নদীপাড়ের মানুষ (পর্ব-৩)

বাঁধের মানুষদের খোঁজ নেয় না কেউ

প্রকাশ | ২০ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:০৬

প্রতীক ওমর, বগুড়া

এক সময় থাকার ঘর ছিল। ছিল গোয়াল ও গরু। ফসল ফলানোর জমিও ছিল। সেই জমিতে চাষ হতো নানা ধরনের ফসল। গাইয়ের দুধ, বোরো ধানের ভাত, নদীর টাটকা মাছ সবই ছিল। সময়ের নির্মম পরিহাসে এসব এখন তাদের কাছে কেবলি স্মৃতি। ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে হলে এখন তাদের চোখে পানি ঝরে। অতীতের হাজারো সুখময় দৃশ্য ঝাপসা হয়ে ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়। নদী পাড়ের মানুষেরা প্রকৃতিগতভাবেই দরিদ্র। নদীর সাথে প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় তাদের। রাষ্ট্রও অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও পরিবেশগত কারণে তাদের শতভাগ সুবিধা দিতে পারে না।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, রাস্তাঘাট কোনোটির সেবাই নদীপাড়ের মানুষগুলো পায় না। এমনকি এক জায়গায় ঘর তুলে বছরের পর বছরও অবস্থান করতে পারে না। নদী এসে বাঁধ সাধে। ভেঙে দেয় ঘরসংসার। কেড়ে নেয় স্বপ্নের সব রঙ। তারপরেও তারা নদীর কাছেই থেকে যায়। নদী তাদের সাথে শত্রুতা করলেও জীবনের অংশ হিসেবে চরবাসী নদীকে অনেক আপন করে নিয়েছে। এখানকার নদী আর নারী একই সুতোয় গাঁথা।

তাজো, মঞ্জিলা, সাহেরা, জুলেখা, মরিয়াম, ফুলেরা বেগম এবং বেওয়াদের বয়স ষাটের কোঠা পেরিয়েছে। কারো হয়তো আরও বেশি। নদীগর্ভে এদের বসতভিটা অনেক আগেই বিলীন হয়েছে। যমুনার বাঁধের উল্টো পার্শ্বে এখন তাদের থাকার একটি করে ছোট ঘর আছে। সেই ঘরগুলো বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানিতে ডুবে যায়। চুলো থেকে শুরু করে চাল পর্যন্ত পানি এখন তাদের ঘরের ভেতর। তবুও বাঁচতে হবে তাদের। উপায় না পেয়ে বাঁধেই বেঁধেছে বাসা।

সারিয়াকান্দির কুতুবপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধেই এখন তাদের স্বপ্নের সংসার। এসব মানুষের জীবনচিত্র স্বচক্ষে দেখতে সারাদিন সারিয়াকান্দি উপজেলার চর এলাকাগুলোতে কথা বলেছি এসব দুস্থ মানুষের সাথে।

উপজেলার মথুরাপাড়া বাজারের দক্ষিণ থেকে শুরু করে কামালপুরের দড়িপাড়া পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ছোট ছোট ঘর তুলে আশ্রয় নিয়েছে সহস্রাধিক পরিবার। বৃষ্টি সময় এসব ঘরের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে। আবার রোদের সময় সূর্যের তাপে অত্যধিক গরম হয় ছাপড়া (একচালা) ঘরগুলো। শিশুদের নিয়ে এখানকার বাসিন্দারা অনেক কষ্টেই দিন কাটাচ্ছেন।

এখানে বসবাসকারী পরিবারের প্রধানদের অধিকাংশ কৃষক। তারা অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালায়। পাশাপাশি পশুপালন করে থাকে।  বাঁধের বাসিন্দা বিশা ঢাকাটাইমসকে জানান, বাঁধের পাশে নিচু এলাকায় তাদের বাড়ি-ঘর হওয়ায় বন্যার সময় নষ্ট হয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা বাঁধের উপরে ঘর বেঁধেছে।

জুলেখা, মরিয়াম, ফুলেরা জানান, খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতারা কেউ তাদের খোঁজ নেন না। এমনকি সরকারি ত্রাণও তারা পান না বলে অভিযোগ করেন। 

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ধারাবর্ষা, শংকরপুর, চন্দনবাইশা, কুতুবপুর, চরলক্ষিকোলা, ডাকাতমারিরচর, ইন্দুরমারিরচর, চরকর্নিবাড়ি, তালতলা, বেনুপুর, পাকুরিয়া, চরমানিকদাইর, চরদলিকা, শিমুলতাইড়, চরকালুয়াবাড়ি, চরবিরামেপাচগাছি, নয়াপাড়া, জামথল, চরবাকিয়া, ময়ূরেরচর, চরদেলুয়াবাড়ি, কুড়িপাড়ারচর, চরশালিকা, করমজাপাড়া, টেকামাগুড়ারচর, ধুনটের বৈশাখী, ভান্ডাবাড়ি, মাঝিরারচর এসব চর ছাড়াও যমুনাপড়ের আরও অসংখ্য চর আছে।

দেশের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষ নদী অববাহিকায় এসব চরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তাদের নাগরিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা এবং চরের উন্নয়ন নিশ্চিত করার ব্যাপারে কারোই কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেই।

চরের মানুষ অনেক পরিশ্রমী, তাদের শ্রমকে সম্পদে পরিণত করা শুধু মাত্র উদ্যোগের ব্যাপার। যদিও বেসরকারি কিছু এনজিও চরের মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলে দুই একটি প্রকল্পের কার্যক্রম চালিয়েছে। তবে এসব প্রকল্পের বেশির ভাগই লোক-দেখানো মাত্র। নদীপাড়ের মানুষদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন না হলেও ভাগ্যের পরির্বতন হয়েছে এনজিওগুলোর।

সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সারওয়ার আলম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘চরের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য সরকারি বরাদ্দের সবটুকুই ব্যয় করে থাকি। সব সময় বাঁধের মানুষদের খোঁজখবর অফিসিয়ালি রাখা হচ্ছে।’

(ঢাকাটাইমস/২০নভেম্বর/প্রতিনিধি/জেবি)