রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ নিয়ে একদমই মাথা ঘামান না তরুণরা

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৪৭ | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৫৪

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ষোলো শতকে নির্মিত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উগ্রপন্থী হিন্দুরা বাবরি মসজিদ পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। এতে ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় দুই হাজার মানুষ নিহত হয়। বিবিসির সাংবাদিক সমীরাত্মজ মিশ্র অযোধ্যায় গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন সেখানকার নতুন প্রজন্মদের রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ নিয়ে তাদের ভাবনা-চিন্তা।    

অযোধ্যা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সরযূ নদীর নতুন ঘাটে যখন গিয়েছিলাম, তখন বেলা প্রায় দুটো বাজে। বেশ রোদ রয়েছে। শীতের আমেজের মধ্যে হালকা রোদে ঘোরাঘুরি করছিল কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলে-মেয়ে।

তাদের দেখেই কথাটা মাথায় এসেছিল, এই যে ৬ ডিসেম্বর হলেই অযোধ্যায় প্রচুর মিডিয়া কর্মী ভিড় করে জমা হন - কীভাবে দেখেন এই কিশোর-তরুণরা?

হাতে গোটাকয়েক খাতা নিয়ে কলেজ থেকে ফিরছিল সুধাংশু রঞ্জন মিশ্র। একটু হেসেই সে বলছিল, ‘আমার তো খেয়ালই ছিল না ৬ ডিসেম্বর তারিখটা।’

সুধাংশু বিএসসি প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করে। ও অযোধ্যার সেই প্রজন্মের কিশোর, যাদের জন্ম হয়েছে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে।

‘মন্দির তো হওয়াই উচিত। কারণ ওই জায়গাটাতেই তো ভগবান রামচন্দ্র জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা বা আড্ডার সময়ে ওই বিষয়টা নিয়ে মোটেই আলোচনা করি না। শুধুমাত্র খবরের কাগজ বা টেলিভিশন চ্যানেলেই এ নিয়ে বিতর্ক দেখতে পাই’- বলছিল সুধাংশু মিশ্র।

মন্দির-মসজিদ নিয়ে যে আইনি লড়াই, সে বিষয়েও সুধাংশু খুব একটা কিছু জানে না। শুধু জানে যে বছর ২৫ আগে করসেবকরা বাবরি মসজিদ ভেঙে দিয়েছিল। সে অবশ্য এটা বোঝে যে বাইরের কিছু নেতাই এই সমস্যার সমাধান চান না।

দেবেশ নামের আরেক ছাত্র বলছিল যে অযোধ্যার বাসিন্দা হয়েও সে কখনও রাম জন্মভূমি পরিসরে যায়নি।

‘রাম জন্মভূমি আমরা শুধু টিভিতেই দেখি। শুধু এটা জানি যে ওখানে রামলালা নাকি একটা তাঁবুর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। আর তাই নিয়েই এত ঝগড়া-বিবাদ’- বলছিল কলেজ ছাত্র দেবেশ।

সে অবশ্য এটা বোঝে যে এই বিবাদ সহমতের ভিত্তিতে আলোচনার মাধ্যমে মিটে যাবে।

তার কথায়, ‘জমিটা তো অযোধ্যার। ঝগড়া হলে তো এখানকার হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা হিন্দু-মুসলমান সবাই তো এখানে বেশ স্বচ্ছন্দেই আছি। বাকি দেশে হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ চলছে। আমার তো মনে হয় এসব করে আসলে রাজনৈতিক রুটি সেঁকা হচ্ছে - সমাধান কেউই চায় না।’

নতুন ঘাটে ততক্ষণে আরও বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন মন্দির তৈরির স্বপক্ষে বেশ আবেগ তাড়িত হয়ে কথা বলতে শুরু করেছিলেন।

কিন্তু আমি আলোচনাটা শুধুই কমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই করতে চাইছিলাম। তাই অন্যদের কথায় খুব একটা আগ্রহ দেখালাম না।

আমি কথা বলতে এগিয়ে গিয়েছিলাম সাকেত কলেজের বি কমের ছাত্র রাকেশ মিশ্রর সঙ্গে কথা বলতে।

সে বলছিল, ‘আমরা তো ছোটবেলা থেকেই মুসলমান ছেলেদের সঙ্গে পড়াশোনা করি, মিলে মিশে থাকি। কখনই লড়াই ঝগড়া হয়নি তো! মন্দির-মসজিদের কথাও ওঠে ঠিকই কিন্তু টিভি চ্যানেলের বিতর্কগুলোতে যেরকম গরম গরম আলোচনা হয়, সেরকম আলোচনা কখনই আমাদের মধ্যে হয় না।’

নতুন ঘাটের কাছেই মোটরসাইকেল থামিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল এক কিশোরী। সে তার নাম বলল আঞ্চল যাদব। দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী সে।

সটান বলে দিল, ‘আমাদের বাড়িতে তো মন্দির-মসজিদ নিয়ে সেরকম আলোচনাই হয় না। আর স্কুলে তো এ নিয়ে আলোচনা করার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকি। মন্দির বা মসজিদ - যারা বানাতে চায়, এটা তাদের মাথাব্যথা, আমাদের নয়।’

সে আরও বলছিল, ‘অযোধ্যায় তো একটা মন্দির নেই। অনেক মন্দির রয়েছে, মসজিদও আছে অনেক। জানি না কেন মানুষ এটা নিয়ে লড়াই করছে। একই জায়গায় মন্দির আর মসজিদ তৈরি হওয়া কঠিন। তবে আমাদের অযোধ্যার বেশীরভাগ লোকই মনে হয় ওখানে মন্দির হোক এটাই চায়।’

ওখানেই আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল অযোধ্যা রেলস্টেশন লাগোয়া এলাকা কুটিয়া মহল্লার বাসিন্দা মুহম্মদ ইফতিয়ারের সঙ্গে।

তার গায়ের হাতকাটা জ্যাকেটের ওপরে বড় বড় করে লেখা ছিল '১৯৯২'। জানতে চেয়েছিলাম কারণ।

সে জবাব দিয়েছিল, ‘যখন মসজিদ ভাঙা হলো, তখন আমার বয়স ছিল এক সপ্তাহ। ৯২-তেই জন্ম আমার।’

সে এম কম পড়ছে আর পরে গবেষণা করতে চায়।

‘তরুণ বা যুবকদের এই ব্যাপারটায় খুব একটা মাথাব্যথা নেই। আমার অনেক হিন্দু বন্ধু আছে, কই তাদের সঙ্গে তো এ নিয়ে কখনও ঝগড়া-বিবাদ হয়নি আমার! আর সবথেকে বড় কথা এখানে কখনও হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়নি। যা হয়েছে, সেগুলো বহিরাগতরা এসে বাঁধিয়েছিল’- বলছিল ইফতিয়ার।

পাশেই দাঁড়ানো মোহাম্মদ আমিরের কথায়, ‘অযোধ্যার মানুষ জানে যে এর মধ্যে ফেঁসে গেলে নিজেদেরই ক্ষতি। ব্যবসা মার খাবে, দোকানদারী বন্ধ হয়ে যাবে, স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের পড়াশোনার ক্ষতি হবে। তাই আমরা কেন এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করব? বাইরে থেকে এসে দাঙ্গা ফাসাদ বাধায় যারা, তারা তো নিজেদের ঘরে ফিরে যাবে, ক্ষতিটা তো আমাদের হবে।’

আমির আরও বলছিল, এই সারকথাটা শুধু মুসলমানরা নয়, হিন্দুরাও খুব ভালো করে জানে আর বোঝে।

(ঢাকাটাইমস/৭ডিসেম্বর/এসআই)