অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৪৭

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ২২ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:২০

কাজী বাবুল ইস্যুতে আমার উপর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইনের বিরক্তি চূড়ান্ত রূপ নিলো পূবালী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমাকে জড়িত করতে না পারায়। এ বিষয়ে আলাপকালে আমি বলেছিলাম, ‘আমার দায়িত্ব পত্রিকা চালানো; এর বাইরে কোন কাজে আমি নাই। সাংবাদিকতার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে অন্য কাজে যাবো না!’ নিশ্চয়ই আমার এ বক্তব্য মোয়াজ্জেম সাহেবের ভালো লাগেনি, লাগার আশাও করিনি। কিন্তু তাই বলে তিনি থেমে থাকেননি।

পূবালী ব্যাংকের মালিকদের বিরোধের খেলায় আমাকে ব্যবহার করতে না পারায় সৈয়দ মোয়াজ্জেম বিকল্প হিসেবে বেছে নেন মাসুদ কামালকে। তার মাধ্যমে শেখ মহিউদ্দিনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিলো সে সময়ে পূবালী ব্যাংক চেয়ারম্যান ই. এ. চৌধুরীকে সর্বহারা পার্টির নামে ভয় দেখানো। কিন্তু পুলিশের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ই. এ. চৌধুরী ভয় পেয়েছেন বলে কোন খবর জানা যায়নি। বরং বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় উল্টো ঝামেলায় পড়েন সৈয়দ মোয়াজ্জেম। এর পর ই এ চৌধুরীর স্বজনের মৃত্যুতে মোয়াজ্জেম সাহেবেকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি। উচ্চ মহলে কি যে রঙ্গ চলে।

আমার সঙ্গে সুবিধা করতে না পেরে সৈয়দ মোয়াজ্জেম নজর দিলেন মাসুদ কামালের দিকে। ঘনঘন মিটিং করতে লাগলেন, আমি অফিসে থাকাকালে মিটিং-এর ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যেতো। এমনকি মাসুদ কামালকে স্ব-স্ত্রীক আমেরিকা পাঠানোর ব্যবস্থতা করারও আওয়াজ দিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম। পরে মাসুদ কামাল সরকারি ও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আমেরিকায় গেলেও মোয়াজ্জেম সাহেব মাসুদ কামালকে আমেরিকা পাঠাননি অথবা তার ব্যবস্থাপনায় মাসুদ কামাল যেতে রাজি হননি। কিন্তু এ নিয়ে মোয়াজ্জেম সাহেব মোটেই বিরক্ত হননি। কারণ মাসুদ কামালকে ঘিরে একাধিক ভাবনা ছিলো তার। এর মধ্যে প্রধান ছিলো, সুগন্ধা থেকে আমাকে বিদায় করা। কিন্তু প্রধান ইস্যুতে মাসুদ কামাল তাকে এতোটাই হতাশ করেছিলেন যা স্বপ্নেও ভাবেননি সুগন্ধার মালিক শূন্য থেকে ব্যবসায় শীর্ষে ওঠা পিআইএ-এর সাবেক স্টাফ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন।

এক ঈদের দুপুরে বাথরুমে বসে অনেক সময়ধরে টেবিলের কাঁচ ধোয়ার সময় কোমরে সামান্য ব্যথা পাওয়ার পরবর্তী অসাবধানতার জটিলতায় চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে আমাকে বেড রেস্ট নিতে হলো প্রায় একমাস। মানে বিছানায় চিত হয়ে থাকা, অনেকটা চিতিয়ে পড়া তেলাপোকার মতো। এ সময় পুরো দায়িত্ব নিয়ে পত্রিকার হাল ধরেছিলেন মাসুদ কামাল। আমার জানামতে, নির্মোহ লিডার হিসেবে মাসুদ কামাল ইউনিক। টিমের অন্যেরাও কাজে অধিক মনোযোগী হয়েছিল। এর উপর সকলের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো টেলিফোনে; বাসায়ও আসতেন সহকর্মীরা। সব মিলিয়ে আমার অনুপস্থিতি পত্রিকায় দৃশ্যমান কোন ক্ষতি হয়নি। এ বিষয়টিকেই দুয়েদুয়ে চার মিলিয়ে ভুল অংক করে বসলেন প্রথম প্রজম্মের ব্যবসায়ী সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন। তিনি তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বললেন, ‘এবার আলম রায়হানকে বাদ দিলে পত্রিকার আর কোন ক্ষতি হবে না।’ বিষয়টি সৈয়দ মোয়াজ্জেমের ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি টেলিফোনে আমাকে জানিয়েছিলেন তার রুম থেকে বেরিয়েই। কেন গোপন কথা ফাঁস করছেন- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমি চাই না পত্রিকা ক্ষতিগ্রস্ত হোক; আপনি না থাকলে পত্রিকা টিকবে না, এক সময় বন্ধ হয়ে যাবে।” মোয়াজ্জেম সাহেবের এ বন্ধুটি একাধিক প্রজম্মের ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান।

এর আগেই আমিও টের পাচ্ছিলাম, মোয়াজ্জেম সাহেব চাচ্ছিলেন না আমি সুগন্ধায় থাকি। কিন্তু এ নিয়ে আমার কোন উদ্বেগ ছিলো না। কেননা মালিক না চাইলে জোর করে প্রেম করার মতো সেখানে থাকার প্রবৃত্তি আমার কখনো ছিলো না, এখনো নেই।

কিছুটা সুস্থ হবার পর অফিসে গিয়ে সৈয়দ মোয়াজ্জেমকে বললাম, ‘আমি আরো কিছু দিন রেস্টে থাকতে চাই।’ আমার কথা শুনে সে এতোটাই খুশি হয়েছিল যেনো মেঘে ঢাকা আকাশে এক কিশোর হঠাৎ ঈদের চাঁদ দেখেছে। তিনি বললেন, “এক কাজ করেন, সিলেটে আমার বন্ধুর চা বাগান আছে; সেখানে রেস্ট হাউজে গিয়ে থাকেন; আমি বলে দিচ্ছি।” এই বলে তিনি ফোন তুললেন। আমি তার উৎসাহের রাশ টেনে ধরে বললাম, ‘সিলেটের চা বাগানের রেস্টহাউজে যেতে হবে না; উত্তরায় বাসায় রেস্ট নিলেই হবে।’ তার রুম থেকে বেরিয়ে দেখি নঈম নিজাম বসা। আমি আবার মোয়াজ্জেম সাহেবের রুমে ঢুকলাম। বললাম, নঈম নিজাম এসেছে। তিনি বললেন, “আমি আসতে বলেছি, পাঠিয়ে দেন।’

সুগন্ধা অফিস থেকে যখন বিদায় নেই তখন গোধূলি লগ্ন। মোয়াজ্জেম সাহেব তার গাড়িতে করে আমাকে উত্তরায় বাসায় পৌঁছে দিলেন প্রচণ্ড আগ্রহে; লাশ গায়েবের সময় যেমন করা হয়।

পরদিন সুগন্ধার মালিক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন অফিসে এলেন ফুরফুরা মেজাজে। এতোদিনের ব্লুপ্রিন্ট নিয়ে ঝেড়ে কাশলেন তিনি। আমাকে না রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে মাসুদ কামালকে পত্রিকার দায়িত্ব নিতে বললেন। কিন্তু জবাব শুনে খুবই হতাশ হয়েছিলেন। কোন রকম গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই মাসুদ কামাল তার অসম্মতি জানান। কিন্তু হার মানতে রাজি নন মালিক। তিনি অনেক কিছু বুঝাবার চেষ্টা করলেন। জবাবে মাসুদ কামাল বললেন, “আলম ভাই না থাকলে আমি এক মুহুর্তও থাকবো না; তা ছাড়া আমাকে এমনিতেই সুগন্ধা ছাড়তে হবে। কারণ, আমি জনকন্ঠে জয়েন করেছি।”

মাসুদ কামাল এক কথার লোক- এটি সৈয়দ মোয়াজ্জেম আগে থেকেই কমবেশি জানতেন। কাজেই তিনি কথা বাড়াবার উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন।

এ ঘটনার পর মাসুদ কামাল দ্রুত সুগন্ধা ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিলো, জনকন্ঠের পাশাপাশি সুগন্ধায়ও কাজ করবেন আগের মতোই।

জনকন্ঠে মাসুদ কামালের যোগদানের প্রথম প্রস্তাব ছিলো ডেক্সে। আমি বলেছিলাম, ‘রিপোর্টি-এ হলে যাবেন, তা না হলে না।’ কারণ আগের মতোই আমি এখনও মনে করি, সাংবাদিকতার শুরুর দিকে রিপোটিংয়ে এবং নানান বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিয়ে ডেক্সে বসা উচিত। তা না হলে পিরামিড উল্টে দেবার মতো অবস্থা দাঁড়াবার আশঙ্কা থাকে।

ডেক্সের পরিবর্তে রিপোর্টিংয়ে যোগ দেবার ক্ষেত্রে আমার যুক্তি মনপুত হলেও আর এক সমস্য দেখা দিলো। তা হলো বেতন। সূচনা লগ্নে দৈনিক জনকন্ঠে সাংবাদিকদের যে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছিল তাতে মাসুদ কামালের বেতন দাঁড়ালো সাপ্তাহিক সুগন্ধার চেয়েও কম; প্রায় অর্ধেক। বেতন প্রশ্নে জনকন্ঠে যোগদানের বিষয়ে মাসুদ কামালের এক ধরনের দ্বিধা ছিলো। আমি বললাম, ‘বেতনের এই নচ্ছার কাঠামো থাকবে না। বোরহান আহমেদ পত্রিকার বাজেট ও লক্ষ্য না বুঝেই ফকিরেরপুলের স্টালে বেতন নির্ধারণ করেছেন। এভাবে পত্রিকা হবে না; এটি মালিক ঠিকই বুঝবেন এবং কান্ডারির পদে বোরহান আহমেদ থাকবেন না। নতুন কান্ডারি আসবে, তখন বেতন কাঠামো বদলে যাবে।’ বাস্তবে হয়েছিলো তাই।

মাসুদ কামাল এক কথায় প্রস্তাব নাকচ করায় সৈয়দ মোয়াজ্জেম আবার আমার উপর ভর করলেন। আমি ফিরলাম; তবে এবার আর থাকার জন্য নয়, যাবার জন্য। এদিকে মোয়াজ্জেম সাহেব অনেকটাই মনমরা হয়ে গেলেন। রক্ষিতার রংমহলে ঠাঁই না পেয়ে নিজের ঘরে ফেরা পুরুষের মতো অবস্থা দাঁড়লো তার। তিনি আমাকে বাদ দেবার পরিকল্পনা ধেকে খুব একটা সরেননি। এ অবস্থায় মাস খানেক চালিয়ে দেখলাম, সুগন্ধা আমার নয়; “এ শহর আমার নয়” গানের মতো।

মোয়াজ্জেম সাহেবকে বললাম, ‘আমি আর কাজ করবো না।’ আমার কথা শুনে তিনি কাতরভাবে বললেন, “তা হলে একজন লোক খুঁজে দেন।’ তালাক দেয়া স্ত্রীর কাছে দ্বিতীয় বিয়ের কনে খুঁজে দেবার আবদার আরকি।

সৈয়দ মোয়াজ্জেমের উপর আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। এরপরও আমি চাচ্ছিলাম পত্রিকাটি টিকে থাকুক। সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত থাকা প্রতিষ্ঠানটির ধ্বংস আমি মানতে পারছিলাম না। যে কারণে আমি মোয়াজ্জেম সাহেবের আবদার নাকচ করে দেইনি। বাইরের কাউকে খোঁজার কথাও চিন্তা করিনি। কারণ একটি চালু পত্রিকার কাণ্ডারি হবার মতো লোক চাইলেই পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও পরিস্থিতি বুঝতে বুঝতে পত্রিকার যে ধস নামে সেখান থেকে টেনে তোলা মোটেই সহজ নয়। এসব বিবেচনায় বললাম, মোস্তফা কামালকে দায়িত্ব দেন। সৈয়দ মোয়াজ্জেম বললেন, “দূরো সাহেব, এইডা তো ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চারও অধম, ছাগল দিয়ে কি হাল চাষ হয়।’ আমি বললাম, ‘আপনার কথা ঠিক না। আর পত্রিকা টিকিয়ে রাখতে হলে হাতের কাছে মোস্তফা কামালের বিকল্প আছে বলে আমার মনে হয় না।’ তিনি বললেন, দেখি...।

শেষতক আমার কথাই রাখলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম; সুগন্ধার কাণ্ডারি হিসেবে তিনি মোস্তফা কামালকেই নিলেন। নিজের বিবেচনায় মহিরুহু সাংবাদিক নেবার ঝুঁকির পথে হাটেননি। হয় তো ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার খায়রুল আনামকে দিয়ে প্রথম এক বছর পত্রিকা চালাবার তিক্ত অভিজ্ঞতা তাকে প্রভাবিত করেছিল। এদিকে অতি বাস্তবাদী মোস্তফা কামাল ছাপার জন্য প্রস্তুত করে প্রেসে পাঠানো ছাড়া পত্রিকার আর কোন দায়িত্ব নেননি। অন্যসব দায়িত্ব নিতে হলো সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইনকে। এতে তিনি প্রথম দিকে বেশ পুলক বোধ করছিলেন। বিবাহিত পুরুষের প্রথম ছয় মাসের মতো। মাস তিনেকের মাথায় একদিন বঙ্গভবনে দেখা হলে কুশল বিনিময়ের ফাঁকে আমাকে বলেছিলেন, “আলম রায়হান, আপনার আমলে অনেক চাপ মনে হতো; এখন আর কোন চাপ মনে হয় না।” আমি বললাম, ‘বোঝা নিজের মাথায় থাকলে ঘার মটকানোর আগ পর্যন্ত এমনই হয়।’

আমার কথার অর্থ পুরোটাই বুঝতে পেরেছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম। কুলির বদলে নিজের বোঝা বহন করার বিরূপ প্রভাব হোক বা অন্য যে কারণেই হোক; ছয় মাসের মধ্যেই সৈয়দ মোয়াজ্জেম ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু একদিন বাসায় ফোন করে বললেন, ‘মোয়াজ্জেম সাহেব তো আপনাকে আবার তার পাশে চায়।’ আমি বললাম, ‘আমি সব সময়ই স্যারের পাশে আছি; কারণ একবার মালিক তো চিরকালের মালিক।’ উল্লেখিত বন্ধুটি বললেন, “তা হলে কবে জয়েন করবেন?” আমি বললাম, ‘কখনো না!’

আমার বিদায়ের পর এক বছরের মধ্যে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন সুগন্ধার প্রকাশনা বন্ধ করে দিলেন। আর ‘চাপহীন’ তার নিজের পরিচালনার এক বছরে লোকসান হয়েছিলো পাঁচ লাখ টাকার বেশি; পত্রিকার অবস্থা হয়েছিলো উল্টো রথে চলার মতো। বছর খানেক বন্ধ রাখার পর এক পর্যায়ে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ দশায় পত্রিকার মালিকানা ছেড়ে দেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন। এরপর শুরু হয় উপকারি বন্ধু আবদুস সাত্তার মিয়াজী, মেধাবি সহকর্মী সন্তোষ শর্মা ও অতি সাধারণ এই অধমের যৌথ মালিকানায় সাপ্তাহিক সুগন্ধার দ্বিতীয় যাত্রা।

আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :