সঞ্চয়!

রুখসানা মিলি
 | প্রকাশিত : ২৪ নভেম্বর ২০১৭, ১০:৩২

বয়স প্রায় ৮০ ছুঁই ছুঁই। চোখের আলো নিভু নিভু। কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু আন্দাজ আর ঝাপসা দেখতে পাওয়াকে সম্বল করেই জীবন বয়ে চলেছেন। কথা বলতে খুব ভালোবাসেন। নিরন্তর বলে চলেন। যে শুনছে তার অভিব্যক্তি না বুঝেই বলে চলেন। রাজ্যের অভিযোগ। শরীরের নানান রকম অসুবিধা নিয়ে অভিযোগ। ছেলেমেয়ে-নাতি-নাতনি-আত্মীয়-স্বজন-পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই আছেন সেই অভিযোগের তালিকায়। আর কিছু হা হুতাশ। যারা তার চেয়ে অল্প বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, তাদের নিয়ে আফসোসের ঝুঁড়ি খুলে বসেন যখন তখন। তার চেনাজানা বা কাছের মানুষ যারা ভালো নেই তাদের নিয়েও আফসোসের ঝুঁড়ি খুলে বসেন। শ্রোতার অভিব্যক্তি ছাড়াই তার মত বলে চলেন।

বলছি আমার নানি রোকেয়া বেগমের কথা। বার্ধক্যর ভারে নুজ্ব্য। অল্প কিছুদিন হল একটা ‘মাইল্ড ব্রেন স্ট্রোক করেছেন। নানি আমাদের সঙ্গে থাকেন। অনেক দূরে থাকেন বিধায় তার সাথে সময় কাটানো হয় না বহুদিন। তার সাম্প্রতিক অসুস্থতার কারণে আমার কর্মব্যস্ত ছুটে চলা জীবন থেকে দুটো দিন তার সাথে কাটিয়েছি। এই অল্প সময়ে এক অদ্ভুত বোধ আর পরিতৃপ্তির দেখা পেয়েছি। যা বাকি জীবনের জন্য আমার সঞ্চয়।

আমার ছোট বাচ্চাটি যতবার জগ থেকে পানি ঢালতে যায় ততবার ফেলে দেয়। আরো অনেক কাজ- অকাজ আছে যেগুলো করার পর আমরা হাসি অথবা মৃদু তিরস্কার করি। হেসে বলি বাচ্চা তো। বৃদ্ধরাও অনেক কিছু করতে পারেন না। অনেক অযথা কথা বলেন। অনেক অযথা কাজ করেন। কিন্তু তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে তিরস্কার করা হয়। বৃদ্ধ তো বলে মেনে নেওয়ার সংখ্যা নগন্য হয়ে দাড়ায়। অথচ ৫ বছরের বাচ্চা আর ৮৫ বছরের বৃদ্ধর মধ্যে পার্থক্য সামান্যই।

বাচ্চাদের সাথে কাটানো সময়গুলো যেমন মূল্যবান আর তৃপ্তির হয় একটু সহমর্মিতা ভালোবাসা নিয়ে বৃদ্ধদের সাথে সময় কাটালেও দেখা পাওয়া যাবে তেমনই পরিতৃপ্তির। জীবন চক্রে স্রষ্টা প্রদত্ত শক্তি-বুদ্ধি নিয়ে আমরা যখন ছুটে চলছি তখন একবার নিজের বার্ধক্য বা শক্তি ক্ষয়ের কথা ভাবলেই এই মানুষগুলোর কর্মকান্ডে আর বিরক্তি তৈরি হবে না। বরং হাসি পাবে। প্রশয় তৈরি হবে। আর এই মানুষগুলো প্রাকৃতিক অসহায়ত্ব ভুলে শেষের সময় গুলো রঙিন করে তোলার সুযোগ পাবে।

আব্বা খুব অল্প বয়সেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কি বিশাল শূণ্যতা তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন তা বলে বা লিখে কাউকে কখনও বোঝানো সম্ভব নয়। তার সাথে কাটানো সময়, ভালো ব্যবহার, খারাপ ব্যবহার এমন অসংখ্য টুকরো টুকরো স্মৃতি এখন মনকে সতেজ রাখে। তৃপ্তি দেয়, আফসোস তৈরি করে। চোখে জল-মুখে হাসি-দীর্ঘশ্বাষ সবই তৈরি করে ঐসব স্মৃতিগুলো। ঐগুলোই সঞ্চয়। ঐগুলোর উপরেই ভর করে চলার শক্তি পায়, এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়।

দাদা-দাদী, নানা-নানী, বাবা-মা যাদের আছে কিন্তু এখনও এই পরিতৃপ্তির আর ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের খবর এখনও পায়নি আমার মনে হয় তারা নিতান্তই অভাগা। সেই অভাগাদের জন্য সমবেদনা। আর যারা সৌভাগ্যোকে আলিঙ্গন করে সম্পদ ভান্ডার বাড়াচ্ছেন তাদের জন্য অভিনন্দন।

আমার নানীকে যে সময়টুকু দিয়েছি তাতে তিনি লজ্জিত। আমাকে বলেছেন, তোমার এত ব্যস্ততার মধ্যে তুমি আমার সাথে বসে আছো? আমি কেবল হেসেছি। উত্তর দেইনি। ভবিষ্যতের যে সঞ্চয় আমার হলো তার রহস্য নানীর কাছে অজানাই থেকে গেল!

রুখসানা মিলি: গণযোগাযোগ পর্যবেক্ষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :