কিং খানের বেড়ে উঠা- ১১

এবার শাহরুখের ইউরোপ-আমেরিকা ‘জয়’

প্রকাশ | ২০ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:১৮ | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৭, ২১:৩৩

আনিমুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস

অনেকেই একটা তথ্য জেনে অবাক হবেন যে ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ ছবিটির সহকারী পরিচালক ছিলেন বলিউডের আনসুইটেবল বয় হিসেবে খ্যাত করন জোহর। এই সেই করন জোহর যিনি শাহরুখ খানকে ভারতের গ্লোবাল আইকন বানানোর দায়িত্ব নেন পরবর্তীকালে।

করন জোহরের বাবা যশ জোহর বলিউডের একজন প্রোডাকশন কন্ট্রোলার ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ধর্ম প্রোডাকশন নামে নিজের মালিকানায় একটি প্রযোজনা সংস্থা খোলেন।

করন জোহর সবসময় মায়ের সংস্পর্শে বড় হয়েছেন। তাঁর মা কখনোই হিন্দি সিনেমাকে পছন্দ করতেন না। যশ চোপড়া ফ্যামিলির সাথে বন্ধুত্ব ছিলো করনের ফ্যামিলির। হলিউডের সিনেমা দেখতে ভালোবাসতেন করন। করন জোহর স্বীকারও করেছেন যে-যশ চোপড়ার দুই ছেলে আদিত্য চোপড়া ও উদয় চোপড়াদের সাথে বন্ধুত্ব জমে উঠতে পারেনি, কারণ তারা হিন্দি সিনেমা নিয়ে সবসময় কথা বলতেন। হিন্দি সিনেমা নিয়ে করনের কোনো আগ্রহ ছিলো না।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে করন একটু একটু করে হিন্দি সিনেমা দেখা শুরু করেন। তবুও তিনি বাবার সাথে প্রযোজনা ব্যবসায় নামেননি। পড়াশুনা শেষ করে তিনি প্যারিসে যেতে চেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। কিন্তু ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে এক প্রাইভেট পার্টিতে আদিত্য চোপড়ার সাথে দেখা হয়ে যায় করনের।

আদিত্য তখন তার স্বপ্নের প্রজেক্ট ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ নিয়ে ব্যস্ত। আদিত্য চোপড়া ও করন জোহর দুজনই দুই বিপরীতমুখী চরিত্রের লোক। আদিত্য চোপড়া চরমভাবে অন্তর্মুখী, একগুঁয়ে ও ব্যকরণসিদ্ধ লোক। করন জোহর বন্ধুবৎসল ও সবার সাথে খোলামনে মিশতে পারেন। আদিত্য চোপড়ার অনুরোধে করন জোহর ‘দিলওয়ালে..জায়েঙ্গে’ মুভিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করতে রাজি হন। প্যারিস যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দেন তিনি। শর্ত একটাই-করন জোহর শুধুমাত্র পোশাক ডিজাইন তথা কস্টিউমের ব্যাপারটি দেখবেন।

তারপর বাকিটুকু ইতিহাস। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ মুভিটি মুক্তি পাওয়ার পর এর সাফল্য দেখে করন নিজেই সিনেমা পরিচালনায় হাত দিতে চান। কিন্তু করন জোহর চিন্তা করলেন একটু অন্যভাবে। তিনিই বলিউডকে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রথম সার্থক চিন্তা করলেন।

করন জোহর তার নির্মিত প্রথম ছবি ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ ছবির পোশাক নির্ধারণের জন্য তার ডিজাইনার বন্ধু মনীশ মালহোত্রাকে সাথে নিয়ে লন্ডনে উড়ে যান। বলিউডি সিনেমার পোশাকের ব্যাপারটিকে আন্তর্জাতিকীকরণের ব্যাপারে করনের ভূমিকা অপরিসীম।

কুচ কুচ হোতা হ্যায় মুভিতে তিনি রাহুলকে (শাহরুখ) তিনি Gap এর polo sport পরান। অঞ্জলিকে (কাজল) ডিকেএনওয়াই ট্রাকস্যুট পড়ে বাস্কেটবল খেলতে দেখা যায়।

এই ছবিতে শাহরুখ কলেজ ছাত্রের ভূমিকাতেও দুর্দান্ত অভিনয় করেন। He is so cool.  শাহরুখ একটা নেকলেস পড়েন যাতেও লেখা ছিলো C-o-o-l. করন জোহর ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ মুভিতে সহকারী পরিচালনা করেছেন, ১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত যশ চোপড়া পরিচালিত ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ মুভিতে শাহরুখ খানের পোশাক নির্ধারণের কাজটি তিনিই করেছেন। তাই তিনি শাহরুখকে ভালোমতোই চিনে ফেলেছেন ততদিনে। ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ মুভিতে শাহরুখের পোশাক নির্ধারণের ব্যাপারটি তিনি আর মনীশ মালহোত্রা মিলে নতুন একটা স্টাইল তৈরি করেন।

সে প্রচেষ্ট সফল। ১৯৯৮ সালের অক্টোবরের ১৬ তারিখ দিওয়ালিতে মুক্তি পায় ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’। সুপার ডুপার হিট হয় করন জোহর পরিচালিত প্রথম মুভিটি। বিশ্বব্যাপী সিনেমাটির ব্যাপক প্রসার হিন্দি মুভির জগৎটাকে পুরোপুরি আন্তর্জাতিক করে তোলে।

বিশ্ববাজারে হিন্দি সিনেমা

পশ্চিমের সিনেমাবোদ্ধারা হিন্দি সিনেমাকে কখনোই সুনজরে দেখেননি। নাচ-গান, আর উদ্ভট কাহিনির মিশ্রণকেই তারা বুঝত হিন্দি সিনেমা। কিন্তু করন জোহর চিন্তা করলেন সারা পৃথিবীতে কম হলেও তখনকার সময়ে প্রায় ছয় কোটির বেশি ভারতীয় বসবাস করে। তাদের মনে যদি নস্টালজিয়া জাগিয়ে হিন্দি সিনেমা নির্মাণ করা হয়, তাহলে তারা যেমন হিন্দি সিনেমা দেখবে, ঠিক তেমনি সাদা চামড়ার মানুষেরাও এ ব্যাপারে উৎসাহী হবে।

১৯৯৭ সালে যশরাজ ফিল্মস প্রথম লন্ডনে তাদের শাখা অফিস স্থাপন করে। সে বছরই যশরাজ ফিল্মসের ব্যানারে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ মুক্তি পায় বৃটেনে। ১০ লাখ পাউন্ড আয় করে তখনকার সময়ে।

পরের বছর যশরাজ ফিল্মস আমেরিকাতেও তাদের শাখা খোলে। করন জোহরের ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ প্রায় ৭০ লাখ পাউন্ড ব্যবসা করে পাশ্চাত্য দুনিয়ায়। এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে আদিত্য চোপড়া-করন জোহরের মিলিত প্রচেষ্টায়। ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ বৃটেনের টপ চার্টের ১০ এর মধ্যে চলে আসে। আরও অবাক করা তথ্য হলো-দক্ষিণ আফ্রিকাতে ‘টাইটানিক’ কে পিছনে ফেলে দিয়েছিল শাহরুখ খানের ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’।

ভারতের বাইরে হিন্দি সিনেমার বাজারকে এভাবে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের কায়দায় চাঙ্গা করে তোলেন আদিত্য চোপড়া-করন জোহর জুটি। আর তাদের এই ব্যবসায়িক বুদ্ধির প্রধান অস্ত্র ছিলেন শাহরুখ খান। অন্য দুই খান (সালমান-আমির) এই সুবিধাটুকু পায়নি।

শাহরুখের সমসাময়িক সব তারকাই ছিলেন যোজন যোজন পিছনে। তাই শাহরুখ খানের তারকাখ্যাতি হলিউড সুপারস্টারদের সমকক্ষ হয়ে পড়ে ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ মুক্তি পাওয়ার পরই। বলা যায় ১৯৯৩ সালের দুই মুভি ‘ডর’ ও ‘বাজিগর’ দিয়ে শাহরুখের উত্থান শুরু, আর ১৯৯৫ সালের ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ দিয়ে শাহরুখ সিংহাসন দখল করেন। ১৯৯৮ সালের ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ দিয়ে শাহরুখ সেই সিংহাসন পাকাপোক্ত করেলেন। সারা দুনিয়াতে ভারতের এক নম্বর তারকা হয়ে উঠলেন।

আমির খান যতই হোন ‘পারফেকশনিস্ট’, সালমান খান যতই তার ‘সুগঠিত’ শরীর নিয়ে বলিউড মাত করুন তারা কেউ পাত্তাই পেলেন না। বলিউডের খিলাড়ি খ্যাত অক্ষয় কুমার, বলিউডের ‘ছুপা রুস্তম’ খ্যাত অজয় দেবগন তার মতো পড়ে রইলেন, চতুর্থ খান হয়ে রইলেন সাইফ আলী খান, অন্যসব তারকারাও শাহরুখের উজ্জ্বলতার সামনে ম্লান হয়ে পড়ে রইলেন।

শাহরুখ হয়ে পড়লেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

(চলবে...)

ঢাকাটাইমস/২০নভেম্বর/এআই/ডব্লিউবি