বিবিধ ছাত্রলীগ ও আশির দশকের ঐক্যের রাজনীতি

প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:১৭ | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ২০:০৪

তারেক হাসান
ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে সম্মাননা জানাচ্ছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মো. মনসুর আহমেদ।

(১) ছাত্রলীগের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। আওয়ামী লীগের জন্মেরও বছর দেড়েক আগে। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন বা সহযোগী সংগঠন ছিল না। তারা স্বতন্ত্র কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম চালাত ছাত্রকেন্দ্রিক, ছাত্রদের দ্বারা।  ষাটের দশকের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রতি ছাত্রলীগের আনুগত্য, নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে আনতে সক্ষম হন, যা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ঘটনা।

শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।  ছাত্রলীগের উপর বঙ্গবন্ধুর প্রভাব আগে থেকেই ছিল তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে ছাত্রলীগের অবদান নতুন করে বলার কিছু নেই।

মধ্য-ষাট বা পর্যন্ত ছাত্রদের মাঝে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল বামপন্থী সংগঠন ‘ছাত্র ইউনিয়ন'। সেটি অবশ্য দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল- সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী ও চীনপন্থী। সোভিয়েতপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন মতিয়া চৌধুরী, চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন রাশেদ খান মেনন। তাঁরা দুজন ছাত্ররাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়ার পরেও এমনকি সত্তরের দশকেও ছাত্র ইউনিয়নের এ দুদেশপন্থী সংগঠনকে 'মতিয়া গ্রুপ' ও 'মেনন গ্রুপ' নামেই ডাকা হতো!

ছাত্র ইউনিয়নের তুমুল জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক শক্তিকে ডিঙিয়ে ষাটের দশকের শেষাংশে ছাত্রলীগের উত্থান ও ছাত্র সংসদগুলোতে বিজয়ের ধারা দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ও নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত হয়ে ওঠার ইঙ্গিত বহন করে বৈকি।

১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের বিরোধের জেরে তৈরি হল নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। তো জাসদও তাদের ছাত্রসংগঠনের নাম ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’-ই রাখল।

জাসদের ছাত্রলীগ ৯০ সাল পর্যন্ত যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। আওয়ামীপন্থী ছাত্রলীগের বাইরে এটির নাম এখনো টিকে আছে- ছাত্রলীগ (জাসদ)। সত্তরের দশকের শেষদিকে জাসদ ভেঙে নতুন দল হয় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। বাসদও তাদের ছাত্রসংগঠনের নাম দেয় - বাংলাদেশ ছাত্রলীগ!

পরিসংখ্যান দেখায় বাসদের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক শক্তি (?) আওয়ামী লীগপন্থী ছাত্রলীগ, জাসদের ছাত্রলীগ ও ক্ষমতাসীন বিএনপির সামরিক মদদপুষ্ট ছাত্রদলের চেয়ে বেশি ছিল, অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো অবশ্যই।

১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদের ভিপি ছিলেন বাসদ ছাত্রলীগের যথাক্রমে মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান। তাঁদের পূর্ববর্তী সংগঠন জাসদ ছাত্রলীগ অভিযোগ করতো- মান্না, আখতারুজ্জামান ও আখতারুজ্জামান পরিষদের জিএস জিয়াউদ্দিন বাবলু জেনারেল জিয়ার সরকারের সাথে জোগসাজস করে চলতেন এবং নিয়মিত বঙ্গভবনে যেতেন।

পরে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, সবাইকে বিস্মিত করে  ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডাকসুর জিএস বাবলু এরশাদের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সেনা-গোয়েন্দাদের সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন।

এরশাদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে উপমন্ত্রী করেন। তখন বাবলু ছিলেন সবচেয়ে কমবয়সী মন্ত্রী। অবশ্য ভিপি আখতারুজ্জামান আশির দশকজুড়ে  অপরাপর ছাত্রনেতাদের সাথে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

(২)

১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে দেশে আসেন তখন আওয়ামী লীগপন্থী ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন ওবায়দুল কাদের। সাধারণ সম্পাদক বাহালুল মজনুন চুন্নু। ওবায়দুল কাদেরের পর ছাত্রলীগের সভাপতি হন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন।

শেখ হাসিনা পরে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করেন খ ম জাহাঙ্গীরকে। কিন্তু আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বাহালুল মজনুন চুন্নুকেই সাধারণ সম্পাদক রেখে ফজলুর রহমানকে সভাপতি করে ছাত্রলীগের পাল্টা কমিটি দাঁড় করান।

বাহাত্তরে ছাত্রলীগের কমিটিকে কেন্দ্র করে গঠিত হয়েছিল জাসদ, আশির দশকের শুরুতে সে ছাত্রলীগের কমিটিকে কেন্দ্র করে ভাঙল আওয়ামী লীগ। সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকসহ দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এদিকে জালাল-জাহাঙ্গীর (জা-জা) ও ফজলু-চুন্নু (ফ-চু) উভয় গ্রুপই নিজেদের প্রকৃত আওয়ামী লীগপন্থী ছাত্রলীগ বলে দাবি করত। তারা একে অন্যকে অস্বীকার করত।

আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে গঠন করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। যে বাকশালের ১৯৭৫ সালে জন্ম হয়ে ওই বছরেই মৃত্যু হয়, তাকে নামের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হন আবদুর রাজ্জাক। পঁচাত্তরে বাকশালের ছাত্রসংগঠনের নাম ছিল 'জাতীয় ছাত্রলীগ'। আবদুর রাজ্জাকও তাঁর বাকশালের  ছাত্রসংগঠনের নাম দেন 'জাতীয় ছাত্রলীগ’।

এখানে উল্লেখ করে রাখা ভালো যে- আওয়ামী লীগপন্থী  ছাত্রলীগে আবদুর রাজ্জাকের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। সুতরাং ফজলু-চুন্নু গ্রুপ বা 'জাতীয় ছাত্রলীগ' শেখ হাসিনাপন্থী ছাত্রলীগের থেকে খুব দুর্বল ছিল এটা ভাবা ঠিক হবে না।

১৯৮২ সালে আমরা অন্তত পাঁচটি ছাত্রলীগের অস্তিত্ব পাই-

১.  ছাত্রলীগ ( জালাল-জাহাঙ্গীর) [হাসিনাপন্থী]

২.  ছাত্রলীগ (ফজলু-চুন্নু) [রাজ্জাকপন্থী]

৩. ছাত্রলীগ (মুনিরউদ্দীন-হাসিব খান) [জাসদপন্থী]

৪.  ছাত্রলীগ (আখতারুজ্জামান-জিয়াউদ্দিন বাবলু) [বাসদপন্থী]

৫. ছাত্রলীগ (প্রধান) [শফিউল আলম প্রধান বঙ্গবন্ধুর আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সেভেন মার্ডার' মামলার অভিযোগে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হন এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দণ্ডিত হন। জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি ছাড়া পান!]

জাসদ ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের শক্ত বিরোধীপক্ষ হিসেবে আভির্ভূত হলেও জেনারেল জিয়াউর রহমান ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ইত্যাদি কঠোর  ব্যবস্থার মাধ্যমে জাসদের রাজনীতিকে প্রায় শেষ করে দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় প্রেসিডেন্ট  জিয়ার বিরুদ্ধে যে ‘১০ দলীয় জোট’ নামে বিরোধী জোটটি ছিল সেখানে আওয়ামী লীগ, জাসদের সহাবস্থান, সম্মিলন ঘটেছিল।

এমন নয় যে- ছাত্রলীগ নাম নেওয়া সংগঠনগুলো একে অপরকে অস্বীকার করে পরস্পরের সাথে মিলত না। তাঁরা উপলব্ধি করেন যে এভাবে পরস্পরের মধ্যে কলহ জিইয়ে রাখলে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তীব্র করা যাবে না। ফলে ১৯৮২ সালেই মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাঁরা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে বহুধাবিভক্ত ছাত্রলীগগুলো ছাড়াও ছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রী, সমাজবাদী ছাত্রজোট ইত্যাদি।

অনেক পরে এদের সাথে যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দেয় বিএনপিপন্থী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। তবে সময়ে সময়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সঙ্গে মতবিরোধ ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদভুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলো। আবার নানান সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে মতের অমিলে অনৈক্য দেখা দিয়েছে। মিল অমিলের মধ্য দিয়েই নব্বই পর্যন্ত ছাত্রদের এ সংগঠনগুলো এরশাদের সরকারের বিরুদ্ধে লড়ে গেছে এবং শেষ পর্যন্ত এরশাদের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল।

(৩)

আমরা ৮২ সালের ছাত্রলীগের বহুধাবিভক্তির একটা চিত্র দেখেছি। এবার '৮৮ সালের ছাত্রলীগগুলোর নেতৃত্বের দিকে একটু চোখ বুলাই-

১.  ছাত্রলীগ (সুলতান মনসুর-আবদুর রহমান) [আওয়ামী লীগপন্থী]

২.  ছাত্রলীগ (মুশতাক হোসেন-নাজমুল হক প্রধান) [জাসদপন্থী]

৩.  ছাত্রলীগ (শাহাবুদ্দীন-সাইদুল ইসলাম) [বাসদপন্থী]

৪.  জাতীয় ছাত্রলীগ (নূরুল ফজল বূলবুল-ইনায়েতুর রহীম) [বাকশালপন্থী]

 পরে জাতীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হন জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু- এস.এম. কামাল হোসেন

৫.  ছাত্রলীগ (মামুন-জহিরুল)

৬.  ছাত্রলীগ (শাজাহান সিরাজ-ইমদাদুল হক)

৭.  ছাত্রলীগ (শফিউল আলম প্রধান-লুৎফর রহমান)

পঁচাত্তরের পরে থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ডাকসুর নির্বাচনগুলোতে জাসদ থেকে বের হয়ে আসা বাসদের ছাত্রলীগের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য ছিল। এরশাদ ১৯৮২ তে ক্ষমতা দখল করার পর ১৯৮৯ সালে আট বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন হয়। সবগুলো ছাত্রলীগ ও বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় ঐক্যবদ্ধ প্যানেল দেওয়ার।

১৯৮২ তে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৮৯ সালেও মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ ছিল- এটা বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে তাৎপর্যবহ। নানান চিন্তাভাবনা, মত, পাল্টামতের পরে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ তাদের কেন্দ্রীয় প্যানেল গঠনে ঐক্যমতে পৌঁছায়। সিদ্ধান্ত হয় ভিপি পদের লড়বেন আওয়ামী লীগপন্থী ছাত্রলীগের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন জাসদপন্থী ছাত্রলীগের মুশতাক হোসেন এবং এজিএস পদে ছাত্র ইউনিয়নের নাসির-উদ-দুজা।

সুলতান-মুশতাক প্যানেলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বিএনপিপন্থী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের শামসুজ্জামান দুদু-আসাদুজ্জামান রিপন প্যানেল। সুলতান-মুশতাক পরিষদ পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভ করে। স্বাধীনতার পর এ প্রথম আওয়ামী লীগপন্থী ছাত্রলীগ (যারা নিজেদের মুজিববাদী ছাত্রলীগ হিসেবে পরিচয় দিত) থেকে কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি হলেন- সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ।

লেখক: ব্যাংকার

[email protected]