শ্রমিক সংকটে হুমকিতে শীতলক্ষ্যাপারের জাহাজ তৈরি শিল্প

আতাউর রহমান সানী, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ)
 | প্রকাশিত : ২৮ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:৩৪

প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় পাড়ে ছোট বড় শতাধিক শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেছে। একইভাবে জাহাজ তৈরি শিল্প ডকইয়ার্ড সংখ্যাও কম নয়। জেলার গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা শিল্পনগরী খ্যাত রূপগঞ্জের বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় গড়ে ওঠেছে অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ড। এতে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত থাকলেও সম্প্রতি শ্রমিক সংকটে অনেকটা হুমকির মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

নিরাপত্তার অজুহাতে স্থানীয় শ্রমিকদের এ পেশায় রয়েছে অনীহা। তাছাড়া স্থানীয় সন্ত্রাসীদের অব্যাহত চাঁদাবাজির কারণে মানসম্মত শ্রমিক ও ঠিকাদাররা নিরাপদে কাজ করতে পারছেন না বলে রয়েছে অভিযোগ।

সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর ডেমরা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের পূর্বগ্রাম গ্রামের অবস্থান। এখানকার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে মেসার্স খাঁন ডকইয়ার্ড। কথা হয় এ কোম্পানির স্বত্বাধিকারী সফিকুল ইসলাম খান রুজেল‘র সঙ্গে। তিনি ঢাকাটাইমসকে জানান, রূপগঞ্জের অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ড থেকে বছরে দেড় শতাধিক ছোট বড় নৌযান তৈরি হচ্ছে। এসবের মধ্যে কার্গো জাহাজ, লঞ্চ, ট্রলার ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তিতে। নৌ বিশেষজ্ঞদের দেয়া নকশা অনুসরণ করে এখানকার তৈরি বিশ্বমানের জাহাজ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তবে স্থানীয় শ্রমিকরা এ কাজে ঝুঁকছে না বলে রয়েছে তার হতাশা।

তার দাবি, রূপগঞ্জের শিল্পকারখানাগুলোতে স্বাধীনভাবে স্থানীয় শ্রমিকরা কাজ করলেও জাহাজ শিল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে চায় না তারা। ফলে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের অব্যাহত চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটে চলেছে। ফলে ঠিকাদার ও মানসম্মত শ্রমিকরা এখানে নিরাপদবোধ করছেন না। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করেও চাঁদাবাজি রোধ করা যাচ্ছে না।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার কায়েতপাড়া, দাউদপুর ও মুড়াপাড়া ইউনিয়ন ও তারাব পৌরসভার রূপসীতে গড়ে তোলা হয়েছে ছোট বড় অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ড। এসব ডকইয়ার্ডে কর্মরত শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করে জানা যায়, তাদের বেশির ভাগই দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা তথা ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর ও রংপুরের শ্রমিক। তাদের মধ্যে রাজধানী ও রংপুর বিভাগের শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি।

কারণ হিসেবে জানা যায়, সেসব এলাকার লোকজন এ জাহাজ নির্মাণ শিল্প ঝুঁকি জেনেই জীবিকার তাগিদে এ পেশায় রয়ে গেছেন। তবে তাদের মজুরি ভাগটাও সাধারণ কাজের তুলনায় একটু বেশি। তবু স্থানীয় শ্রমিক আকৃষ্ট করতে পারছে না এসব ডকইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ। ফলে বাইরের জেলার শ্রমিকদের আবাসন সুবিধা ও খোরাকি দিয়ে বেশি খরচ বহন করতে হয় মালিক পক্ষের। এতে জাহাজ নির্মাণ করতে বাজেটের তুলনায় বেশি খরচ হয়ে যায়।

ডকইয়ার্ড মালিকদের দাবি স্থানীয় শ্রমিকদের এ কাজে সংযুক্ত করতে পারলে অর্ধেক খরচেই শ্রমিক সমস্যার সমাধান হতো। তবে স্থানীয় শ্রমিকরা বলেন ভিন্ন কথা।তাদের দাবি, জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বৈদ্যুতিক তেজস্ক্রিয়তা ও গ্যাসের ব্যবহার থাকায় জীবন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় এ শিল্পের শ্রমিকদের। তাছাড়া লোহার ভারী প্লেট স্থানান্তর ও ঝালাই কাজের সময় বৈদ্যুতিক সকের ঝুঁকি থাকে। এসব নিরাপত্তা বিধানে ডকইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ কোনো সরঞ্জাম ব্যবহার করে না বললেই চলে। ফলে এ ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় স্থানীয়দের রয়েছে অনীহা।

এদিকে স্থানীয় শ্রমিকদের এ কাজে যুক্ত করতে না পারায় রূপগঞ্জের ডকইয়ার্ড মালিকদের বাড়তি খরচ করে শ্রমিক নিয়োগ দিতে হয়। ফলে আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন না তারা। আধুনিক জাহাজ তৈরিতে এ শ্রমিক সংকট ভয়াবহ বাধা হিসেবে মনে করেন এ কাজে যুক্ত ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।

সূত্র জানায়, সম্ভাবনাময় এ শিল্প রূপগঞ্জের অংশে শীতলক্ষ্যা নদীর চরে স্থানে স্থানে বৃহৎ লঞ্চ, জাহাজ, ট্রলার তৈরি কাজে ব্যস্ততম সময় পার করেন শীতকালে। বর্ষাকালেও বসে নেই এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে ব্যাপক শ্রমিক চাহিদা থাকলেও এ কাজের শ্রমিক পাওয়া নিয়ে হিমশিম খান প্রতিষ্ঠান মালিকরা।

শীতলক্ষ্যাপারের পূর্বগ্রাম ছাড়াও ডাক্তারখালী, বড়ালু, মাঝিনা নদীর পার, হরিনা গ্রামের চর, ইছাখালী,দাউদপুরের খাসের চর, মুড়াপাড়ার গঙ্গানগর, দড়িকান্দিসহ বেশ কিছু এলাকায় রূপগঞ্জের সীমানায় রয়েছে ৫০টির অধিক ডকইয়ার্ড। এসব ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মাস্টাং ডকইয়ার্ড, খান ডকইয়ার্ড, ফাহিম ডকইয়ার্ড, শ্যামস, তালহা, আমির, মালেক, ফটিক, মনির, ভাই ভাইসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ডকইয়ার্ড শিল্প প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রতিষ্ঠানে শত ফুট থেকে শুরু করে আড়াইশ ফুট কোস্টার বা মালবাহী জাহাজ, সরোঙ্গা, ফেরি, জেটি, পল্টুন, বালুবাহী ট্রলার, বলগ্যাট ও ড্রেজারসহ অত্যাধুনিক নৌযান তৈরি হচ্ছে এখানে। এসব তৈরিতে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ লোহার প্লেনসিড আর এঙ্গেল আমদানি করে থাকেন চীন থেকে। অতিরিক্ত উপাদান টিগার্ড, বিট গার্ডার, রং, ইটা, বালি, সিমেন্ট, গ্যাস সিলিন্ডার, অক্সিজেন, ওয়েল্ডিং রড, আর লেদ মেশিনের ওপর আলাদা আলাদা কাজে প্রয়োজন হয় বিপুলসংখ্যক বিভাগীয় শ্রমিক। কাজ বেশি থাকার ফলে প্রচুর চাহিদা রয়েছে শ্রমিকের।

প্রথমে রাজমিস্ত্রি বেইস লাইন তৈরি করে দেন। আর এ রাজমিস্ত্রির শ্রমিক সাধারণত স্থানীয়ভাবে সরবরাহ করা হয়। দৈনিক মজুরিভিত্তিক এসব শ্রমিক দিয়েই প্রাথমিক কাজ সাড়েন তারা। পরের ধাপে ফিটার কাজের জন্য আলাদা শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বা ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ তা আঞ্জাম দেন। তাতে তারা এসে মলিন তৈরি করে দেন। এ বিভাগেও বিশেষ শ্রেণির শ্রমিক কাজ করেন। পরে ওয়ার্কসপ বিভাগের ওয়েল্ডার ঝালাইয়ের মাধ্যমে খাচা তৈরির কাজ শুরু করেন জাহাজ নির্মাণ কাজের স্থায়ী ও নির্ধারিত শ্রমিকরা।

এভাবে বডি দাঁড় করানোর পর মেশিন স্থাপন ও রং লাগানোর কাজেও পৃথক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। আবার বড় জাহাজে ৩/৪টি হেস থাকে। যেখানে তিন থেকে চারশ টন মাল বহন করা যায়। এসব প্লেনসিড আনা হয় সাধারণত চট্টগ্রাম থেকে। বিদেশি মেয়াদোত্তীর্ণ কাটা জাহাজের সিডও ব্যবহার হয় এইসব ডকইয়ার্ডে। আর এসব সরবরাহ কাজে রয়েছে আরও পৃথক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এখানেও এক শ্রেণির শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।

এভাবে গড়ে একটি জাহাজ নির্মাণ করতে শ্রমিকের প্রয়োজন হয় প্রায় দেড় শতাধিক। আর একটি জাহাজ তৈরি প্রক্রিয়ার সময় লাগে প্রায় দেড় থেকে ২৩ বছর। এভাবে একের পর এক কর্মসংস্থান থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক নিয়মিত কাজ পাচ্ছেন। তবে স্থানীয় শ্রমিকদের এ কাজে আগ্রহ না থাকায় একদিকে মালিক পক্ষ বাড়তি খরচ করে বাঁচিয়ে রাখছে এ শিল্প। অন্যদিকে নানা অজুহাতে স্থানীয় শ্রমিকরা পিছিয়ে পড়ছেন সম্ভাবনাময় এ শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন সুযোগ থেকে।

সূত্র জানায়, ৮ থেকে ৯ লাখ টাকায় চীন থেকে মেশিন আমদানি করে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব কাজে ব্যবহৃত কাঁচামালগুলোর একটি অংশ ঢাকার বংশাল থেকেও পাওয়া যায়। কিছু আসে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারি থেকে। সব মিলিয়ে একটি বড় জাহাজ তৈরিতে নয় থেকে ১২ কোটি খরচ হয়ে যায়। মালিকদের দাবী স্থানীয় শ্রমিকরা এ কাজে সম্পৃক্ত হলে এ খরচ প্রায় কোটি টাকা কমে যাবে। একটি জাহাজে নিয়মিত কারিগর হিসেবে ৪০ থেকে ৫০ জন স্থায়ী হিসেবে কাজ করেন। এদের স্থায়িত্ব প্রায় দেড় বছর থেকে তিন বছর থাকে। এ শিল্পে বিনিয়োগ যেমন লাভজনক তেমনি মালিক, ফিটার, ঠিকাদার, কারিগর, শ্রমিক শ্রেণির জীবিকা অর্জনের সম্মানজনক পথ। ঠিকাদারের অধীনে জমির ভাড়া, শ্রমিক নিয়োগ, বেতনাদি পরিশোধ কাজে এসব শ্রমিরা মজুরি হিসেবে পান ঠিকাদার নিজেই মাসিক ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। রাজমিস্ত্রি দৈনিক মজুরি ভিত্তিক ৫০০ টাকা থেকে তার সহযোগীর ৪০০ টাকা। ফিটারের দৈনিক বেতন ৪০০ টাকা, রং মিস্ত্রিও জন্য রয়েছে একই ধরনের মজুরি।

এভাবে একটি জাহাজ নির্মাণে শ্রমিকদের জন্য আলাদা আলাদা মজুরির ব্যবস্থা করা হয়। আর কারিগররা থাকেন মাসিক বেতন ভিত্তিতে। ফলে তারা কোম্পানির স্থায়ী শ্রমিক হিসেবেই কাজ করেন। পরে জাহাজ তৈরি হয়ে গেলে বাজারদরে এসব জাহাজ বিক্রি করে দেন মালিক পক্ষ। এভাবে মালিক পক্ষ বছরে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার মতো আয় করে থাকে।

এ ছাড়াও এ শিল্পকে কেন্দ্র করে স্থানীয়রা গর্দার ব্যবসা, লেদ মেশিন, খুচরো যন্ত্রাংশ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান, চা পানের দোকান, খাবারের হোটেলের পসরা বসিয়ে বাড়তি আয় করার সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আশানুরুপ ফল পাচ্ছেন তারা।

পূর্বগ্রামের বাসিন্দা বাবর হোসেন খাঁন ঢাকাটাইমসকে বলেন, উপজেলার কায়েতপারা ও দাউদপুর এলাকায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় শ্রমিকরা কাজ করতো। এখন সেখানে তারা যেতে চান না। কারণ হিসেবে জানা যায়, এখানে রড কাটার পদ্ধতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। অন্যদিকে ঠিকাদার কাজ শুরু করলেই সন্ত্রাসীরা তাদের কাছে চাঁদা দাবি করে বসে। তাদের দাবিকৃত চাঁদা না দিলেই মারধরসহ জাহাজে ব্যবহৃত কাচামাল লুটের ঘটনা ঘটে। তাই তারা এটা এড়িয়ে চলেন। তবে প্রচুরসংখ্যক বাইরের জেলার লোকজন এখানে কাজ করেন। তিনি দাবি করেন, স্থানীয়দের এ কাজে আকৃষ্ট করলে ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারতো।

হারিন্দা এলাকার ডকইয়ার্ড ঠিকাদার সুলতানুল আরেফীন জুলফিকার ঢাকাটাইমসকে বলেন, রূপগঞ্জের শিল্প প্রতিষ্ঠানে এখানকার শ্রমিকরা কাজ করতে চান না এটা দুঃখজনক। তাছাড়া চাঁদাবাজদের মোকাবেলা করেই এখানে ব্যবসা করতে হয়। বাড়তি ঝামেলা মনে করে অভিযোগ করেন না বলে জানান তিনি। তিনি মনে করেন, যদি এই এলাকার লোকজন এখান থেকে কাজের মাধ্যমে আয় করতে পারতো তবে তা হতো একটি আর্শিবাদ। তবে স্থানীয় শ্রমিকরা এ কাজের সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা ইসলাম ঢাকাটাইমসবলেন, রূপগঞ্জের সীমানায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান জাহাজ নির্মাণ করছে। যা স্থানীয়ভাবে অর্থনৈতিক ভূমিকা রাখছে। তবে কিছু প্রতিবন্ধকা ও আইনি বিষয় মেনেই তাদের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা উচিত। সমস্যাগুলো নিয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/২৮নভেম্বর/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :