মেয়ে। যে কি না ছেলের জন্মের পরও তোমার সাথেই ঘুমাতাম। আমি যে ছিলাম তোমার ছোট্ট মেয়ে! কাজ করতেই আমাকে চলে যেত হয়েছিল দূরে অনেক দূরে। কিন্তু মা আমার কাছেই ছিল। আজ ১৭ বছর পর যেমনটি আছে। যতবার কালো কোট পরে আয়নার সামনে দাঁড়াই- দেখি আমি নয় তুমি হাসছো। চলে গেছো– হারাওনি!

তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু মিতা একদিন হঠাৎ না বলে কয়েই চলে গেল। সুশ্রী– সুশীল–শান্ত এই বন্ধুটি আসলেই হারিয়ে গেছে? যায়নি। যে কোনো মুহূর্তেই মনে পড়ে মিতাকে। চলে গিয়েও রয়ে গেছে।

অথবা ছেলেবেলার বন্ধু ‘টুকি’? অসম বর্ণে বিয়ে করাতে এবং ঠাকুরের কথা মতো গরুর গোবর খেয়ে শুদ্ধ হতে রাজি না হওয়াতে তাকেও অবেলায়-অসময়ে চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু আমার জীবন থেকে কি হারিয়ে গেছে সেই ছেলেবেলার স্মৃতি? না, হারায়নি। তাই আজো সেই শিক্ষা মাঝে মাঝে মাথায় আসে ‘অসম বর্ণ’!

অথবা এইভাবে ক্রমাগত আমার জীবনে আসা-যাওয়ার মানুষগুলো একেক সময় মনে হতো, এই বুঝি জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। সেই সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত নিমেষে যে কোথায় আরেকটি নতুন উপাখ্যান দখল করে নেয়- বুঝিনি।

যতবার যত নিকটজনকে হারিয়ে নিজেকে নিঃস্ব ভেবেছি ততবারই আরো ‘আলো এসে দূর করেছে অন্ধকার’!

আমার বড় মামা অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন। তার অনেক গুণের মাঝে আমার সবচেয়ে ভালো লাগা ছিল, তার হাতের লেখা। অসাধারণ হাতের লেখা আর চমৎকার হাসি যে আমার ভীষণ দুর্বল জায়গা সেটা তিনিও জানতেন। তার সাথে আমার একটু মান অভিমানের সম্পর্কই ছিল। তিনি চাইতেন আমি আমার নানান ‘সুমহান কীর্তির প্রকাশ ঘটাই’। তার সাথে সাথে– পাশে পাশে থাকি। আর মনে মনে ‘স্বাধীনচেতা’ আমি মুখে না বললেও কোনো দিনই তার কথা শুনিনি। বড় মামা একটা অনেক বড় উপন্যাস লেখার কাজ শুরু করেছিলেন। শুরুতেই আমার মাকে বলেছিলেন, এটা আপনাকে উৎসর্গ করব। তিনি সেটা শেষ করতে পারেননি। কারণ মা চলে যাবার বছর দুয়েক আগেই বড় মামা চলে যান। তবে আমার জীবনে তিনি হারিয়ে যাননি। ১৭ নভেম্বর কি আমি ভুলে গিয়েছিলাম তার জন্মদিনের কথা? একবারও না।

আমি আসলে কাউকে আগলে ধরেই বাঁচতে চাইনি। একাকী খড়কুটোর মতো ভাসতেও চাইনি। যোগ্যতা না থাকায় কিছুই হতে চাইনি। তাই কিছু হতেই পারিনি। এই না চাওয়া নিয়ে আমার আফসোস নাই। না পাওয়া নিয়ে হতাশাও গ্রাস করেনি আমাকে। কিন্তু যারা চলে গেছে তাদের অনুপস্থিতি অনুভব করি।

পিটিআই স্কুলে পড়ার সময় সেই ‘শামসুন্নাহার আপা’? যিনি ১৯৭১ সালে স্বামী–সন্তান হারিয়ে প্রতিদিন ক্লাসে এসে গান করতেন। তিনি কি আসলেই শুধু গান করতেন। কিছুই কি শিখিনি তার কাছ থেকে? নইলে এই চলে যাওয়া মানুষটিকে আজো মনে পড়ে কেন?

আমার কলেজের ফসিউজ্জামান স্যার খুব ভালো ম্যাথ করান। স্টাটিসটিকসের পন্ডিত। কলা বিভাগের ছাত্রী আমি। তারপরও ফসিউজ্জামান স্যারের ক্লাসে হাজির হতাম। এ আমার এক ধরনের দুর্নিবার আকর্ষণ, ভালো শিক্ষকের ক্লাসে যাওয়া! ভাবিনি এ আমার বিষয় নয় ভাবতাম শিখলে তো দোষ নাই।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও প্রায়ই এই রকম প্রিয় স্যারদের ক্লাসে হাজির হতাম। তারা কেমন করে কথা বলেন, কী বলেন- শোনার এই ব্যাপক আগ্রহ আমাকে তাড়িত করতো। বন্ধুদের আড্ডায় আমি যতই প্রগলভ হই না কেন শিক্ষকের সামনে বরাবরই আমার মাথা নত। হাসান আজিজুল হক স্যার, সনত স্যার, শিশির স্যার, শহীদুল ইসলাম স্যার, সুব্রত স্যার এবং আলী আনোয়ার স্যার কী পড়ান সেসব আমার ‘ক্যারিয়ার গঠনের’ বিষয়বস্তু না হলেও মন্ত্রমুগ্ধের মতই ছুটতাম। বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, এই নিয়ে কোনো স্যারের কোনো ওজর আপত্তি বা প্রশ্নই থাকতো না। প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আলী আনোয়ার স্যারকে সমঝে চলতো না কে? ক্যাম্পাসে আমাদের মিছিলের স্লোগান ও তাকে দূর থেকে দেখা মাত্রই নম্র হয়ে আসতো। ‘রক্ত করবী’ নাটকে এ নন্দিনীর চরিত্র আমাকে দিয়ে হবে না’ এই সংলাপ ছুড়ে বই ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বড় মামার হাত থেকে রক্ষা পেলেও মৃদুভাষী, জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরের অধিকারী আলী আনোয়ার স্যার যখন বলে বসলেন, হবে। হতেই হবে। তখন আর কি কিছু বলার ছিল আমার?

সেই আলী আনোয়ার স্যার যখন চলে গেলেন তিনি কি আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন? সুখে বা সংকটে তার কথা কি বার বারই মনে পড়ে না? কথা না বলেও যে অনেক কথা বলা হয়ে যায় সে শিক্ষা কি তার কাছ থেকে পাইনি?

শিক্ষক শব্দটার প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ আমার জীবনে কখনো ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠেনি। আমি শিখেছি। ক্রমাগত শেখার চেষ্টা করেছি। আজো করে যাচ্ছি।

বদরউদ্দীন স্যার সম্পর্কে আমার ধারণা ভুল ছিল। এই ভুল ধারণা আমার মতো অনেকেরই ছিল। আমি ভাবতাম আমিই স্যারের প্রিয় ছাত্রী। এমনিভাবে আমার ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা? বড় বা ছোট ভাই বোনেরা? সকলেই ভাবতো ‘সে’ই একমাত্র প্রিয় ছাত্র/ছাত্রী। এতো ব্যালান্সড সম্পর্ক এবং সকলকে সমানভাবে দেখার শিক্ষকের কি আজকাল আকাল পড়েছে?

স্যার চলে গেছেন বেশ কিছুদিন হলো। কিন্তু আমার জীবন থেকে হারিয়েছেন? চলে যাওয়া যায়। হারায় না!

নানা জায়গায় কাজ করে শেষ অব্দি উকিল পাড়ায় আমার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটবে ভেবেছিলাম। এর অন্যতম কারণ ছিল আমার মায়ের চাওয়া আর এমন একজন মানুষের সান্নিধ্যে আসা যিনি আইনকে সাহিত্যের রুপ-রস-গন্ধ দিতে পারতেন। এ কে এম সলিমউল্লাহ স্যার। ক্ষীণদেহী– ঝকঝকে এই মানুষটার ভেতর এবং বাইরে একই ছিল। কেবল এক নাগাড়ে সিগারেট আর চা খাওয়া ছাড়া বাকিটা সময় কেটে যেত শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ দেশভাগের মতো কত রকমের আলোচ্য বিষয় নিয়ে সে আর আজকাল খুঁজে পাই না। চুপচাপ বসে থেকে তার কথার মাঝে মাঝে একেকটা সূত্র ধরিয়ে দেয়াই ছিল আমার কাজ।

এই মানুষটা যে কত খাঁটি একজন মানুষ ছিলেন আজ বাংলাদেশের বিচার বিভাগের দিকে তাকালেই শুধু ভাবি। কতো কথা তিনি বলে গিয়েছিলেন আজ থেকে বছর দশেক আগেও সেটা আমরা যারা শুনেছি তারাই জানি। এই সব বলার জন্য জ্যোতিষ হওয়া লাগে না কেবল ‘আক্কেল বুদ্ধি’ থাকলেই চলে। আজ আদালত পাড়ার দিকে তাকালে চোখ ভিজে আসে কেন?

যেদিন স্যার চলে যান সেদিন কি আমি ভেবেছিলাম তিনি চলেই যাচ্ছেন? তিনি চলে গেছেন হারিয়ে যাননি আমার জীবন থেকে। তাই আদালত পাড়ায় আমার পথ ততটা কঙ্কাটাকীর্ণ নয়। যেখানে কোনো লোভ লালসা বা বিনিময় বা প্রাপ্তির আশা থাকে না- সে পথ দুর্গম নয়।

অথবা আমার আরেক প্রিয় শিক্ষক ড. অশোক শাহ আমাকে যেদিন আবিষ্কার করলেন আইন নিয়ে পড়ে আমি এমবিএ করতে এসেছি সেদিন শুধুই একবার তাকিয়েছিলেন। তার উত্তরে আমার তার দিকে তাকিয়ে থাকাই ছিল তার প্রশ্ন না করার নিঃশব্দ উত্তর। ড. অশোক শাহের চলে যাবার সংবাদ আমি তাৎক্ষণিক পাইনি। পেলে আমি হয়তো ছুটে যেতাম অথবা না। যার শিক্ষা আমি ধারণ করেছি- প্রাণোচ্ছ্বল এই মানুষের শব দেখার ইচ্ছা হয়তো আমার হতোই না।

এতসব লেখার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য নাই, আছে কিছু অব্যক্ত যন্ত্রণা।

ইদানিং কিছু কিছু মানুষের শিক্ষককে অসম্মান করার প্রবণতা, সন্দেহ করার চেষ্টা বা কোনো কোনো শিক্ষক যখন নিজেকে যখন সম্মানের আসন থেকে টেনে নীচে নামিয়ে আনেন তখন আমি কষ্ট পাই। লোভ–প্রতিহিংসা অন্যকে ছোটো করার মাঝে আত্মতৃপ্তি কতটা আছে বুঝি না। অন্যের যোগ্যতাকে হিংসা না করে তার কাছ থেকে আমরা তো আরো বেশি কিছু শিখতে পারি। সকলেই এক যোগ্যতা নিয়ে জন্মাতে পারে না। কিন্তু চাইলে নিজেকে তো যোগ্যদের মূল্যায়ন করতে পারে! এই প্রতিহিংসা পরায়নতা আমাদেরকে কী দিচ্ছে? বরং আমরা এইভাবে ক্রমাগত আমাদের বন্ধন ছিন্ন করে ফেলছি না কি?

বরং বার বার মনে হয় এভাবেই আমরা বেঁচে থেকেও হারিয়ে যাচ্ছি। আর অনেকেই চলে গিয়েও থেকে যান আমাদের হ্রদয় নন্দন বনে।

বেঁচে থেকে হারিয়ে যাওয়ার চেয়ে চলে গিয়েও থেকে যাওয়া কি অধিক সম্মানের নয়?

লেখক: আইনজীবী ও মানিবাধিকার কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :