নাচঘর থেকে জাদুঘর

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:২১

রিফাত আলম, ঢাকাটাইমস

ইংরেজদের সময় রংমহল বললেই চিনতো সবাই। ভর সন্ধ্যায় বাইজীর আসর বসতো তখন। তারপর ফরাসি বণিকদের হাত ধরে বাণিজ্যকুঠি হিসেবে নামডাক হলো। সেখান থেকে নবাব পরিবারের হাতে পড়ে তাদের অন্দর মহলের সম্মান পেলো। আর এখন জাদুঘর। অথচ একসময় এপার বাংলা ওপার বাংলা মিলিয়ে বেজায় হাঁকডাক ছিলো এ বাড়িটার। বেশিদিনের পুরোনো কথা নয়, মনে হয় এইতো সেদিন। কালের পরিক্রমায় নাচঘর থেকে নবাববাড়ি, তারপর জাদুঘর। এককালে বুড়িগঙ্গার ঢেউ আছড়ে পড়তো এ বাড়ির ঘাটে। সেই ঘাট আর নেই, বুড়িগঙ্গাও মরতে বসেছে, শুধু বাড়িটাই এখন পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে। তবে সংস্কার হয়েছে দফায় দফায়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে জালালপুর পরগনার (বর্তমান ফরিদপুর-বরিশাল) জমিদার শেখ ইনায়েত উল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থানে একটি বাগান বাড়ি তৈরি করেন। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র বাগান বাড়িটি এক ফরাসি বণিকের কাছে বিক্রি করে দেন। ফরাসিরা বাণিজ্য কুটির হিসেবে এটি ব্যবহার করতেন। ১৮৩০ সালে বেগমবাজারে বসবাসকারী নওয়াব আবদুল গণির পিতা খাজা আলীমুল্লাহ এই কুঠিটি ক্রয় পূর্বক সংস্কার করে বসবাস শুরু করেন। নওয়াব আবদুল গণি ১৮৬৯ সালে প্রাসাদটি নতুন করে নির্মাণ করেন। ভবনটির অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ফলে পুরনো সেই ভবনের কোনো অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। নতুন ভবন নির্মাণের পর তিনি তাঁর প্রিয় পুত্র খাজা আহসান উল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন আহসান মঞ্জিল।

আইন করে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ হয় ১৯৫২ সালে। ঢাকার নবাব এস্টেটের পুরোটাই সরকার অধিগ্রহণ করে। নবাব পরিবারের সম্পত্তির মধ্যে অধিগ্রহণ বহির্ভূত ছিল আহসান মঞ্জিল ও তৎসংলগ্ন আঙিনা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নবাব পরিবারের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা বিদেশে পাড়ি জমান। এ দেশে যাঁরা ছিলেন তাঁরা বিরাট এই প্রাসাদ ভবনের রক্ষণাবেক্ষণে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তাই আস্তে আস্তে বাড়িটা ভুতের বাড়িতে পাল্টে যায়। ১৯৭৪ সালে নবাব পরিবারের উত্তরসূরিরা আহসান মঞ্জিল নিলামে বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভবনটির রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করে, ১৯৭৪ সালের ২ নভেম্বর, প্রাসাদ ভবনটি নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন। এরপর সংস্কার করে এখানে জাদুঘর ও পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশ দেন।

১৯৮৫ সালের ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের এক নির্দেশে এটিকে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে 'আহসান মঞ্জিল জাদুঘর' হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। পুরো বাড়ির ভেতর বাহির বদলে প্রদর্শণীর উপযোগী করে তোলা হয়। স্থান পায় ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবারের নানান ব্যবহার্য আর নিদর্শন। ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

এখন আহসান মঞ্জিল বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের একটি শাখা হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। প্রতিনিয়ত দেশি বিদেশি হাজারো দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয়ে থাকে পুরো জাদুঘর এলাকা।

আহসান মঞ্জিলের জাদুঘরের দক্ষিণে রয়েছে বুড়িগঙ্গা নদী। নদীর দিকেই রয়েছে ভবনটির বারান্দা ও সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে সরাসরি ভবনটির দ্বিতীয় তলায় ওঠা যায়। কিন্তু সিঁড়িটি তিন খিলানবিশিষ্ট প্রবেশপথে গিয়ে শেষ হয়েছে। ভবনটির পূর্ব দিকের ফটকটি প্রধান ফটক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

আহসান মঞ্জিলের ওপরতলার পূর্বদিকে বৈঠকখানা, লাইব্রেরি ও অতিথিদের জন্য তিনটি কক্ষ রয়েছে। পশ্চিমদিকে রয়েছে নবাবদের শোয়ার ঘর ও বলনাচের ঘর। নিচের তলায় সমপরিমাণ কক্ষ, পূর্বদিকে খাবার ঘর আর পশ্চিম দিকে বিখ্যাত দরবার হল রয়েছে।

আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে নবাব পরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে মোট ২৩/২৪টি গ্যালারি রয়েছে। গ্যালারিতে আহসান মঞ্জিল পরিচিতি, ভবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সংস্কারপূর্ব ও পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন আলোকচিত্র, ঐতিহাসিক ঘটনা, নবাব পরিবারের সদস্যদের ভোজনালয়, ঢাল-তরবারি, অপূর্ব নিমার্ণশৈলীর প্রধান সিঁড়িঘর, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের বড় একটি তৈলচিত্র, বিরিয়ার্ড কক্ষ, ৯৪ লকার বিশিষ্ট সিন্দুক, নবাব পরিবারের বংশ পরিচিতি চিত্র, নবাব পরিবারের ঘনিষ্ঠ লেখক-গবেষকদের প্রতিকৃতি, নবাব সলিমুল্লার আলোকচিত্রসহ তার ব্যবহৃত অলঙ্কৃত চেয়ার, হুক্কা তরবারি, লৌহখাপ রয়েছে।

নবাবদের তাস খেলার ঘর, বিশিষ্ট ও রাজকীয় অতিথিদের বিশ্রামের জন্য স্টেট বেডরুম, বিদ্যুৎ ব্যবহার বিবিধ নিদর্শন, প্রাসাদ ড্রইংরুম, গোলাঘর, নাচঘর রয়েছে।

বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ঢাকা পূর্ব বাংলার রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হলে সেই সময় নবাব সলিমুল্লাহর সম্মানিত অতিথি হিসেবে গর্ভনর জেনারেল লর্ড কার্জন এ বাড়িতে কিছুদিন ঘুরে যান।

সরকারি আয়োজনে একজন গাইড দর্শকদের প্রদর্শনী বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়োজিত থাকেন। জাদুঘরে ঢুকলে শোনা যায় মিষ্টি মধুর সংগীত। প্রায় সারক্ষণই এ সুর বাজতে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি দর্শকের জন্য প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা, শিশুদের জন্য পাঁচ টাকা আর বিদেশি আগুন্তুকদের জন্য ৭৫ টাকা। প্রতিবন্ধীদের কোনো টিকিট কিনতে হয় না। আগে থেকে আবেদন করলে ছাত্রছাত্রীদের বিনা মূল্যে জাদুঘর দেখতে দেওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে আহসান মঞ্জিল। সপ্তাহের বাকি সবদিনই কম বেশি লোকজনের আসা যাওয়া থাকে। তবে ছুটির দিনগুলোতে ভিড় হয় বেশ। কালের পরিক্রমায় আজ নবাব পরিবারের বংশধররা নেই। নবাবী সেই শাসনও নেই। তবুও পড়ন্ত বিকালের হালকা সূর্যালোকে দর্শনার্থীদের চোখে ঝলমল করে ওঠে সেই প্রমোদভবন যা আজকের দিনের আহসান মঞ্জিল জাদুঘর।

(ঢাকাটাইমস/৫ডিসেম্বর/এসকে)