চোখ মেলুন বাঁশির জাদুকর

প্রকাশ | ২০ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:১০ | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:৩৬

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

গানের বায়না আছে দূরের গ্রামে। উকিল মুন্সিকে সেখানে যেতে হবে। ঘরে অসুস্থ স্ত্রী। তার এক মন বলে যাই। আবার প্রিয় সহধর্মিণীর মুখের দিকে তাকালে মন টানে না। বসে থাকতে ইচ্ছে হয় শয্যাপাশে। বয়াতি উকিল মুন্সি কথা দিলে কথার বরখেলাপ করেন না। লোকজন বসে আছে তার অপেক্ষায়। শেষে স্ত্রীর কপালে চুমু খেয়ে উকিল রওনা হলেন গানের আসরে।

অনেক পথ পাড়ি দিয়ে কয়েক দিন পর পৌঁছলেন সেখানে। আসর শুরু হলো। উকিল মুন্সি তখন গানের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছেন আধ্যাত্মিক জগতে। খবর এলো, মুন্সির পরমা স্ত্রী এই জগতের মায়া কাটিয়েছেন। শুনে আসরে হু হু কেঁদে উঠলেন উকিল। চোখ মুছতে মুছতে ছুটলেন বাড়ির পথে। দূরের পথ। পৌঁছতে কয়েক দিন লাগলো। তত দিনে উকিলের জীবনসঙ্গিনীর আপন ঘর পর হয়েছে। আপন হয়েছে মাটির ঘর। কাঁধ থেকে দোতারাটা উঠানে নামিয়ে রেখে ছুটে গেলেন স্ত্রীর কবরের কাছে। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লেন সেখানে। মাটির বিছানায় হাত বুলিয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। গাইলেন, ‘শুয়া চান পাখি আমার/ শুয়া চান পাখি/ আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।/ তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি/ আজি কেন হইলে নীরব মেল দুটি আঁখি রে পাখি/ আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।’ আগে থেকে লেখা ছিল না। গাওয়া হয়নি কখনো। সুরও জানতো না কেউ। পরমা সঙ্গিনীর বিরহে উকিল মুন্সি যা গেয়েছিলেন, তা-ই পরে হৃদয়ে দাগ কেটেছে আমাদের।

গভীর বোধের এই সৃষ্টির গোড়ার কথা বলেছিলেন কিংবদন্তি গীতিকার, কণ্ঠের জাদুকর, বাঁশিবাদক, বাংলা লোকসংগীতের প্রাণপুরুষ বারী সিদ্দিকী। ২০১৫ সালের ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টে। দু বছর আগের কথা। তবু এখনো চোখে ভাসছে সেদিনের ছবি। মঞ্চজুড়ে অন্ধকার। লাখো দর্শক চোখ সেই ঘোরে। হঠাৎ মঞ্চের মাঝ থেকে দ্যুতি ছড়াতে শুরু করল। চেয়ারে বসে আছেন একজন সুসজ্জিত মানুষ। তার চারপাশ থেকে সূর্যের মতো ছড়িয়ে পড়ছে আলোর রেখা। মানুষটি এবার হাতের বাঁশিটা তুলে মুখের কাছে নিলেন। মোহনীয় সুরের জাদুতে থেমে গেছে সব। সুরই আমাদের চিনিয়ে দিল, আলো ছড়ানো মানুষটি আর কেউ নন, বাঁশিকে বশে আনা প্রবাদপুরুষ বারী সিদ্দিকী।

মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বাঁশির সুরে সবাইকে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন জাগতিক সবকিছু। তখন মনে পড়েছিল, শৈশবে পড়া হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার কথা। একসময় মনে হতো, এসবই বুঝি রূপকথা। কিন্তু সেদিন সত্যিই বুঝেছিলাম, বাঁশির সুরে তন্ময় শ্রোতা হয়ে ভুলে থাকা যায় জগতের সব সত্য-মিথ্যা। ভুলে থাকা যায় সব ভালোবাসা-ঘৃণা। মেনে নেয়া যায় সব পাওয়া-না পাওয়া।

বারী সিদ্দিকীর গান আমি হৃদয়ে নিয়েছিলাম অনেক আগেই। আর সেদিনের পর জানলাম, এই গান আমার রক্তে মিশে গেছে। গাইতে না পারলেও গানের কথা আর মনের গভীর থেকে গভীরে ছুঁয়ে দেয়া কথাগুলো বর্ণমালায় গেঁথে আছে ভেতরে। এখনো চোখ বন্ধ করে বারী সিদ্দিকীর গান শুনলে মনে হয়, এই জগতে যদি সত্যিই কোনো সাধনা থাকে, সাধনায় যদি সুখ থাকে, সুখের যদি স্বর্গ থাকে তাহলে লোকসংগীতের বিকল্প নেই।

১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলায় নেয়া শিশুটিকে দেখে মা-বাবাও বুঝতে পারেননি একসময় কোটি মানুষের হৃদয় জয় করবেন তিনি। সংগীতকে বশে এনেছিলেন নিজ যোগ্যতা, দক্ষতায়। কীভাবে ভেতরে ধারণ করতে হয় সংগীত, লালন করতে হয় পরম ভালোবাসায় বারী সিদ্দিকী জীবনভর সেই পাঠশালার গুরু হয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের দরদি সুর শুনেছি তার বাঁশিতেই। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম লীলায় মজেছেন তিনি নিজেই। এতটুকু ছন্দপতন হয়নি কোথাও। জাগতিক প্রেমের ঐশ^রিকবোধ তিনি বাঁশরির সুরে ছড়িয়েছেন মানুষের হৃদয়ে।

গ্রামীণ লোকসংগীত ও আধ্যাত্মিক ধারার গানের সম্রাটের পরিবারের অন্যরাও গান করতেন। তাদের কাছেই শৈশবে কণ্ঠে তোলেন সুর। মাত্র ১২ বছর বয়সে নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের কাছে তার আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। একবার এক গানের সভায় ওস্তাদ আমিনুর রহমান বারী সিদ্দিকীর গান শোনেন। ওস্তাদের মনে ধরে। প্রস্তাব দিলেন, তিনি তাকে গান শেখাতে চান। বারী অমত করেননি। পরের ছয় বছর প্রশিক্ষণ নেন আমিনুর রহমানের কাছে। ওস্তাদ দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ অসংখ্য গুণী শিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য পান বারী।

সত্তরের দশকে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাথে যুক্ত হন। ওস্তাদ গোপাল দত্তের পরামর্শে ক্লাসিক্যাল মিউজিরে ওপর পড়াশোনা শুরু করেন। পরে বাঁশির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন ও বাঁশির ওপর উচ্চাঙ্গ সংগীতে প্রশিক্ষণ নেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে গিয়ে প-িত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন। দেশে ফিরে লোকগীতির সঙ্গে ক্লাসিক মিউজিকের সম্মিলনে গান গাওয়া শুরু করেন।

কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে নব্বইয়ের দশকে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছান এ শিল্পী। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে বারী সিদ্দিকী এই নির্মাতার ‘রঙের বাড়ই’ নামের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে প্রথম সংগীত পরিবেশন করেন। এরপর ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় নির্মিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে ছয়টি গানে কণ্ঠ দেন। এর মধ্যে ‘শুয়া চান পাখি’ গানটির জন্য তিনি অতিদ্রুত ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তিনি অংশ নেন। একক গানের পাশাপাশি বারী সিদ্দিকী বেশকিছু চলচ্চিত্রেও কণ্ঠ দিয়েছেন।

বারী সিদ্দিকীর হৃদয়ছোঁয়া গানের অভাব নেই। এর মধ্যে-‘পুবালি বাতাসে’, ‘রজনী হইস না অবসান’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘ওলো ভাবিজান নাউ বাওয়া’ এবং ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো’ ইত্যাদি।

দুই.
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গানের মানুষ বারী সিদ্দিকী। গত দুদিন ঘুমের ঘোরে আছেন। এই লেখা যখন লিখছি, তখনও তার ঘুম ভাঙেনি। তার ছেলে সাব্বির সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আস্তে আস্তে বাবার শারীরিক অবস্থা চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে। ডাক্তাররা বলছেন, এখন দোয়া করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।’

গত ১৭ নভেম্বর রাতে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, শুরু থেকেই তাকে রাখা হয়েছে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ)। হৃদরোগ ছাড়াও তিনি কিডনির জটিলতায় ভুগছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

তিন.
মাটির মানুষের ডাক কি আর শুনতে পাবেন না বারী সিদ্দিকী? অকৃত্রিম ভালোবাসার স্পর্শ কি আর পাবেন না তিনি? এভাবেই কি হারিয়ে যাবেন দু চোখ ভিজিয়ে? চেয়ে দেখুন, কত চকচকে চোখ আপনার অপেক্ষায়। ফিরে আসুন প্রিয় বারী সিদ্দিকী। ফিরে আসুন বাঁশরি হাতে। আপনার বাঁশির মন্ত্রমুগ্ধ সুরে জগতের সব সুখ-দুঃখ ভুলে যেতে চাই। আপনি তো আমাদের হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা। এভাবে চলে যাবেন না। এভাবে চলে যেতে নেই।  

(ঢাকাটাইমস/২০নভেম্বর/মোআ)