কয়েন নিতে কেন এত অনীহা?
সিগারেট কিনে এক টাকার ভাংতি শেষ কবে পেয়েছিলেন মনে আছে? এক টাকার কয়েনের বদলে আপনাকে একটা চকলেট ধরিয়ে দিয়ে মুচকি হেসেছিলো দোকানদার। আপনি হয়তো চাননি, তবু নিয়েছেন। কখনও যদি মুখ ফসকে বলেও ফেলেন এক টাকা কই? দোকানদার বলবে ভাংতি এক টাকাতো পাওয়া যায় না। অথচ সদর ঘাটের কুলি বাবুল, কিংবা গাবতলির হকার সিদ্দিক, ৫ টাকা, ২ টাকা কিংবা ১ টাকার কয়েন দেখলেই সাথে সাথে ভ্রু কুচকে ফেলে। এমনকি আপনি যে মহল্লায় থাকেন, সেখানকার মুদি দোকানে গিয়ে চাইলে যাচাই করে দেখতে পারেন। কয়েন দিলে চট করে নিতে চাইবেনা। এদের কয়েন টাকা দেওয়া এক রকম অলিখিত অপরাধ।
সরকার সমান তালে বিনিময়ের জন্য টাকার পাশাপাশি কয়েন ছাড়ে, অথচ কয়েন লেনদেন করতে গেলেই দেখবেন সেটা বেশ কঠিন একটা কাজ। আবার যারা কয়েন লেনদেন করেন, তাদেরও এন্তার অভিযোগ এ নিয়ে।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার দোকানির সাথে কথা বলে জানা যায়, যারা কয়েন নেন, তাদের ভোগান্তি পোহাতে হয় অনেক। এমনকি তাদের অভিযোগ, দেশের কোথাও কোথাও তো কয়েনকে অর্থ হিসেবে গণ্যই করা হয় না।
কিন্তু কেন?
দুর্জনেরা বলছেন এ অবস্থার জন্ম নিয়েছে ২০১৫ সালের শেষ দিকে, "বাংলাদেশ কয়েন সংশোধন বিল ২০১৫" পাশের আগে কয়েকজন সংসদ সদস্যের সংশোধনী প্রস্তাবের জবাব দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, বাংলাদেশে কয়েন টাকা আছে, তা তার জানা নেই। অর্থমন্ত্রীর ভাষণে মুখ ফসকে বলা সেই বক্তব্যের পর থেকেই নাকি বিপত্তির শুরু। একজন দুজন প্রথমে নিতে চায়নি, তারপর সেটা ছড়াতে ছড়াতে মেলা দূর গড়িয়ে এখন বাজারে কয়েন প্রায় অচল।
তবে শুধু ক্রেতা নয়, বিক্রেতাদেরও এ নিয়ে রয়েছে এন্তার অভিযোগ। দৈনিক শ-দেড়শ টাকার কয়েন জমে মোহাম্মাদপুর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন চায়ের দোকানদার মো. জুলহাসের চায়ের দোকানে। ক্রেতা কয়েন দিয়ে যায়, কিন্তু সে দিতে চাইলে তখন আর নিতে চায় না। জুলহাস কয়েনের এ বোঝা চাপায় বেকারির উপর। সেটা কি রকম? বেকারির বাধা কাস্টমার সে। তাকে সাপ্লাই না দিয়ে উপায় নেই তাদের। আবার দাম দিতে হয় নগদ নগদ। তাই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হলো তাদের হাতে কয়েন গছিয়ে দেয়া। নগদ নারায়নের লোভে বেকারিওয়ালারা সেই কয়েন নিয়েও নেয়।
এদিকে বেকারির মালিকদের আবার অন্যরকম ভোগান্তি। এই কয়েনকে টাকায় পাল্টাতে হলে তাদের দিতে হয় “বাট্টা”। বাট্টা হলো একধরনের কমিশন। মানে কয়েনকে টাকায় পাল্টানোর জন্য দিতে হয় কমিশন। এলাকা ভেদে বেকারিওয়ালারা পাঁচ টাকার প্রতি হাজার কয়েনে ১০০ টাকা এবং এক ও দুই টাকার প্রতি হাজার কয়েনে ১৫০ টাকা হারে বাট্টা গোনে।
কয়েন নিয়ে ব্যবসার এমন জটিলতা নিয়ে মোহাম্মাদপুরের রনি বেকারির সহকারী ম্যানেজার মো. শফিক হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, "আমাদের ব্যবসা মূলত চায়ের দোকানকেন্দ্রিক। আমরা তো অন্যসব কোম্পানির মত না। আমাদের হকাররা যেসব দোকানে মাল দেয়, সেসব দোকানে প্রচুর কয়েন টাকা জমে। দোকানদার হকারদের দেয় আর হকাররা আমাদের। আমাদেরও বাধ্য হতে নিতে হয়। আমরা কয়েনগুলো ডিমওয়ালাদের দিয়ে দেই।"
অথচ ধাতব মুদ্রার এমন অচল অবস্থাকে অর্থের অবমূল্যায়ন কিনা সেটা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও একে অবমূল্যায়ন বলে মানতে নারাজ তারা। আর কয়েন নিয়ে যারা বিভ্রান্তি ও গুজব ছড়াচ্ছেন, কিংবা কয়েন দিয়ে লেনদেনে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন কিংবা কয়েন নিয়ে ব্যবসায় মেতেছেন, তারা সকলেই বেআইনি কাজ করছেন বলে জানালেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, "দেশে এক টাকা, দুই টাকা ও পাঁচ টাকার যে কয়েন প্রচলিত আছে, সেগুলো সরকারি মুদ্রা। কিছু মানুষ কয়েনের ব্যাপারে অহেতুক গুজব ছড়িয়েছে। এ কারণে কেউ কেউ কয়েন না নেয়ার কথা বলে থাকতে পারে। কিন্তু যেহেতু এটা সরকারি মুদ্রা, সুতরাং লেনদেনের ক্ষেত্রে একে না বলার বা গ্রহণ না করার কোনো সুযোগ নেই। সারা পৃথিবীতেই নোটের পাশাপাশি কয়েন আছে। আর কয়েন দিয়েই সঠিকভাবে লেনদেন করতে হয়। আমাদেরকেও সেটাই করতে হবে। আমি কয়েন নেব না- একথা বলা এক অর্থে বেআইনি। কয়েন চালু আছে এবং সরকারি ভাবেই চালু আছে। এটা নিয়ে বিভ্রান্ত হবার কোনো সুযোগই নেই।"
ঢাকাটাইমস/২২নভেম্বর/কারই/কেএস