নদীপাড়ের মানুষ (পর্ব-৬)

অপচিকিৎসার শিকার চরের মানুষেরা

প্রকাশ | ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:১৮ | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:২০

প্রতীক ওমর, বগুড়া

সারিয়াকান্দির দুর্গম চর ধারাবর্ষা। সরদ উপজেলা থেকে পূর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। সদর থেকে দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। প্রত্যন্ত গ্রাম। আধুনিক বাংলাদেশের ছোঁয়া সেখানে এখনো স্পর্শ করেনি। চরের মানুষগুলো অনেকটাই সরল সোজা। নিজেরে ভালো মন্দটাও অনেক সময় বুঝে না। সামাজিকভাবেও তারা সচেতন হয়ে উঠেনি। সচেতন না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। বছরের শুরুতে এক চরে বছরের শেষে অন্য চরে জায়গা হয় তাদের। নদী ভাঙন এর পেছনের কারণ। নদীর সাথে যুদ্ধ করেই ক্লান্ত চরের মানুষগুলো নাগরিক সুবিধার কী সেটাও বোঝে না।

মানুষের মৌলিক চাহিদারগুলোর অন্যতম চিকিৎসা। সেই চিকিৎসা সেবা বরাবরেই বঞ্চিত চরের মানুষগুলো। এখানে জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থাও নেই বললেই চলে। জ্বরের ট্যাবলেট প্যারাসিটামল কিনতে হয় প্রায় ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে। ফলে কবিরাজি চিকিৎসার দিকে ঝুঁকে পড়ে চরের এসব মানুষ। তারা গাছের লতাপাতা শেকড় এবং ঝাড়ফুঁক তাবিজের মাধ্যমেই চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এছাড়াও অল্প শিক্ষিত কিছু পল্লী চিকিৎসক অপচিকিৎসা দিয়ে চরের এসব মানুষের প্রতিনিয়িতই চরম ক্ষতি করছেন।

ফলে যমুনা চর ও নদী তীরবর্তী এলাকার বড় মানুষের পাশাপাশি শিশুরাও স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত। যথার্থ স্বাস্থ্যসেবা না থাকায় বেড়ে উঠছে নানা পুষ্টিহীনতায়। তীরবর্তী এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও তাতে ওষুধ সরবরাহ ঠিকমত থাকে না। আর চরে ক্লিনিক ও চিকিৎসা কেন্দ্র নেই বললেই চলে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তাদের একমাত্র চিকিৎসার জায়গা। সেখানেও পর্যাপ্ত সেবার ব্যবস্থা নেই। ফলে ছোট বেলা থেকেই স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হয়ে বেড়ে উঠছে হাজার হাজার শিশু-কিশোর।

ধারাবর্ষা চরের মতো উত্তরাঞ্চলের জনবসতি পূর্ণ উল্লেখযোগ্য চর হচ্ছে, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, টেংরাকান্দি, গাবগাছি, পারুল, খাটিয়ামারি, গলনা, খোলবাড়ি, সাঘাটা উপজেলার দিগলকান্দি, পাতিলবাড়ি, গুয়াবাড়ি, গাড়ামারা, হরিচন্দ্র, এজেন্ডাবাড়ি, বগুড়ার ধুনটের, বৈশাখী, ভান্ডাবাড়ি, মাঝিরারচর সারিয়াকান্দি উপজেলার ধারাবর্ষা, শংকরপুর, চন্দনবাইশা, চরলক্ষিকোলা, ডাকাতমারিরচর, ইন্দুরমারিরচর, চরকর্নিবাড়ি, তালতলা, বেনুপুর, পাকুরিয়া, চরমানিকদাইর, চরদলিকা, শিমুলতাইড়, চরকালুয়াবাড়ি, চরবিরামেপাচগাছি, নয়াপাড়া, জামথল, চরবাকিয়া, ময়ূরেরচর, চরদেলুয়াবাড়ি, কুড়িপাড়ারচর, চরশালিকা, করমজাপাড়া, টেকামাগুড়ারচর। এসব চর ছড়াও যমুনাপড়েরর আরো অসংখ্য চর আছে।

মূল চিকিৎসা ঝাড়ফুঁক তাবিজ

পেটের ব্যথা, ভেঙে যাওয়া, মচকে যাওয়া, মাথা ঘোরাসহ ছোটখাটো রোগের জন্য ঝাড়ফুঁতেই নির্ভরশীল চরের মানুষ। এর জন্য এলাকার বয়স্ক ইমাম, নামাজি মানুষের দরবারে হাজির হন তারা। এছাড়া চরে কিছু কবিরাজের দৌরাত্ম্য লক্ষ করা যায়। এসব কবিরাজ বিভিন্ন গাছের লতাপাতা শেকড় দিয়ে চিকিৎসা করে থাকেন। যেকোনো রোগের চিকিৎসা করে থাকেন এসব কবিরাজ। এমনকি ক্যানসার, ডায়াবেটিক, জন্ডিসের মতো মারাত্মক রোগও তারা গাছের তৈরি ওষুধ দিয়ে থাকেন। চরের সহজ সরল মানুষগুলো এসব কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিয়ে প্রতিনিয়তই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। কবিরাজদের ঔষধে রোগ বালাই না সারলেও তাদেরকেই বিশ্বাস করতে হয় চরের মানুষদের।

ঝাড়ুপেটা করা হয় প্যারালাইসিস রোগীকে

চরের মানুষ এখনো এতোটাই অসচেতন যে, তাদের কেউ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হলে স্থানীয় কবিরাজকে ডাকা হয়। কবিরাজ মশাই প্রকাশ্যে রোগীকে ঝাড়ু দিয়ে গোটা শরীর পেটাতে থাকে। মাঝে মধ্যে কিছু মন্ত্র পাঠ করে রোগীর শরীরে জোরে ফুঁ-দিয়ে দেয়। এভাবে চিকিৎসা করে অকালে অনেকেই মারাও যায়। তবুও থেমে নেই সনাতনী এসব চিকিৎসা।

জ্বিন ভূতে বিশ্বাস

ভূতে দৃঢ় বিশ্বাস চরের মানুষের। এই বিশ্বাস বেশির ভাগ মহিলাদের মধ্যে বিদ্যমান। বিশেষ করে উঠতি বয়সের কিশোরী, যুবতী, নববিবাহিত নারীর যেকো শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে ভূতে ভর করেছে এই ধারণা প্রবল। এর জন্য ফকিরের ( জ্বিন ভূত যে তাড়ায় তাকে স্থানীয়রা ফকির বলে) শরণাপন্ন হয়ে থাকে। ফকির রোগীর গলায় অথবা হাতে তাজিব বেঁধে দেয়ার পাশাপাশি বাড়ির চার পাশে চারটি বড় আকারের বাঁশ পুতে দেয়। সেই বাঁশেল মাথায় বিশেষভাবে ফুঁ দেয়া মাটির তৈরি কাসা ঝুলে দেয়। এতে ভূত ওই বাড়ির ধারের কাছেও আসতে পারবে না। এমন বিশ্বাস থেকেই চারের প্রায় বাড়িতে এমন মাটির কাসা ঝুলতে দেখা দেয়। 

সন্তান প্রসব বাড়িতেই হয়

এলাকায় ডাক্তার নেই আগেই বলেছি। চিকিৎসার জন্য বহুপথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয় উপজেলা সরদগুলোতে। রাস্তা না থাকায় মুমূর্ষু রোগীদের কাঠের চৌকিতে কাঁধে নিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। চরের এতগুলো মানুষের সেবা দেয়ার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। সারকারি এসব হাসপাতালে বছরের প্রায় সময় ডাক্তারবিহীন চলে। দুই চারজন নার্স এবং সহকারী ডাক্তারে কোনো রকম চলছে এসব হাসপাতালগুলো।

চরের এসব মানুষের কষ্ট বহুগুণ বেড়ে যায় কোনো সন্তানসম্ভবা মায়ের প্রসবব্যথা উঠলে। সেই মুহূর্তে তাদের কোনো কিছুই করার থাকে না। ঘরের অন্য মহিলাদের সেবায় সন্তান জন্ম দিতে হয়। এক্ষেত্রে অধিকাংশ নবজাতক মারাত্মক আহত হয়ে পৃথিবীর আলো দেখেন। মারাও যায় অনেক শিশু এবং মা।

শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার ছাইদুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, চরের মানুষের মধ্যে এখনো কুসংস্কার বিদ্যমান আছে। কবিরাজদের পাশাপাশি চরে কিছু পল্লী চিকিৎসক আছে যারা চিকিৎসার কিছুই না বুঝলেও চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। তাদের অপচিকিৎসার ফলে রোগী দ্রুত আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেন, চরের এসব মানুষকে চিকিৎসা সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন করে তুলতে হবে।

(ঢাকাটাইমস/২৩নভেম্বর/প্রতিনিধি/জেবি)