সাংবাদিকতা: চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে
১৯৯৯ সালে যখন এই প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন নিতান্তই একটি ‘প্রতিবন্ধী’ সময় ছিল। শামসুন নাহার হলে আমাদের এক বন্ধুর বাস ছিল। কখনো তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে একটা এবং একমাত্র প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হতো। হল গেটে স্টাফ বা অন্য কোনো পরিচিত-অপরিচিত বন্ধু, বড়বোন-ছোটবোনের কাছে ধর্ণা ধরতে হতো। তাদেরকে অনুরোধ করে চিরকুটে বন্ধুর নাম ও রুম নম্বর লিখে ধরিয়ে দিতাম। এর নাম ছিল ‘কল’ দেয়া। অনুনয় করে বলতাম, ‘প্লিজ, একটা কল নেবেন।’ ভেতরে গিয়ে কখনো সদয় হয়ে ডেকে দিলে বন্ধুর সাক্ষাৎ মিলতো। নইলে আবার আরেকজনকে একইভাবে চিরকুট ধরিয়ে দেয়ার তপস্যা চলতো। একইধরনের রীতি অবশ্য ছাত্র হলগুলোতেও ছিল।
এই গল্প নিশ্চয়ই আমাদের এখনকার উত্তরসূরিদের কাছে আষাঢ়ে গল্প মনে হলেও হতে পারে; যদিও এটা গল্প নয়। হাতে হাতে এখন মোবাইল প্রযুক্তি। ছেলে বন্ধুটি হয়তো নিজের হল থেকে বের হওয়ার সময়েই মেয়ে বন্ধুটিকে বা মেয়ে বন্ধুটি তার ছেলে বন্ধুটিকে ‘কল’ করছে। তবে তা চিরকুটে নয়, ইথারে ‘আসছি, আসো।’ হোয়াটসআপ, ভাইভার, ইমু, ম্যাসেঞ্জারের সুবাদে কী হচ্ছে- সে কথা না হয় বাদই দিলাম।
মোবাইল টেকনোলজিসহ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবাদে এই পরিবর্তন। এটাকে ইতিবাচক বলবো, না নেতিবাচক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে এই সেবা যে হল গেটের কর্মচারীদের বেকার করেছে বা হলের অন্য ছাত্রীদের উটকো ঝুট-ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে- তাতে সন্দেহ নেই। অন্যভাবে বললে, ‘কল’ দেয়াকে কেন্দ্র করে কিছু কর্মচারীর বাড়তি ও টুকটাক আয়ের রাস্তা বন্ধ করেছে এই টেকনোলজি। অর্থ্যাৎ, মানব-সভ্যতায় টেকনোলজির উপস্থিতি জীবনকে সহজ করার পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক দিক নিয়ে এসেছে। গণমাধ্যম বিশেষ করে সাংবাদিকতায় এই দুই প্রভাবের বিষয়েই আমরা এখানে আলোকপাত করবো।
দুই.
মানবসভ্যতার ইতিহাসে আজ পর্যন্ত তিনটি শিল্পবিপ্লব গত হয়েছে। বর্তমানে আমরা যে সময়টায় প্রবেশ করেছি সেটি ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কা ‘। প্রাত্যহিক জীবনে টেকনোলজির এই যে ব্যবহার এবং তার ফলে মানবসভ্যতায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, তাকেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বলে অভিহিত করা হচ্ছে। প্রথম শিল্প বিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ। তবে আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এ নিয়েই এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। মূলত ডিজিটাল বিপ্লবকেই বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
তিন.
প্রশ্ন হচ্ছে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কী? ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান অধ্যাপক ক্লস শোয়াব (Klaus Schwab) প্রথমবারের মতো এটি বিশ্বব্যাপী আলোচনায় আনেন। ফোরামের ৪৬তম বার্ষিক সভা সামনে রেখে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাতে তিনি এই বিপ্লবের বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন। তার মতে, স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ (কৃত্রিম মানুষ), রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লœবের সূচনা করেছে। ওই প্রবন্ধে ক্লস শোয়াব আরও বলেন, আমরা চাই বা না চাই, এতদিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা যেভাবে চলেছে, সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল এ বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনো হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে। যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমনকি রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়া।’গতবছর বিশ্বব্যাংক ‘ডিজিটাল ডিভিডেন্ডস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে কীভাবে যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উপার্জন হচ্ছে এবং এক্ষেত্রে নির্ভরতা কতটা বেড়েছে সে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
চার
প্রশ্ন উঠেছে, অনাগত সেই পরিবর্তন, গতি আর চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বা সাংবাদিকতার অবস্থান কোথায়? এই প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধানের চেষ্টাও হয়েছে ইতিমধ্যে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের বেসরকারি রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয় জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিকে সঙ্গে করে বিশ্বের ১৩০টি দেশে ১২টি ভাষায় সমীক্ষায় চালায় ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্টস’ (আইসিএফজে)। সংস্থাটি তাদের সমীক্ষার নির্বাহী সার-সংক্ষেপে উল্লিখিত প্রশ্নের জবাব তুলে ধরে বলেছে, ‘আমাদের সমীক্ষা একটি ক্রিটিক্যাল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছে। তা হচ্ছে, ডিজিটাল বিপ্লবের সঙ্গে সাংবাদিকরা কী গতিশীল থাকতে পারছে? নতুন প্রযুক্তির বড় বড় উদ্ভাবন সত্ত্বেও আমাদের কাছে উপসংহার হচ্ছে, না।’
সমীক্ষায় আইসিএফজে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা-সংশ্লিষ্ট ২৪ ধরনের মৌলিক প্রবণতা চিহ্নিত করেছে। এতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বার্তাকক্ষগুলো এখন পর্যন্ত গভীরভাবে টেকনোলজির ঘাটতি (গ্যাপ) মোকাবেলা করছে। অর্থ্যাৎ, মানুষের কাছে সময়মত ও সঠিক তথ্যসহ (সোর্সকে ব্যবহার/প্রকাশ বা ঝুঁকিতে ফেলা ছাড়া) পৌঁছানোর মিশনে যেতে সাংবাদিকদের ডিজিটাল দক্ষতার ঘাটতি বেশ। বার্তাকক্ষের মাত্র ৫ শতাংশ কর্মীর টেকনোলজি-সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি আছে। ২ শতাংশ কর্মীর টেকনোলজির বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। ডিজিটাল বিপ্লব ঘটে চললেও বেশির ভাগ বার্তাকক্ষ (৮২ শতাংশ) সনাতনী স্থাপনা দিয়েই চলছে। অর্থ্যাৎ, ওইসব গণমাধ্যমের রিপোর্টার, সম্পাদক, সম্পাদকীয় লেখকরা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে কম সম্পৃক্ত। অধিকাংশ গণমাধ্যম মৌলিক বিশ্লেষণী ডেটা ব্যবহার করে সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। এটা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে পিছিয়ে রাখে। অথচ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম কোম্পানি, এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানি বা অন্য প্রযুক্তি-পরিচালিত কোম্পানি ভোক্তার আচরণ ও ব্যবহারকারীর প্রত্যাশা-সম্পৃক্ততা পর্যালোচনা ও বিবেচনা করে।
এ অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সম্পাদক, ডিজিটাল কনটেন্ট উৎপাদক, অ্যানালাইটিক এডিটর গোত্রীয় মাত্র ১৮ শতাংশ গণমাধ্যমের নতুন ডিজিটাল সংশ্লিষ্টতা (Role) পরিলক্ষিত হয়েছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, বিশ্বের অর্ধেকেরও কম সাংবাদিক ও বার্তাকক্ষ (গণমাধ্যম) তাদের যোগাযোগ সুরক্ষিত রাখে। সাংবাদিকদের অত্যাধুনিক ডিজিটাল দ্রব্যাদি ব্যবহার প্রবণতা, জ্ঞান ও এরসঙ্গে পরিচিতি খুবই কম। যারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করেন তারা তা করেন কেবল প্রতিবেদনের ধারণা খুঁজতে। এক্ষেত্রে দৈন্য এমনই যে, মাত্র ১১ শতাংশ ভেরিফিকেশন টুলস ব্যবহার করে। সমীক্ষাকালে ২৩ ধরনের ডিজিটাল দ্রব্যাদির দক্ষতা দেখার চেষ্টা করা হয়। এরমধ্যে প্রাথমিকভাবে চার ধরনের ব্যবহারের সঙ্গে তাদের পরিচিতির তথ্য পাওয়া গেছে।
অবশ্য এতসবের মধ্যে যারা ডিজিটাল সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছেন তারা যথেষ্ট সুফল পাচ্ছেন। সম্পূর্ণ ডিজিটাল এবং হাইব্রিড গণমাধ্যম (যেসব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান সনাতনী এবং ডিজিটাল মাধ্যমের সংমিশ্রণে পরিচালিত হচ্ছে) সনাতনী সাংবাদিকতাকে উৎরে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ইউরোশিয়ার দেশগুলো এগিয়ে (৫৫ শতাংশ)। তবে ডিজিটাইজেশনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মন্দগতি পরিলক্ষিত। আইসিএফজে বিশ্বকে আটটি অঞ্চলে ভাগ করে সমীক্ষাটি চালায়। এরমধ্যে একমাত্র দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো উত্তরাধিকার বা সনাতনী (লিগ্যাসি) গণমাধ্যম প্রভাব বিস্তার করে আছে। সেখানকার ৪৩ শতাংশ বার্তাকক্ষ এখনও সনাতনী ধাঁচের। সমীক্ষায় ভুয়া সংবাদ ও হ্যাকিংয়ের ব্যাপারে পূর্ব সতর্কতা, পাঠক ও দর্শকের বিশ্বাস-গ্রহণযোগ্যতা অর্জন, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের আয়ের (রেভিনিউ) ও বিকল্প উৎস সৃষ্টি, সংবাদ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশ্লেষণী তথ্যের ব্যবহার ইত্যাদি বিভিন্ন দিক নিয়েও কাজ করেছে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, সাংবাদিকতা তরুণশ্রেণির পেশা। ডিজিটাল বার্তাকক্ষের বেশির ভাগ কর্মীর বয়স ২৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। হাইব্রিড ও সনাতনী গণমাধ্যমের কর্মীদের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। ৫২ শতাংশ সাংবাদিক ডিজিটাল সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ চাইলেও ৪০ শতাংশ গণমাধ্যম অবশ্য এটা ব্যবস্থা করেছে।
বার্তাকক্ষের ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জও অনুসন্ধানের চেষ্টা দেখা গেছে সমীক্ষায়। নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে মোটাদাগে তিনটি উল্লেখ করা যায়। এগুলো হচ্ছে, আয়ের ধারা অব্যাহত রাখা, একনিষ্ঠ পাঠককুল এবং পাঠক-দর্শকের বিশ্বাসযোগ্যতা। বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে অবশ্য ইউরেশিয়া এবং উত্তর আমেরিকার গণমাধ্যমের ভিন্ন অবস্থান আছে। ওইসব অঞ্চলের ৩০ শতাংশের কম মানুষের গণমাধ্যমের ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি আছে। তবে দক্ষিণ আমেরিকার চিত্র ভিন্ন। সেখানকার ৫০ শতাংশ উত্তরদাতা বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রধান ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
পাঁচ.
একদশক আগে শুরু হওয়া এই নয়া-বিপ্লবকে শোয়াব আলোচনায় তুলে আনলেও তা এখনো সূচনা পর্যায়েই আছে। ডিজিটাইজেশনের ফলে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশাল পরিবর্তনের এই যে বাস্তবতা, এর মধ্যগগণ বা অন্তিম কোথায়- তার আগাম পূর্বাভাস অসম্ভবই বটে। তবে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন, অর্থনীতি, জাতীয়-আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, সার্বিক রাজনীতি, জাতীয় নিরাপত্তাসহ মানুষের জীবনের এই বিপ্লব যে পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে, তা ভয়াবহ গতির পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে- এমন বলাটা নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না।
এমন পরিস্থিতিতে মোটাদাগে আইসিএফজে গণমাধ্যম পরিস্থিতি চিহ্নিত করেছে তা উদ্বেগজনক বটে। সংস্থাটি নতুন বিপ্লবে গণমাধ্যমের অনুগামী হওয়ার উপযোগিতাকে এক শব্দে ‘অনুপযুক্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আগামী দিনের গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য যে তিনটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে, তার একটি (বিশ্বাসযোগ্যতা) অনেকদিন ধরেই আছে। গণমাধ্যমের আয়-উৎসও আগে কম-বেশি ছিল। এসব নিয়েই গণমাধ্যম এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যে টেকনোলজিক্যাল অভিযোজনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে তা আয়ত্বের বিকল্প কোথায়? তথ্যপ্রযুক্তির কারণে একনিষ্ঠ পাঠক-দর্শকের চ্যালেঞ্জও প্রাতিষ্ঠানিক অস্তিত্বের হুমকি নিয়ে আসবে বৈ কি!
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক যুগান্তর