নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন শ্রমিকদের অনিশ্চিত জীবন

ইমতিয়াজ উল ইসলাম, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:২১ | প্রকাশিত : ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:১২

পাঁচ বছর আগে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন থেকে প্রাণে বাঁচলেও জীবনের চাকা অনেকটাই থমকে গেছে খোরশেদ আলম রবিন ও তার স্ত্রীর।

ঘটনাটি ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাতের। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসে কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজ করতেন রবিন। তার ছয় মাসের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ফাতেমা আক্তারও তার সঙ্গেই একই কারখানার কর্মী। নিচতলায় আগুনের কথা জেনে বাঁচার আশায় পঞ্চম তলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন দুই জন। এরপর থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন রবিন ও তার স্ত্রী। এখনও পর্যন্ত কোনো কাজ করতে পারেন না এই দম্পতি।

আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের ওই পোশাক কারখানায় আগুনে পুড়ে নিহত হন প্রায় ১১২ জন। আহত হন আরো কয়েকশ শ্রমিক। পোশাক কারখানায় যে কয়েকটি প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে তাজরীন অন্যতম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় যেভাবে ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা মেলে, তাজরীনের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে মেলেনি সেভাবে। ফলে প্রাণে বেঁচে যাওয়া, বিশেষ করে অঙ্গহারা শ্রমিকদের অবস্থা এখন শোচনীয় হয়ে পড়েছে। বহু শ্রমিকের চিকিৎসা হয়নি সেখানে। শরীরের ক্ষতেরই যেখানে উপসম হয়নি, সেখানে মানসিক আঘাতের চিকিৎসা হওয়া সুদূর পরাহত।

পরিবারের চার ভাই বোনের মধ্যে ছোট রবিন এসএসসি পাস করেই সংসারের আর্থিক স্বচ্ছলতার খোঁজে কাজ নিয়েছিলেন পোশাক কারখানায়। কিন্তু তাজরীন ফ্যাশনসের আগুন তার পরিবারকে অথৈ সাগরে ফেলে দিয়েছে।

রবিনের মতো তাজরিনের আরো কয়েকশ আহত শ্রমিক গত পাঁচ বছর ধরে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অভাবে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছেন। কিন্তু মোট কত শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকার, বিজিএমই ও মালিকপক্ষের কাছে নেই।

সেদিনের সেই আগুনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ঢাকাটাইমসকে রবিন বলেন, ফায়ার অ্যালার্ম বাজার পরেই শ্রমিকদের চিৎকার শুনে তিনি দৌড়ে পঞ্চম তলার স্যাম্পল কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। ততক্ষণে চারদিক কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারের সাথে উটকো গন্ধে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় তার।

এই অবস্থায় চতুর্থ তলায় কর্মরত ছয় মাসের সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে খুঁজতে নিচে নেমে আসেন রবিন। কিন্তু ধোঁয়ার কারণে সেখানে থাকতে না পেরে স্ত্রীকে ছাড়াই আবার পঞ্চম তলায় ওঠেন। এরপর জীবন বাঁচাতেই স্যাম্পল রুমের জানালা ভেঙে পাঁচ তলা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েন পাশের ভবনের ছাদে। দীর্ঘক্ষণ অচেতন থাকার পর পাশে স্ত্রীকে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। পরে সেখান থেকে তাদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

রবিন বলেন, এখন অর্থাভাবে নিয়মিত খাবার জোগাড়ই হয়ে পড়েছে কঠিন। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। সন্তানের শিক্ষা, নিজের কাজ না থাকা সব মিলিয়ে এক অনিশ্চিত জীবনের অন্ধকার গহ্বরে পতিত হন তিনি।

শারীরিক সমস্যাগুলোও দিন দিন বাড়ছে। সবশেষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন রবিন। জটিলতর পর্যায়ে থাকায় উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু টাকা নেই বলে এখন মৃত্যুর অপেক্ষায় তাজরীনের সাবেক এই শ্রমিক।

দুর্ঘটনার পর একেবারেই যে আর্থিক সহায়তা মেলেনি, তা নয়। তাজরিন ক্লেইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কমিটির পক্ষ থেকে আড়াই লাখ টাকা পেয়েছেন রবিন। তবে এরপর সরকার বা পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা মেলেনি।

তাজরীনেরই আরেক সাবেক কর্মী আঞ্জুয়ারা বেগম। কারখানার পঞ্চম তলায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতেন তিনি। আগুন থেকে বাঁচতে তিনিও পাঁচ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন পাশের ভবনের ছাদে। কিন্তু সেখানে থাকা একটি লোহার টুকরো ডান পায়ে বিধে যায়। সেই যন্ত্রণার উপসম হয়নি এখনও। যে টাকা সহায়তা পেয়েছিলেন তা দিয়ে চিকিৎসা, খাওয়া, ঘড় ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন বলেও জানান আঞ্জুয়ারা।

স্বজনহারার বেদনা ও দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে দিনযাপন করছেন রংপুরের সাথী খাতুন। তাজরীনের তৃতীয় তলায় লাইন-বি সেকশনের অপারেটর ছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন স্বামী উজ্জ্বল হোসেন, ছোট ভাই সবুজ ও তার স্ত্রী আছমাও। সেদিন কারখানায় গিয়েছিলেন চার জন, ঘরে ফিরেছেন তিন জন। ভাইয়ের স্ত্রী আছমা মরেছেন আগুনে পুড়ে।

তাজরীনের আগুনে ঝলসে যাওয়া আর পুড়ে যাওয়া মরদেহগুলো এতটাই খারাপ অবস্থায় ছিল যে তাদেরকে শনাক্তও করা যায়নি। আছমার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল একই ঘটনা। তার মরদেহ বা তার কবর কোনটি তা জানতে বিজিএমইএ, কখনও বিভিন্ন এনজিও আবার শ্রমিক সংগঠনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন সাথী ও তার ভাই। একেকবার একেক কাগজ নিয়ে ছুটেছেন। তবে নিরাশ হয়েই ফিরতে হয়েছে বারবার।

দুর্ঘটনায় এক চোখের আলো নিভে গেছে শাহনাজ বেগমের। এখনও ঘুমের মধ্যে জানা দেয় সেই দিনের দুঃসহ স্মৃতি। ঘুমাতে পারেন না শাহনাজ। প্রায় রাতেই আচমকা কেঁদে ওঠেন তিনি। তার মানসিক চিকিৎসা করায়নি কেউ।

কারিতাস নামক একটি এনজিও থেকে প্রতি মাসে চার হাজার টাকা করে অনুদান পাচ্ছেন শাহনাজ। তবে তা দিয়ে চিকিৎসা খরচ দূরের কথা সংসার চালানোই দুরূহ হয়ে পড়েছে।

শাহনাজ, রবিন, আঞ্জুআরা, সাথীদের আক্ষেপ, তাদের জীবনকে বিভীষিকাময় করে দেয়ার জন্য দায়ীদের বিচার হলো না এখনও। তারা জানান, ওইদিন যদি কারখানার জিএম, ম্যানেজার, পিএম পদের কর্মকর্তারা ফায়ার অ্যালার্মের বাজার পর যদি শ্রমিকদের বাইরে বের হতে দিতেন, তাহলে হয়ত এত সংখ্যক শ্রমিক পুড়ে মারা যেত না।

গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিণ্টু ঢাকাটাইমসকে বলেন, সরকার, বিজিএমইএ ও মালিকপক্ষ এখনও পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের সংখ্যা ও আর্থিক সহায়তার পরিমাণ সুস্পষ্ট ভাবে জনসম্মুখে তুলে না ধরায় এ বিষয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও তাজরিন ক্লেইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কমিটির পক্ষ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। তবে এমন অনেকেই আছেন যারা আর্থিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

তাজরীন শ্রমিকদের যে চিকিৎসাসেবা ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলেও অভিযোগ করেন এই শ্রমিক নেতা। পাশাপাশি আহত শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি আজও প্রতিশ্রুতির মধ্যেই আটকে রয়েছে বলে জানান তিনি।

মিণ্টু বলেন, তাজরিনের শ্রমিকদের মধ্যে যারা নানা শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন তাদের জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। এতে করে শ্রমিকরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হবে না।

তাজরীনের আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কী করবেন-এ বিষয়ে চেষ্টা করেও বিজিএমইর পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পরিচালক সানা ছামিনুর রহমান শামীম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তাজরীন ট্র্যাজেডি দেশের ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক ঘটনা। তাই মানবিক দিক বিবেচনায় শ্রমিকদের দাবিগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট অবগত করা হয়েছে। আশা করি দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ এই ঘটনায় করা মামলাটি বিচারাধীন বলেও জানান শামীম।

ঢাকাটাইমস/২৩নভেম্বর/আইইউআই/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :