কিশোর খোকনের কঠিন জীবন

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ২২:১৮ | প্রকাশিত : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৯:১১

পেছন থেকে ছবিতে যে ছেলেটাকে দেখছেন ওর নাম খোকন। যাত্রাবাড়ী-গাবতলী রুটের ৮ নম্বর বাসের হেলপার। তবে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে গত কয়েকদিন কাজ বন্ধ।

মা-বাবার বিচ্ছেদের পর ছোট বোনকে নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপার এলাকায় দাদির কাছে বসবাস। কিন্তু কয়েকদিন ধরে কাজ নেই তাই ঘুরে ফিরে দিন কাটছে। ক্ষুধার জ্বালা বেশি বেড়ে গেলে কারো কাছ থেকে অনুরোধ করে পেলে খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। তবে এই কিশোরের চাহিদা খুব বেশি না! একটা রুটি আর এক কাপ চা হলেই হবে।

রবিবার রাতে মিরপুর থেকে বাসায় ঢোকার আগে ঢাকা মেডিকেল মোড়ে পেনাং রেস্টুরেন্টে বসে খাবারের অর্ডার করে অপেক্ষা করার সময় ছেলেটির সঙ্গে দেখা। খিচুরি আর ডিম ভাজি নিয়ে আসতে আসতেই পুরানো একটা শীতের পোশাক গায়ে ১৩/১৪ বছর বয়সী ছেলেটি এসে বললো ভাইয়া, ‘এক কাপ চা খাওয়াইবেন? আমার কাছে একটা রুডি আছে এইডা দিয়া খামু। সারাদিন কিছু খাই নাই।’

প্রথমে মনে হয়েছিল চাঁনখারপুর এলাকায় অনেক নেশাখোর লোকজন থাকে ওদের কেউ কি না। পরে জানতে চাইলাম, ‘কী করো?’

বলল, ‘ভাইয়া ৮ নাম্বার গাড়িতে কাজ করতাম। অ্যাক্সিডেন্ট করছি এহন কাম করতে পারি না ।’

ওয়েটারকে চা দিতে বললাম। পাশের চেয়ারে বসে পকেট থেকে পলিথিনে মোড়ানো একটা রুটি বের করার দৃশ্য দেখে সত্যি মনটা ভারী হয়ে উঠলো। ভাবলাম,একটা রুটি নিয়ে ছেলেটা হয়তো অনেকক্ষণ ঘুরছে। কিন্তু কারো কাছে এককাপ চা আবদার করতেও সংকোচ বোধ করছিল।

খাওয়া শেষ করে আড়চোখে দেখলাম, তৃপ্তিভরে চা দিয়ে রুটিটা ভিজিয়ে খাচ্ছে খোকন। খেয়াল করলাম ওয়েটারও ফাঁকে ফাঁকে ওকে দেখছিল। মনে হচ্ছিল, অনেক ক্ষুধার্ত ছেলেটা।

মাঝে দুই বার বললাম, ‘তুমি আর কিছু খাও’। ছেলেটি বলল, ‘না ভাইয়া এতেই হবে।’

চা-রুটি খেয়ে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাইয়া ধন্যবাদ! আমি যাই।’

একটা ছেলে হয়তো আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না, লেখাপড়াও হয়তো করতে পারেনি, কিন্তু ওর ভদ্রতা দেখে আমি মুগ্ধ।

ওকে আবার বললাম, ‘তুমি আর কিছু খাও। খিচুরি আছে, ভাত আছে।’

আবার জবাব মিলল, ‘না ভাইয়া, রুটি আছিল, এইডা তো খাইছি। আর খামু না।’

আবার জোর করায় বলল, ‘তাইলে একটা রুটি আর চা দেন, তাইলেই হইব।’

ওয়েটার একটা রুটি আর চা দিল। খাওয়া শুরু করার পর ছেলেটির টেবিলের পাশে এক তরুণীসহ তিনজন দাঁড়ানোর সাথেই সাথেই ছেলেটি উঠে বললো, ‘আপনারা বন। আমি ওই হানে যাই।’

সম্ভবত তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হবেন। খাবার নিয়ে উঠে যাবে দেখে এদের একজন বললেন,‘আরে ব্যাটা তুই খাওয়া শেষ কর! তাড়াতাড়ি না, আস্তে আস্তে খা। যতক্ষুন লাগে ততক্ষণ আমরা দাঁড়াইয়া আছি।’ শুনে খুব ভালো লাগল।

ছেলেটিকে খাবার শেষ করে আসার জন্য বলে কাউন্টারে গিয়ে বিল দিয়ে হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবলাম ওর সঙ্গে একটু কথা বলি। মিনিটখানেক পরে ছেলেটি বের হয়ে আবার ধন্যবাদ দিয়ে বললো, ‘ভাইয়া ভালো থাইকেন।’

পরে জানতে চাইলাম ওর পরিচয়, কোথায় থাকে, কী করে, পরিবারে কে কে আছে।

গড়গড় করে বলতে থাকল ওর জীবন কাহিনি। ওর নাম খোকন। সানারপার এলাকায় জন্ম। মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে বেশ কয়েকবছর আগে। মা বাবা দুজনই আবার বিয়ে করে যে যার যার মত সংসার পেতেছে। মা চিটাগাং রোডে নতুন স্বামীর সঙ্গে বাস করছে। সেখানে নাকি বাড়িও করেছে। বাবার কোনো খোঁজ নেই।

ছোট বোনকে নিয়ে খোকন সাইনবোর্ড এলাকায় দাদীর সঙ্গে থাকে। মাঝে মাঝে মা এসে খোঁজ নিলেও অর্থকরি দেন না। তাই জীবন বাঁচাতে বাসের হেলপারের কাজ করে যা পায় তা দিয়ে ছোট বোনকে নিয়ে দাদীর সঙ্গে থাকে খোকন।

খোকনের ভাষায়, ‘হ্যারা হ্যাগো জীবন লইয়া আছে। আমরা আমগো জীবন লইয়া আছি।’ সবশেষ বলল, ‘ভাইয়া অনেক রাত হইছে। এহন দেহি লেগুনায় নিলে সানারপার যামু।’

খোকন যখন রাস্তা পার হচ্ছিল। পিছন থেকে মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে আমিও বাসার দিকে পা বাড়ালাম। আর মনে মনে ভাবলাম-জীবন কতই না কঠিন।

ঢাকাটাইমস/০৪ডিসেম্বর/বিইউ/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :