অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৪৮

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ২২:২৪

মোজাম্মেল ভাইর সফল নেতৃত্বের টিমে চিফ রিপোর্টার হিসেবে যোগদান, এক বছরেরের মাথার তিনি হঠাৎ ছেড়ে দেবার পর কাণ্ডারীর দায়িত্ব প্রাপ্তি এবং অতপর প্রায় পাঁচ বছর পর বিদায় পর্যন্ত অহরনিশ সুগন্ধাই ছিলো আমার ধ্যানজ্ঞান। জাগরণের প্রতিটিক্ষণ সুগন্ধা নিয়ে ভাবতাম। সম্ভবত ভাবতাম নিদ্রার মধ্যেও; না হলে স্বপ্নেও সুগন্ধা দেখতাম কেন! নিজের জন্য ক্ষতিকর এ প্রবনতার ধারার রেশ অব্যাহত ছিলো সুগন্ধার বাইরে আসার পরও। অতীতকে মুছে ফেলতে না পারার কারণে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন সুগন্ধা বন্ধ করে দেয়ায় খুবই ব্যথিত হয়েছিলাম।

সুগন্ধা বন্ধ হয়ে গেলেও পত্রিকাটির সম্ভাবনা ছয় মাসেও শেষ হয়নি। এদিকে এর প্রতি আমার এক ধরনের আবেগের টান বাড়ছিলো। এ অবস্থায় বিষয়টি নিয়ে একদিন উপকারী বন্ধু আবদুস সাত্তার মিয়াজীর সঙ্গে আলাপ করলাম। তথ্য ক্যাডারের এ কর্মকর্তা নিজেও ছিলো মিডিয়াবান্ধব। বিসিএস পরীক্ষার ভাইবার সময় পত্রিকার কাটিং প্রয়োজন ছিলো। এ জন্য তার বেশ কয়েকটি লেখা আমি সাপ্তাহিক জনকথায় ছেপেছিলাম। সবমিলিয়ে তার সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক ছিলো অনেক পুরনো। এদিকে সৈয়দ মোয়াজ্জমের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। যা গড়ে ওঠে এরশাদ সরকারের সময়। তখন সে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা; প্রতিমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রণায়লের দায়িত্বে ছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। তখন মোয়াজ্জেম সাহেবের প্রধান ব্যবসা ছিলো বিদ্যুৎ খাত। এ সূত্রেই দুজনের মধ্যে সম্পর্কের সূচনা হয়। যার পিছনে আমার জোরালো ভূমিকা ছিলো।

ডাকসুর জিএস থাকাকালে সূর্যসেন হলে জিয়াউদ্দিন বাবলুর উপর ছাত্রদলের সানাউর হক নীরুর ভাই বাবলুর নেতৃত্বে হামলা হয়। তখন তাকে রক্ষা করার জন্য একমাত্র ব্যক্তি ছিলাম আমি। এবং মুর্খ সাহসে ভর করে সফলও হয়েছি; আমার মাথা ফাটলেও বাবলু ভাই ছিলেন অক্ষত। যা মন্ত্রী হবার পরও তিনি ভোলেননি। তার উপর হামলা এবং তাকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে আমার ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকার কথা তিনি আমার সামনেই মোয়াজ্জেম সাহেবকে বলেছেন। সেই আমি সুগন্ধার দায়িত্বে থাকা এবং আমার বন্ধু সাত্তার মিয়াজী মন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হওয়ায় ব্যবসায়িক সুবিধা নেবার ক্ষেত্রে পথ চলা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইনের জন্য অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিলো। সে সময় সাত্তারকে প্রায়ই মোয়াজ্জেম সাহেব বলতেন, “সাত্তার ভাই, আপনি মিলনিয়ার হবেন।” মোয়াজ্জেম সাহেবের ব্যবসায়িক ইঙ্গিত ছিলো অত্যন্ত পরিষ্কার। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন হয়েছে বলে জানা যায়নি। তবে সাত্তার মিয়াজিকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম। এ সম্পর্কের ভিত্তিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া সুগন্ধা আবার চালু করার কথা ভাবলাম।

বিষয়টি নিয়ে সাত্তার মিয়াজীর সঙ্গে আলাপ করলাম। সে উৎসাহ নিয়ে রাজি হলো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো পত্রিকার মালিকানা হস্তান্তর নিয়ে। আমার উপর সৈয়দ মোয়াজ্জেমের অনর্থক রাগ ছিলো; কাজেই আমার নামে হস্তান্তরের প্রস্তাব দিলে সৈয়দ মোয়াজ্জেম বেকে বসার ঝুঁকি একশ’ ভাগ। সাত্তার মিয়াজী সরকারি চাকরি করেন; তার নামে সম্ভব না। এ বিষয়ে আরো অনেককে নিয়ে ভাবলাম; কিন্তু তেমন সুবিধা হচ্ছিলো না। মালিকানা হস্তান্তরে জুতসই ব্যক্তি পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলো। এ অবস্থায় সে সময় আমার খুবই ঘনিষ্ঠজন সন্তোষ শর্মার নাম প্রস্তাব করলাম; বিনয়ের কারণে তাকে সৈয়দ মোয়াজ্জেমও বেশ পছন্দ করতেন। সিদ্ধান্ত হলো, শর্মার নামে সুগন্ধার ডিক্লারেশন তথা মালিকানা হস্তান্তর হবে। হাতের কাছে বিকল্প না থাকায় সাত্তার মিয়াজী নিম রাজি হলো। এর পর তিনজন বসলাম। সিদ্ধান্ত হলো, তিনজনে পঞ্চাশ হাজার করে টাকা দিয়ে দেড় লাখ টাকার প্রাথমিক ফান্ড তৈরি করা হবে। এ টাকা থেকে এক লাখ টাকা দেয়া হবে সৈয়দ মোয়াজ্জেমকে পত্রিকার মূল্য হিসেবে এবং বাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে পত্রিকার দুটি ইস্যু বের করা হবে। এর পর পত্রিকার জন্য পুঁজি নেয়া হবে সাত্তার মিয়াজীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী মোস্তফা কামালের কাছ থেকে। তার সঙ্গে আমরা তিনজন পুরান ঢাকায় গিয়ে দেখা করেছি; তখন তিনি পুরনো ঢাকায় বসতেন। এর পর অলৌকিক গতিতে ফ্রেস গ্রুপের মলিক হিসেবে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছেন তিনি। স্যাটালাইট ৭১ টেলিভিশনের সঙ্গেও নাম জড়িত হয়েছে মোস্তফা কামালের। তবে এ টিভির উপর তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ধোঁয়াশা আছে শুরু থেকেই।

প্রথমেই সমস্যা দেখাদিলো প্রাথমিক ফান্ড নিয়ে। পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবার ক্ষমতা আমার ছিলো না। এ ব্যাপারে আমার একমাত্র ভরসা ছিলো আসলাম সেরনিয়াবাদ; সে সময় সে মৎস মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক ছোটখাঁটো ঠিকাদারি ব্যবসা করতো; আর ভাবের আবেশে থাকতো শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের লাভের হিসেব নিয়ে। পরে গাড়ির ব্যবসাসহ অন্যান্য ব্যবসায় সে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে সে সেরা করদাতারও পুরস্কার পেয়েছে। বরিশালের এই আসলামের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো আবদুল্লাহ আল নোমান মৎস মন্ত্রী থাকাকালে। সুগন্ধায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে নাখোশ হয়ে তিনি একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতা চাইছিলেন। আর এর দায়িত্ব দিয়েছিলেন আসলাম ও পিন্টুকে; অথবা তারা উপযাচক হয়ে এ দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সে ঘটনায় সূত্রেই আসলাম সেরনিয়াবাদের সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত। তাকে সুগন্ধার জন্য টাকার কথা বলায় এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলো। যদিও সে সময় এ টাকা তার জন্য খুব সাধারণ বিষয় ছিলো না। উল্লেখ্য, তার মাথায়ও পত্রিকার পোকা ছিলো।

যতই পরিকল্পনা করা হোক; প্রাথমিক ফান্ড নিয়ে জটিলতা দেখা দিলো যৌথ ব্যবসার শুরুতেই। প্রথমে সন্দেহ দানা বাঁধলো আমার অংশের টাকা দেয়ার ক্ষমতা নিয়ে; যার জোরালো ভিত্তিও ছিলো অবশ্য। কিন্তু দেখা গেলো, আমিই সর্বপ্রথম টাকা দিয়েছিলাম। আসলাম টাকা দেবার জন্য নির্ধারিত দিনে মৎস ভবনের সামনে আসতে বললো। আমি আসতে বললাম সাত্তার মিয়াজীকে। ঠিক নির্ধারিত সময়ে আসলাম এলো এবং পঞ্চাশ হাজার টাকার একটি বান্ডির দিলো; আমি তা দিলাম সাত্তারের হাতে। সেখান থেকে সাত্তার চলে গেলো মতিঝিলে সৈয়দ মোয়াজ্জেমের অফিসে। ঘন্টাখানেক পর ফিরে বললো, “দোস্ত সুগন্ধা এখন আমাদের!”

অই দিনই সন্ধ্যায় ইডেন কলেজের গেটে সাত্তার মিয়াজী আমাকে ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে বললো কাজ শুরু করো; এ সপ্তাহেই পত্রিকা মার্কেটে যেতে হবে। কিন্তু এখানেই ঝামেলা শেষ হলো না। জটিলতা সৃষ্টি হলো সন্তোষ শর্মার টাকা নিয়ে। সে জানিয়েছিলো, তার অংশের টাকা দেবে শাহ মোহাম্মদ কায়কোবাদ। কিন্তু টাকা দিতে বিলম্ব করছিলো শর্মা। এতে রেগে গিয়ে সাত্তার বললো, “শর্মাকে বাদ দাও!” আমি দেখলাম বিপদ! সাত্তারকে শান্ত করলাম। গরম ও ঠান্ডা হবার মধ্যে স্বল্প ব্যবধানের লোক সাত্তার মিয়াজী। কয়েকদিন পর শর্মা তার অংশের টাকা দিলো। ততদিন নানান রকমের জোড়াতালি দিয়ে পত্রিকার দুই সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম সংখ্যাটি ছিলো এরশাদকে প্রচ্ছদ করে; এরশাদ বহুমুখী ও স্ববিরোধী এক চরিত্র হওয়ায় যেকোন সময় তাকে নিয়ে আইটেম বানানো সহজ। এ সহজ কাজটিই করলাম প্রথম সংখ্যায়। দ্বিতীয় সংখাটি প্রকাশ করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সংকট নিয়ে; শিরোনাম ছিলো, “ম্যাড কাউর কবলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার”।

পত্রিকার অফিস নেয়া হলো নয়াপল্টনে। দ্বিতীয় উদ্যোগের এক মাসের মধ্যে সুগন্ধা আবার আগের গতি পেলো। আর এ ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় লেখার অবাধ স্বাধীনতা এবং ৯৬-এর সংসদ নির্বাচনী হাওয়া। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে সেই কাজ করলাম, যা ৯১-এর নির্বাচনের সময় পারিনি। তবে এ ক্ষেত্রে কিছুটা বাঁধা ছিলো ছাত্র জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল নেতা আবদুস সাত্তার মিয়াজী। তবে আমার পক্ষে শর্মা থাকায় নির্বাচন নিয়ে পত্রিকার অবস্থান নির্ধারণে তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। বলে রাখা প্রয়োজন, সাত্তার মিয়াজী মানিয়ে চলার অনন্য এক ব্যক্তি। কিন্তু সংসদ নির্বাচন নিয়ে সুগন্ধা পুরোপুরি আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং নগ্নভাবে বিএনপির বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় সাত্তার মিয়াজী কিছুটা হলেও মনো কষ্টে আক্রান্ত হই। তবে এ কষ্ট সম্ভবত অনেকটাই দূর হয়ে গেছে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর পাট প্রতিমন্ত্রী শের-এ-বাংলা পুত্র ফায়জুর হকের একান্ত সচিব হবার পর। এ ক্ষেত্রে সন্তোষ শর্মার অবদান সম্ভবত একশ’ ভাগ। আর পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালনের এ অভিজ্ঞতা এবং ছাত্রজীবনের রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তি করে পরের সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফের একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ছিলো সাত্তার মিয়াজী। সাবেক ছাত্রদল নেতা আওয়ামী লীগ সরকারে প্রতিমন্ত্রীর হিসেবে নিয়োগ লাভ; আবার একই ব্যক্তি পরের বিএনপি সরকারের নীতি নির্ধারণী মন্ত্রীর একান্ত সচিব হবার ধারা প্রায় এক যুগ আগে অসম্ভব বিষয় হয়ে গেছে। বরং সরকারি পরিচয়ের বদলে প্রশাসন অনেকটাই হয়েগেছে দলীয় পরিচয় নির্ভর। এর ফাঁকে অন্য উদাহরণও আছে। অধ্যাপক ইয়াজ উদ্দিনের অধীনে সাজানো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিএনপি-জামায়াতের ব্লুপ্রিন্টের আওতায় রাজশাহীর ডিসি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ডা. আমিন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের একটি পরিদপ্তরের প্রধান হিসেবে অবলীলায় নিয়োগ পেয়েছেন। তবে এ রকম উহারণ বেশি না হলেও বেশ কিছু আছে। আর এর নেপথ্যে ‘কোন্ লীলা’ কেরামতি হিসেবে কাজ করছে কে জানে। তবে অনেকেই সন্দেহ করেন, অন্য কিছু। এক সময় স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে কামিনী-কাঞ্চনের প্রভাব থাকলেও এরশাদের পতনের পর প্রধান হয়ে গেছে কেবল টংকা! আর অনেকেই মনে করেন, জামায়াতের কাছে এখনও আছে কাড়িকাড়ি টাকা।

সাপ্তাহিক সুগন্ধার দ্বিতীয় প্রকাশের গতিতে ‘যৌথ মালিকানার’ নানান দুর্গতি ঢুকতে বেশি সময় লাগেনি। আমাদের যৌথ মালিকানার পত্রিকা ব্যবসা ছয় মাসের বেশী টেকেনি। দ্রুত তিন ঘনিষ্ঠজনের উৎসাহে ভাটার টান শুরু হলো। পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলো এক পর্যায়ে। সিদ্ধান্ত হলো, পত্রিকার মালিকানা বিক্রি করা হবে। আমার দুই পার্টনার আবদুস সাত্তার মিয়াজী ও সন্তোষ শর্মা অতি উদার হয়ে এমনও বললো, পত্রিকা বিক্রির টাকা থেকে তাদের দু’জনের বিনিয়োগ চার লাখ টাকা ফেরত পেলেই খুশি; লাভ দরকার নেই। বাকি টাকা আমার। এটি আমার জন্য নিশ্চয়ই শস্তির সংবাদ। তবে বড় রকমের অশ্বস্তি ছিলো ‘শর্ত প্রযোজ্য’; মোবাইল ফোন অপারেটরদের মতো। একমাত্র শর্তটি ছিলো, ক্রেতা খুঁজে বেড় করতে হবে আমাকে। অনেকটা কুকুরের লেজ সোজা করার মতো দায়িত্ব। অথবা নেপথ্যে ছিলো, ২২ মণ ঘি জোগার করে রাধাকে নাচাবার প্রবচনের মতো।

বাইশ মণ ঘি জোগার করে রাধাকে নাচনোর ব্যবস্থা করা না গেলেও সুগন্ধার ক্রেতা জোগার করতে পেরেছিলাম এক সপ্তাহের মধ্যে; ১০ লাখ টাকার ক্রেতা। আর তা পাওয়া গেলো ঘটনা চক্রে নদী বিলাসের ঝোকের কারণে।

মোজাম্মেল ভাইর ঘনিষ্ঠ লোক আনোয়ার ভাইর মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিলো সে সময়ের জনশক্তি রপ্তানিকারক কিরনের সঙ্গে। বিএনপির হয়ে তিনি শরিয়তপুরের একটি আসন থেকে সংসদ নির্বাচনের লড়েছেন একাধিকবার। তার বাসা ছিলো উত্তরায়, আমিও থাকতাম তার বাসার কাছাকছি। সুগন্ধার দ্বিতীয় উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ার দুই দিনদিন পর তার সঙ্গে দেখা হলো পথে। কুশল বিনিময়ের পর তিনি পত্রিকার বিষয়টি জানলেন। তিনি বললেন, তা হলে তো ফ্রি আছেন; চলেন কাল চাঁদপুর যাই, কালই ফিরবো। স্পিটবোটে যাত্রা বলে এক কথায় রাজি হলাম। আমি বরাবরই মনে করি, কেবল পরিবেশের জন্য নয়, হতাশা শুষে নেবার ক্ষেত্রেও পানির কোন বিকল্প নেই; প্রশান্তির জন্যও পানি অনন্য।

চাঁদপুর থেকে ফেরার পথে সুগন্ধা প্রসঙ্গ তুললেন জনাব কিরণ। আমি বিক্রির সিদ্ধান্তের কথা জানালে তিনি ক্রেতা হিসেবে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বললেন, “দশ লাখ টাকা হলে আমি আছি।” টাকার এ অংক ছিলো প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। আমি ‘হ্যা’ বললাম। রাতে বাসায় গিয়ে সাত্তার মিয়াজিকে ফোনে বিষয়টি জানাই। আমি মনে করেছিলাম, টাকার অংক শুনে সে খুবই খুশি হবে। কিন্তু পেলাম উল্টো ঘ্রাণ! সে একটু ইতস্তত করে বললো, “তোমাকে জানাচ্ছি।” দশ মিনিটের মধ্যে ফোন করে বললো, “একই দামে পত্রিকা আমি নেবো। তুমি কাল সচিবালয়ে আসো, তোমার টাকা দিয়ে দেবো।”

সারারাত আমার কষ্টে কেটেছে, একটুও ঘুমাতে পারিনি; কেবল কান্না পাচ্ছিলো। দুপুরের দিকে সচিবালয়ে সাত্তার মিয়াজির কাছে গেলাম। তখন সে পাট প্রতিমন্ত্রী ফায়জুল হকের একান্ত সচিব, খুবই ক্ষমতাধর। আমার সঙ্গে ছিলেন সকলেই বিপদের বন্ধু মোস্তফা ফিরোজ দিপু। আমাকে দুই লাখ টাকার চেক দিয়ে সাত্তার বললো, “বাকি দুই লাখ টাকা ছয় মাস পর দেব।” এর আগে স্ত্রীর প্ররোচনার ফাঁদে পড়ে জমি কেনার সময় সাত্তারের কাছ থেকে আমি দুই লাখ টাকা ধার নিয়েছিলাম। কাজেই আমার ভাগের ছয় লাখ টাকার মধ্যে বকেয়া থাকলো দুই লাখ টাকা।

চেক নিয়ে আমি রুম থেকে বের হবার সময় সাত্তার বললো, আমরা একত্রে যাই; আমাকে আজিমপুরে নামাবার পর তোমাকে ড্রপ দেবে। হয়তো আমার বিষন্ন অবস্থা সে খেয়াল করেছিলো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সাত্তারের রুমে বসে থাকলাম। প্রায় আধাঘন্টা পর আমরা বের হই। গাড়িতে ওঠার পর কান্না ধরে রাখা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়লো; আজিমপুরের সাত্তারের বাসার কাছাকাছি আসার পর আর চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারিনি। এ অবস্থায় সাত্তারও বেশ আবেগ প্রবন হয়ে পড়ে। সে বারবার বলতে লাগলো, “না দোস্ত, তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি পত্রিকা নেব না, তুমি এতোটা কষ্ট পেলে পত্রিকা টিকবে না!” আমি বললাম, ‘না দোস্ত, আমি আর এর মধ্যে নাই!’ মিনিট কয়েকের মধ্যে গাড়ি সাত্তারের বাসার সামনে এলো। সে নামতে বললো। আমি বললাম, ‘এ অবস্থায় বাসায় ঢোকা ঠিক হবে না।’ সে বললো, “কাল সচিবালয়ে আসো।” আমি বললাম, ‘তোমার সঙ্গে ছয় মাস পর যোগাযোগ করবো।’

গুণে গুণে ঠিক ছয় মাস পর রাত দশটার দিকে সাত্তারকে ফোন করলাম। বললাম, ‘দোস্ত কিছু টাকা বাকি ছিলো...।’ বিরক্ত কন্ঠে সে বললো, “এতো রাতে টাকার তাগাদা দেবার সময়!” এরপর তার সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. মোশাররফের রাজনৈতিক প্রগ্রামে কাভার করতে এক গাড়িতে কুমিল্লা গেছি। এছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষে দেখা হয়েছে। কিন্তু বকেয়া টাকার প্রসঙ্গ আমি আর তুলিনি, সাত্তারও না।

শর্ত মতো সব টাকা না পেলেও ধার-উদ্ধার করে বিনিয়োগ করা টাকার চেয়ে বেশি প্রাপ্তিতে কষ্ট নিয়েও আমি স্বস্তিতে ছিলাম। সাত্তার মিয়াজী হতাশ হয়ে লাভ ছাড়াই তার বিনিয়োগ ফেরত নিয়ে সন্তষ্ট ছিলো বলে আমার ধারণা। সাপ্তাহিক সুগন্ধার একক মালিকানা চলে গেলো সন্তোষ শর্মার কাছে; সম্পাদনায় দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছিলো মোস্তফা কামাল। সুগন্ধার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন মিরপুরের মিজান টাওয়ারের আলোচিত মিজান। বেশ কিছু দিন চলার পর পত্রিকাটি পাঠকের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সন্তোষ শর্মা এখন দৈনিক আমাদের সময়-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। দৈনিক আমাদের সময়-এর সঙ্গে সূচনা লগ্নে নাঈমুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে যুক্ত হয়েছিলাম নঈম নিজামের জোর সুপারিশে।

আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

e-mail: [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :