পাবনায় ১৩ জমিদারের সেই গ্রাম এখন ভুতুরে জঙ্গল

খাইরুল ইসলাম বাসিদ, পাবনা
 | প্রকাশিত : ২৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:২৯

পাবনার বেড়া উপজেলার হাঁটুরিয়া গ্রামের অতীত ঐতিহ্য আর ইতিহাসের দিকে উঁকি দিলে চোখে পড়ে ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের সব দালানকোঠা। লাঠি-বল্লম হাতে পেটা শরীরের পাইক-পেয়াদা রয়েছে সেগুলোর ফটক পাহারায়। ভেতর থেকে ভেসে আসছে নারী-শিশুদের কলতান। সন্ধ্যা হলেই মুহুর্মুহু শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠছে আশেপাশের এলাকা। হাজারো লণ্ঠন আর ঝাড়বাতির আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠা কোনো ভবনে হয়ত বসেছে কলকাতা থেকে আসা নামজাদা গাইয়েদের গানের আসর। অথবা গ্রামের চারদিকজুড়ে হয়তো বসেছে কোনো মেলা। গ্রামের পাশেই যমুনাপাড়ের ঘাটে বাঁধা রয়েছে জমিদারের সুদৃশ্য কোনো বজরা। একটু পরেই হয়ত কোনো জমিদার তার লোকজন সমেত এসে তাতে চড়ে রওনা হবেন তার জমিদারি এলাকার দেখভাল করতে।

এক সময় এ গ্রামে একসঙ্গে বাস করতেন ১৩ জন জমিদার। বৃহত্তর পাবনা জেলার বাইরেও বিস্মৃত ছিল তাদের জমিদারি। ১৩ জমিদারের গ্রাম হওয়ায় এ গ্রামটির অতীত ঐতিহ্য প্রকৃতপক্ষেই ছিল চমকে দেয়ার মতো বর্ণাঢ্য। তবে বর্তমানে ভাঙাচোরা দালানকোঠা আর কয়েকটি পুকুর ছাড়া প্রাচীন ঐতিহ্যের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এক সময়ের জৌলুসে ভরা এ গ্রামটিতে এখন সমস্যার শেষ নেই। গ্রামে প্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীণ রাস্তা নেই। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় গ্রামের একটা বড় অংশে কয়েক মাসজুড়ে থাকে জলাবদ্ধতা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে এখানে অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। সবচেয়ে বড় কথা এ গ্রামের বাসিন্দাদের বড় অংশই নদীভাঙনে নিঃস্ব। এ কারণে গ্রামবাসীদের অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী।

এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, জমিদারি আমলে হাঁটুরিয়া গ্রামটি বৃহত্তর পাবনা জেলার অন্যতম অভিজাত এলাকা ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। সুদূর কলকাতাতেও ছিল যমুনাপাড়ের এই গ্রামের সুখ্যাতি। গ্রামের পার্শ্ববর্তী নৌবন্দর নাকালিয়া থেকে কলকাতার মধ্যে সরাসরি স্টিমার যাতায়াত করত। এ ছাড়াও এ গ্রাম থেকে নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে খুব সহজে যাতায়াত করা যেত। আর এসব কারণে শুধু জমিদারেরাই নন, বিত্তশালী ব্যক্তিরাও এখানে বাস করতেন। এ গ্রামে বসেই জমিদারেরা পরিচালনা করতেন তাদের জমিদারি। সেই আমলে কাছে-দূরের সবার কাছেই হাঁটুরিয়া গ্রামটি পরিচিত ছিল জমিদারের গ্রাম হিসেবে।

এলাকার প্রবীণরা ঢাকাটাইমসকে জানান, শ’খানেক বছর আগে হাঁটুরিয়া গ্রামে হাতে গোণা দুই একজন জমিদার বাস করতেন। এরপর থেকে গ্রামটিতে একে একে বাড়তে থাকে জমিদারের সংখ্যা। একপর্যায়ে গ্রামে বসবাসকারী জমিদারের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় তেরতে। তারা হলেন-প্রমথনাথ বাগচী, কাঞ্চিনাথ বাগচী, উপেন্দ্রনাথ বাগচী, ভবানীচরণ বাগচী, কালীসুন্দর রায়, ক্ষীরোদ চন্দ্র রায়, সুরেণ চন্দ্র রায়, সুধাংশ মোহন রায়, শক্তিনাথ রায়, বঙ্কিম রায়, ক্ষুদিরাম পাল, যদুনাথ ভৌমিক ও যতীন্দ্রনাথ ভৌমিক।

প্রবীণ ব্যক্তিদের মতে এসব জমিদারদের একসঙ্গে হাঁটুরিয়া গ্রামে বসবাসের সময়টা ছিল আনুমানিক ১৯১৫ সালের পরের সময় থেকে। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা এ গ্রাম থেকেই পরিচালনা করতেন তাদের জমিদারি।

এলাকাবাসীরা আরও জানান, ১৩ জমিদারের মধ্যে সবচেয়ে প্রজাবৎসল ও মঙ্গলকামী ছিলেন প্রমথনাথ বাগচী। আর প্রজাপীড়ক ও অত্যাচারী ছিলেন যদুনাথ ভৌমিক। এক গ্রামে এতজন জমিদার থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে কখনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত হতো না। তবে পূজা-পার্বণসহ নানা উৎসব পালন করা নিয়ে তাদের মধ্যে চলত পাল্টাপাল্টি প্রতিযোগিতা। প্রত্যেক জমিদারেরই সেসময় কলকাতায় বাড়ি ছিল। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর দেশভাগের আগে পরে একে একে সব জমিদারই স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে যান।

জমিদারদের প্রত্যেকেই বাস করতেন প্রাচীর ঘেরা অট্টালিকায়। অট্টালিকার পাশে প্রত্যেকেরই ছিল সান বাঁধানো বড় পুকুর অথবা দীঘি। সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে কয়েকটি পুকুর ভরাট হয়ে গেলেও এখনো রয়েছে ৬-৭টি পুকুর। তবে সেগুলোর বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত করুণ। পুকুরগুলোর চেয়ে জমিদারদের অট্টালিকাগুলোর পরিণতি আরও করুণ। মালিকানা বদলের পর কিছু অট্টালিকা ভেঙে ফেলা হয়েছে, আর কিছু আপনা আপনিই ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে জমিদার আমলের সাক্ষী হিসেবে গ্রামে এখনো রয়ে গেছে দুই তিনটি অট্টালিকার অংশ বিশেষ। জরাজীর্ণ এসব অট্টালিকায় ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে কয়েকটি পরিবার। এমনই একটি ভগ্নদশা দ্বিতল অট্টালিকায় বাস করেন দিলীপ গোস্বামীর পরিবারের লোকজন। অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ইজারা নিয়ে বসবাস করেন তারা। দেখেই বোঝা যায়, অনেকটা জায়গার ওপর প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে এর বেশিরভাগ অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে।

দীলিপ গোস্বামীর ছেলে দীপক গোস্বামী (৪৫) জানান, অট্টালিকার এক স্থানে এর নির্মাণকাল ১৯১১ এবং নির্মাতা হিসেবে জমিদার ক্ষীরোদ চন্দ্র রায়ের পিতা উমেশ চন্দ্র রায়ের নাম খোদাই করা ছিল। ছেলেবেলায় তিনি এখানে সুপরিসর জলসাঘরসহ আরও অনেক কক্ষ দেখেছেন। হলরুমে জমিদার ক্ষীরোদ চন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষদের বেশ কিছু ছবি ছিল। ছেলেবেলায় দেখা জলসাঘরসহ কক্ষগুলো যেমন ধ্বংস হয়ে গেছে তেমনি নষ্ট হয়ে গেছে ছবিগুলোও। বর্তমানে বিপজ্জনক জেনেও কিছুটা নিরুপায় হয়ে এখানে তারা বাস করছেন বলে তিনি জানান।

বেড়া মনজুর কাদের মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মনোয়ার হোসেন জানান, তার বাবা মরহুম মমতাজ উদ্দিন সিরাজগঞ্জের চৌহালী এলাকার জনৈক জমিদারের নায়েব ছিলেন। তার মুখে হাঁটুরিয়ার জমিদারদের অনেক কাহিনি তিনি শুনেছেন। এখন হাঁটুরিয়া নানা সমস্যায় ভরা প্রত্যন্ত সাধারণ একটি গ্রাম। অথচ এখানেই একসময় প্রভাবশালী সব জমিদার বাস করতেন।

গ্রামবাসীরা জানান, শুধু সুখ সমৃদ্ধিই নয়, শিক্ষা-দীক্ষাতেও এ গ্রাম ছিল সবার উপরে। অথচ আজ এ গ্রাম থেকে শিক্ষার আলো যেন নিভে গেছে। অভাব-অনটনের কারণে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের বড় অংশ শিক্ষার পরিবর্তে ঝুঁকে পড়ছে উপার্জনের দিকে। এখানে বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। গ্রামবাসীরা আধুনিক সুবিধা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত।

হাঁটুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা উজ্জ্বল দাস ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এ গ্রামটির সমস্যার কথা বলে শেষ করা যাবে না। ভাবতে অবাক লাগে ১৩ জমিদারের গ্রামটির আজ এমন করুণ দশা।’

হাঁটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জমিদারের গ্রাম বলে পরিচিত হাঁটুরিয়ায় কিছু কিছু সমস্যা আছে। এ সমসম্যাগুলোর সমাধানের পাশাপাশি বিলীন হতে বসা ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

এ ব্যাপারে পাবনার জেলা প্রশাসক রেখা রানী বালো ঢাকাটাইমসকে বলেন, জেলার জমিদার বাড়িগুলো উদ্ধার প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যে চাটমোহরের প্রবন্ধক প্রমথ চৌধুরীর বাড়ি উদ্ধার করে স্মৃতি পাঠাগার করা হয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/২৮নভেম্বর/কেআইবি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

পাবনায় কবর থেকে ১৫ কঙ্কাল উধাও 

ভৈরবে নিখোঁজের ৭ দিন পর ডোবায় মিলল যুবকের মরদেহ

গাইবান্ধায় জমি নিয়ে বিরোধে লাঠির আঘাতে একজনের মৃত্যু

৫০০ কোটি টাকা হাতানোর চেষ্টা প্রতারক চক্রের, এনএসআই ও পুলিশের যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার ৯

বিল বকেয়ায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন, অবৈধ বিদ্যুতে চলছে ইউপি কার্যালয়

কেজি দরে অপরিপক্ব তরমুজ, পিস চাইলে দাম আকাশ ছোঁয়া

লক্ষ্মীপুরে যুবলীগ নেতার চোখ উপড়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা

ফেনী সরকারি কলেজে শিক্ষার্থীদের গণইফতারে ছাত্রলীগের হামলা, আহত ১০

মধ্যরাতে ফের মিয়ানমারের গুলির শব্দে কেঁপে উঠল টেকনাফ সীমান্ত

উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক, দুর্ঘটনা তদন্তে ৪ সদস্যের কমিটি

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :