অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৫০

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ২১:৫৮

আলম রায়হান

সাপ্তাহিক সুগন্ধা কাগজ-এর চলার সঙ্গে পর্যায়ক্রমে যুক্ত হলেন অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর হিরু, মাহতাব উদ্দিন, আনিস রহমান, খায়রুল আলম বকুল, দেবব্রত চক্রবর্তী, নূরুল হাসান খান, লিটন এরশাদ, আহমেদ তৌফিক, সোহেল সানী, তপন দাশ, শাহিন রহমান, মঞ্জুশ্রী বিশ্বাস, ফরিদ নীরদ, গোলাম সরোয়ার ফোরকানসহ আরও অনেকে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুই মাসের মধ্যে পাঠকদের কাছে স্থায়ী অবস্থান করে নেয় সুগন্ধা কাগজ।  

একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য  অনেক লোক সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে ‘সফল হতেই হবে’  এমন একটি মনসতাত্তিক চাপ ছিল। এছাড়া  কৈশোরে শোনা চীনের একটি প্রবচন যৌবনেও ধারণ করতাম। তা হচ্ছে, মানুষ কেবল একটি মুখ নিয়ে আসে না; কাজের জন্য দুটি হাতও নিয়ে আসে। এরপরও স্বীকার করতেই হবে, সেসময় অনেকটা আতঙ্কের কারণে বেশি লোক সম্পৃক্ত করার প্রবণতা ছিল আমার। একই প্রবণতা দেখেছি নঈম নিজামেরও; হয়তো তিনি আতঙ্কের বদলে পরিকল্পিতভাবেই বেশি লোক সম্পৃক্ত করেছিলেন। উত্তম চক্রবর্তী, মারুফ চিনু, মোহসীন আব্বাস, শাবান মাহমুদ, শাহীন রহমান, সিদ্দিকুর রহমান মান্না, মশিউর রহমান, আরিফ রহমানসহ অনেক লোক সম্পৃক্ত করেছেন নঈম নিজামের তার বার্তা সংস্থা ‘নিউজ মিডিয়া’ দাঁড় করাবার ক্ষেত্রে। এ কাজ তিনি করেছেন দৈনিক ভোরের কাগজ ছাড়ার পর। সে সময় সাংবাদিকরা দৈনিক থেকে সাপ্তাহিক অথবা সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে ঘুরপাক খেতেন। এ গড্ডলিকা প্রবাহের বাইরে দাঁড়িয়ে নঈম নিজাম উদ্যোক্তা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রথম ধাপ; অগ্রসর এ চিন্তাই হয়তো পরবর্তী সময়ে তার আকাশচুম্বি সাফলের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।

অধিক জনবল নির্ভরতার বিষয়টি নাঈমুল ইসলাম খানকেও দেখেছি দৈনিক আমাদের সময়-এর সঙ্গে সূচনালগ্নে সম্পৃক্ত হয়ে, খুব কাছ থেকে। সব সময়ই তার অফিস কর্মীতে গিজগিজ করতে দেখেছি। আর এর ৮০ ভাগই তার বানিয়ে নেয়া; কাদামাটি দিয়ে নান্দনিক পুতুল গড়ার মতো। বাকি দশ ভাগ মেরামত করে নিয়েছেন। সাংবাদিক বানানোর এমন ক্ষমতা নাঈমুল ইসলাম খানের মতো আর কারো আছে বলে আমার মনে হয় না। তার সব উদ্যোগই জনবল নির্ভর। সেন্ট্রাল রোডে দৈনিক আমাদের সময় অফিস ভিজিট করতে এসে মহিরুহু সাংবাদিক এবি এম মুসা বলেছিলেন, ‘নাঈম, তুমি তো এক পত্রিকায় দুই পত্রিকার লোক নিয়েছো!’ কিন্তু কে তাকে বুঝাবে, আসলে জনবলই হচ্ছে মিডিয়ার সাফল্যের প্রধান ভিত্তি।

কেবল মিডিয়া নয়; যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে জনবল। আবার সঠিকভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেতে না পারলে এ জনবলই প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড় তে পারে। এমনকি ধ্বংসেরও কারণ হতে পারে অনিয়ন্ত্রিত জনবল। এটি গণমাধ্যমের জন্য অতি নির্মম বাস্তবতা। বহু বিনিয়োগের পরও যেসব পত্রিকা ও টেলিভিশন দাঁড়াতে পারেনি তার নেপথ্যে রয়েছে জনবলের কর্মদক্ষতা ব্যবহার করেতে না পারা এবং জনবল অনিয়ন্ত্রিত থাকা। অনেক পরে এ বিষয়গুলো অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করলেও শুরুতে এ বিষয়ে সতর্ক ছিলাম সহজাত প্রবণতা থেকে। ফলে সুগন্ধা কাগজ-এ অনেক লোকের আউটপুট পাবার ক্ষেত্রে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু এক পর্যায়ে টের পাচ্ছিলাম, পত্রিকা টিকিয়ে রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

বিরূপ অবস্থা নিয়ে শফিকুল আজিজ মুকুলের সঙ্গে আলাপ করলাম। সাপ্তাহিক ফসল-এ কাজ করার সূত্রে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি বলেন, ‘সামনে পরিস্থিতি আরও কঠিন ও জটিল  হবে। ফলে স্বল্প পুঁজির সাপ্তাহিক পত্রিকা টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে যাবে। দৈনিক পত্রিকা ফকিরের পুলে আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপননির্ভর হয়ে টিকানো যায়; যা সাপ্তাহিক পত্রিকা দিয়ে সম্ভব না।’

সাপ্তাহিক পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে একই রকম হতাশা প্রকাশ করেছিলেন এক সময় পাক্ষিক পত্রিকার মালিক-সম্পাদক এবং পরবর্তী সময়ে আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত মোস্তফা জব্বার। তার কাছে গিয়েছিলাম নাজিউর রহমান মঞ্জুরের রেফারেন্সে কম্পিউটার আনার জন্য; তখন তিনি সেগুন বাগিচায় বসতেন।

সাপ্তাহিক পত্রিকার মার্কেট বেশি দিন রমরমা থাকবে না- এরকম ধারণায় আমিও আন্দোলিত হচ্ছিলাম। মানুষের জীবন যুদ্ধ অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক হওয়াসহ নানা কারণে সাপ্তাহিক পত্রিকার মার্কেট কমে আসার বিষয়টি হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছিলাম। এর উপর ‘গরু কিনলে বাছুর ফ্রি’ গোছের বালখিল্য প্রবণতায় আক্রান্ত হয়ে দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রতি সপ্তাহে একটি ম্যাগাজিন বিনামূল্যে দেয়ায় পাঠকপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকার ভিত নড়বড়ে হয়ে গেল। এর সঙ্গে যুক্ত হলো উপযুক্ত লোকবলের আকাল।

১৯৮৯ সালে সুগন্ধা ও ১৯৯৭ সালে সুগন্ধা কাগজ-এ যে উচ্চতার সাংবাদিক সম্পৃক্ত করা গিয়েছিল তা দশ বছর পরে কয়টি দৈনিক পত্রিকা এবং আরও পরে কতটি টেলিভিশনে পাওয়া গেছে তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর ২০১৫ সালের পর পত্রিকা-টেলিভিশনে শুরু হয়েছে লোকবলের আকাল। যে কারণে ভেড়েন্ডাও হয়ে গেছে বৃক্ষ; অনেক তেলাপোকাও মাঠে ওড়ে পাখির মতো! ফলে অনেকের ধারণার সঙ্গে আমি একমত, ‘ফকিরের পুলের ইমেজ’ অনেক মিডিয়ার জন্য নিদারুণ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে টেলিভিশনের ক্ষেত্রে বিষিয়টি পৌঁছেছে অনেকটা লজ্জাজনক অবস্থানে। হয়তো এ অবস্থা থেকে এক সময় মিডিয়ার উত্তরণ সম্ভব হবে। কিন্তু ততদিনে গণমাধ্যম কতটা যে পাতালে নামবে তার আলামত এরই মধ্যে অনেকটাই টের পাওয়া যাচ্ছে যখন মাটি পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত ট্রাকটরে লাগানো হয় টেলিভিশনের লঘু!

মিডিয়ার সম্ভাব্য আকাল সম্পর্কে শফিকুল আজিজ মুকুল আগাম বলেছিলেন অনেকটা জ্যোতিষের মতো। তবে কথিত জ্যোতিষ, প্রতারণার দায়ে একাধিক বার গ্রেপ্তার হওয়া লিটন দেওয়ানের মতো নয়। শফিকুল আজিজ মুকুল আমাকে সাপ্তাহিক পত্রিকার পাহাড় লঙ্ঘনের ধারায় ইতি টেনে দৈনিকে সম্পৃক্ত হবার পরমর্শ দিয়েছিলেন। এজন্য তিনি আমার জন্য ব্লাংক চেকের মতো উম্মুক্ত রেখেছিলেন দৈনিক বাংলার বাণী; তখন তিনি এ পত্রিকার নির্বাহী সম্পদক হিসেবে প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন। তার পরামর্শ মতো এক পর্যায়ে দৈনিক বাংলার বাণীতে যোগ দিলেও সাপ্তাহিক পত্রিকা নিয়ে সহসা রণে ভঙ্গ দিইনি।

ফলে সাপ্তাহিক সুগন্ধা কাগজ ১৯৯৭ সালে অনিশ্চতার মধ্যে শুরু হয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে ব্যাপকভাবে পাঠকের নাগালে ছিল; এ সময় পৃষ্ঠা ও রঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে পত্রিকাটির। তবে পাঠক ধরে রাখার প্রয়াসের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি; ফলে ক্রমাগত পাঠক বেড়েছে। এরপর এক পর্যায়ে ফকিরেরপুলের বাস্তবতায় বেঁচে থাকার নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয় পত্রিকাটি; ম্যাগাজিন থেকে হয়ে যায় ট্যাবলয়েট সাইজ, টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু মাসুম খান। এর বহু আগে সাপ্তাহিক পত্রিকা ব্যাপারে আমার মোহমুক্তি ঘটে; যে ধারায় শুরু হয়েছিল আমার পেশাগত জীবন। শুরুর প্রেমে হাবুডুব খেয়ে আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে!

দৈনিক নভঅভিযান আমার প্রথম দৈনিক পত্রিকা হলেও তখন আমি সাপ্তাহিক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আর দৈনিকের চেয়ে সাপ্তাহিক পত্রিকাই ছিল আমার কাছে বেশি প্রাধান্যের। সে সময় সুগন্ধার কর্ণধার হবার পরও সাপ্তাহিক রোববার-এ নিয়মিত প্রধান আইটেম কন্ট্রিবিউট করতাম; তখন দায়িত্বে ছিলেন সাদেকিন ভাই। এক পর্যায়ে পরিপূর্ণ বেকার অবস্থায় পেশায় টিকে থাকার অবলম্বন ছিল সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র; সম্পাদক ছিলেন বরিশালের বরুণ শংকর।

আমার দ্বিতীয় দৈনিক পত্রিকা সকালের খবর-এর চিফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সময়ও সাপ্তাহিক পত্রিকার বলয়ে সক্রিয় ছিলাম অনেকটা সমান তালে। এ প্রবণতার ছেদ ঘটে  দৈনিক বাংলার বাণীতে কাজ করার সময়। নির্বাহী সম্পাদক শফিকুল আজিজ মুকুলের কঠিন নির্দেশনা ছিল, সাপ্তাহিক পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না। ফলে সাপ্তাহিকের সঙ্গে সকল সম্পর্ক থেকে পরিপূর্ণ দূরে থাকতে হয়েছে।

দৈনিক বাংলার বাণীর পর দৈনিক দিনকাল, দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক যায়যায়দিন হয়ে বাংলাভিশনের মাধ্যমে টেলিভিশন সাংবাদিকতা শুরু; বাংলাভিশনের পর মাইটিভি। এ দুটি টেলিভিশনের সঙ্গে আমার প্রচণ্ড আবেগ জড়িত। একটি আমার জন্য প্রথম; অপটির মাধ্যমে পেশাগত নেতৃত্বে পৌঁছানোর সুযোগ লাভ। (প্রথম খণ্ডের সমাপ্তি)

আলম রায়হান: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক; ই-মেইল: [email protected]