‘জীবনে মানুষ দেখলাম দুইডা; শেখ হাসিনা আর আনিসুল হক’

প্রকাশ | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৪১

শেখ আদনান ফাহাদ

মোহাম্মদ নূর ইসলাম, মিরপুর ১৩ নম্বরের বাসিন্দা।  সিএনজি অটোরিকশা চালান। শহরে ‘উবার’ আর ‘পাঠাও’ এসে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে তাঁকে। জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। এক লাখ ৯ হাজার টাকা দিয়ে মোটর সাইকেল কিনে রেখে দিয়েছেন। কাগজপত্র পেয়ে গেলে আসছে জানুয়ারি থেকে পাঠাও এর মোটর সাইকেল চালাবেন।

‘আপনি ‘পাঠাও’ চালালে, সিএনজি মালিকের কী হবে? জবাবে দুই সন্তানের বাবা, নূর ইসলাম কড়া উত্তর দিলেন-‘মালিক বহুত কামাইসে, ১২০০ টাকা প্রতিদিন দিতে হয় তারে। আমি পাই বা না পাই, মালিকের কোনো মিস নাই! বাঁচতে হইলে, নতুন কিসু করত হইব। তাই পাঠাও চালামু’।

রবিবার যুবক রাতের আরাম বাতাসের সঙ্গে মিতালি করতে করতে হাতিরপুল থেকে এয়ারপোর্ট এলাকায় আসার সময় নূর ইসলামের সাথে কথা বললাম। এই খেটে খাওয়া মানুষের কাছে যে সত্য বাস্তবের পরিচয় আপনি পাবেন, সেটা আর কারও কাছে সম্ভব না। দেশের বড় বড় রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যে কথা বলতে পারেনা, সে কথা অবলীলায়, অকপটে বলে ফেলে এই নূর ইসলামেরা। এই নূর ইসলামরা ভবিষ্যৎ দেখতে পায়।

‘উবার’ আর ‘পাঠাও’ সেবার চাপে পড়ে সিএনজি চালকদের আচরণে কী পরিবর্তন এসেছে, অনুধাবন করার জন্য কয়েকদিন ধরে দূরে কোথাও গেলে সিএনজিতে যাচ্ছি। বদলে যাওয়া সময়ের সাক্ষী হতে ঢাকায় এখন সবার একটু চোখ-কান খোলা রাখা উচিত। ঢাকার বাসিন্দাদের চিন্তায়, পর্যবেক্ষণে যে বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ এই সিএনজি চালক নূর ইসলাম। এক সিএনজি চালককে মাস তিনেক আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘উবার’ সার্ভিসে তাদের কোনো ক্ষতি হবে কি না? সে চালক খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিল, উবারে তাদের কিছু যায় আসে না। ঢাকায় নাকি কোনোদিন মানুষের অভাব হবে না, তাই তাদের আরোহীরও অভাব হবে না! অথচ এখন সিএনজি চালকরা যাত্রীদের আগে থেকেই জিজ্ঞেস করে বসে, ‘মিটারে যাবেন, না চূক্তিতে যাবেন?

নূর ইসলামের সাথে কথা বলার সময় চিন্তা করলাম, সদ্য প্রয়াত আনিসুল হক সম্পর্কে কোনো ভাবনা আছে কি না, জানার চেষ্টা করি। আনিসুল হকের নাম উচ্চারণ করতেই নূর ইসলামের লেকচার আবার শুরু। বহু ওজনদার মন্তব্য করলেন নূর ইসলাম। বললেন, ‘ জীবনে মানুষ দেখলাম দুইডা, শেখ হাসিনা আর আনিসুল হক। বয়স তো খুব বেশী না। কত হইব? ৪০ এর বেশি না! এই জীবনে সবাইরে দেখলাম বাটপারি করতে। কয় একটা, করে আরেকটা। কিন্তু এই শেখ হাসিনা আর আনিসুল হক পুরাই উল্টা। এখন শেখ হাসিনা কেমনে কী করে, সেটাই দেখবার বিষয়। ইমুন একটা মেয়র কই পাইব উনি?

নূর ইসলাম জানালেন, আনিসুল হক উত্তরা ও মিরপুরের রাস্তাগুলো বড় করেছেন, খোলা ডাস্টবিন গুলো সরিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ঘর করে সেখানে ময়লা রাখার ব্যবস্থা করেছেন। নূর ইসলাম বললেন, ‘আগে যহন ডাস্টবিনের সামনে গাড়ি থামাইতাম, মনে হইত এক্ষনি বমি হইয়া যাইব’।

সেদিন গেলাম উত্তরায়। রাস্তায়, ফুটপাতে আনিসুল হক কে খুঁজলাম। অনেক জায়গায় আনিসুল হকের উপস্থিতি দেখলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু মিজান রাসেলের সান্নিধ্যে ঘুরতে ঘুরতে উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরে ধলিপাড়া নামের জায়গায় গেলাম। বন্ধু রাসেল বলল, আগে এখানে মানুষ পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করত। বিশাল বড় এক ডাস্টবিন ছিল এখানে। গন্ধে টেকা দায় ছিল। আর এখন দেখলাম, একদম পরিষ্কার। এমন একাধিক জায়গায় গিয়ে স্বচক্ষে পরিবর্তনের সাক্ষী হতে পারলাম। উত্তরায় প্রায় ৮০ ভাগ রাস্তা ঠিক করে ফেলতে পেরেছেন আনিসুল হক বলে জানাল বন্ধু রাসেল। হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে রিকশা নিলাম। রিকশা চালক আলমগীর হোসেন এর বাড়ি দিনাজপুর। আনিসুল হকের প্রতি অন্যান্যদের মত সেও মুগ্ধ। বলল, আগের চেয়ে অনেক আরামে রিকশা চালাতে পারছেন তিনি। আমি বললাম, কীভাবে? বলল আগে রাস্তা ছিল ভাঙাচোরা। এখন আগের চেয়ে কম কষ্ট হয় তার।

এমন মেয়র কি আগে কখনো পেয়েছিল যাদুর শহর ঢাকা? হ্যা, আনিসুল হক আমাদের কষ্টের শহর ঢাকায় সব সমস্যার সমাধান করে যেতে পারেন নি। ৪৬ বছরের জঞ্জাল ২/৩ বছরে সাফ করা কোনো মানব সন্তানের পক্ষে সম্ভব না। আনিসুল হকের মত দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনও অনেক কাজ করার চেষ্টা করছেন। তবে আমার মনে হয়, আনিসুল হক বেশি সফল ছিলেন। ময়লা ব্যবস্থাপনার তুলনা করলে, আনিসুল হক অনেক বেশি মার্কস পাবেন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে সায়েন্সল্যাব আসতে রাস্তার উপর পড়ে থাকা , বিকট গন্ধ ছড়ানো খোলা ডাস্টবিনগুলো দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতার স্মারক বহন করছে। এমন অনেক ডাস্টবিন খোলা অবস্থায় রোগ-জীবাণু, গন্ধ ছড়াচ্ছে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকায়। তবে হকার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, ফুটপাত পুনরুদ্ধার ইত্যাদি কাজে সাঈদ খোকনও অনেক সাফল্য দেখিয়েছেন। কিন্তু আমিনবাজার, গাবতলি বাস স্ট্যান্ড আর তেজগাঁও এর কুখ্যাত ট্রাক স্ট্যান্ড সাফ করে আনিসুল হক যেন যাদু দেখিয়েছেন। সিএনজি ড্রাইভার নূর ইসলাম এই দুই মেয়রের মধ্যে তুলনা করে দারুণ এক মন্তব্য করেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘একজন ভালো করলে, আরেকজনকেও বাধ্য হয়ে ভালো করতে হয়’।

রাজধানী শহরকে ভালোবেসে এর আমূল পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম উদ্যোগ হিসেবে সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করার উদ্যোগ নেয়া হয়। আমরা অনেকেই না বুঝে সে সময় ক্ষুব্ধ হয়েছি। সিটি কর্পোরেশন ভেঙ্গে দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত যে কতবড় আশীর্বাদ হয়ে এসেছে, সেটি এখন নিশ্চয় নিন্দুকরা স্বীকার করবেন। আনিসুল হকের প্রথমদিককার নানা সাক্ষাৎকার দেখে আমাদের কাছে বাগাড়ম্বর মনে হত। মনে হত জনপ্রতিনিধিরা কত কথা বলেন, আবার ভুলে যান। লোভনীয় মেয়র পদের জন্য প্রার্থীর অভাব ছিল না। কিন্তু শেখ হাসিনা কী করলেন! আনিসুল হককে খুঁজে পেলেন। আনিসুল হক! একসময়ের টেলিভিশন উপস্থাপক, পরবর্তীতে সফল ব্যবসায়ী। তিনি হবেন জনপ্রতিনিধি! আমারা অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলাম। ব্যবসায়ী তো মুনাফা বুঝবেন, সাধারণ মানুষের কষ্ট কী বুঝবেন? অথচ দেখেন, আনিসুল হক আমাদের সকলের আশংকা মিথ্যা প্রমাণিত করলেন।

আনিসুল হকের উপর অনেক ভরসা করেছিলেন মানবতার জননী-খ্যাত শেখ হাসিনা। সে ভরসার দাম দিতে দিনরাত পরিশ্রম করে ঢাকা মহানগরীর মোটা চামড়ায় বেশ ভালোই চিমটি কাটতে পেরেছেন আনিসুল হক। কাজ করতে করতে উপারেই চলে গেলেন। মানুষের মাঝে দিয়ে গেলেন আশা-আকাংখার বিশাল এক বেলুন। এখন এই বেলুন সামলানোর গুরুদায়িত্ব পালন করবেন কে? বেলুন যেন ফুটো হয়ে না যায়। আরেকজন আনিসুল হক খুঁজে বের করতে হবে এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে। সময় বেশি নেই সামনে। ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন যাত্রাকে বেগবান করতে হলে শেখ হাসিনার এখন অনেক আনিসুল হক দরকার। আপাতত একজন  আনিসুল হক খুঁজে পেতে হবে।

ইতোমধ্যেই আনিসুল হকের স্ত্রী বা ছেলেকে মেয়র পদে দেখতে চেয়ে অনেকে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন, ইভেন্ট পর্যন্ত খোলা হয়েছে। ইনারাই মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হবেন, না, অন্য কেউ হবেন, এই সিদ্ধান্ত আমরা জনগণ নিতে পারব না। নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে পারবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মনোনয়ন বোর্ড।  আমরা পারি শুধু সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।