৭১-এর দাসী

রেজাউল করিম
 | প্রকাশিত : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৯:৫৬

বছর পেরিয়ে ডিসেম্বর আসে। পথে-প্রান্তরে শুরু হয় বিজয়ের উল্লাস। ৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের পর গত ৪৬ বছরে পরিবর্তন হয়েছে কত কিছুর। কিন্তু স্বাধীনতার উল্লাস রয়ে গেছে একই রকম। দিন দিন ইতিহাসের পাতায় যোগ হচ্ছে শিউরে ওঠার মতো মুক্তিযুদ্ধের অজানা অনেক তথ্য। দিন যতো যাচ্ছে বিজয়ের আনন্দ ততোটাই বাড়ছে। আর বাড়ছে শত্রুদের প্রতি ঘৃণার তীব্রতা। কালো ছায়াটাকে আলোয় ভরিয়ে দেয় প্রতি বছরের বিজয়ের এই দিনটি।

বিজয়ের মাসে এই তো সেদিন। সন্ধ্যা তখনো নামেনি। তবে সূর্যটা আকাশ থেকে যমুনায় নেমে যাওয়ায় অনেকটাই অন্ধকার। বিজয়ের আনন্দে রাস্তায় নেমেছে অনেকে। আর যমুনার চরাঞ্চলে ছায়ার মতো দেখা যায় দুজন মানুষকে। অদূর থেকে মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই ওরা কারা। আরো কাছাকাছি হলে মুখ ঢাকা এক বৃদ্ধার দেখা মেলে। সাথে একজন পুরুষমানুষ। মুখ ঢাকা দেখে ওদের দেখার কৌতূহল সবার মধ্যে। সবাই জানতে চায় কারা ওরা। দেখতে চাচ্ছে ওদের মুখখানি। কিন্তু ওরা নিজের মুখ ঢেকে অন্যের মুখ দেখছে। দেখছে বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য। ওদের দেখে মনে হচ্ছে, এই অপরূপ প্রকৃতি ওদের কতই না চেনা।

রাস্তায় থাকা যুবকেরা ভাবছে, বিজয়ের উৎসবে নাশকতা করতে মুখোশধারী কেউ হয়তো দাঁড়িয়ে আছে। ওদের কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইলে কেউ কিছু বলে না। তবে দুজনেরই চোখে অঝরে জল ঝরছে। এমন সময় শতবর্ষী বৃদ্ধ আজাহার আলী জিজ্ঞেস করল, ‘মা, তোমরা কারা?’ ব্দ্ধৃা মুখ খুলতেই আজাহার আলী বললেন, ‘তোমাকে যেন চেনা চেনা লাগছে।’ কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধাই বললেন, ‘আমি রাবু, বড় বাবা।’

বড় বাবা চমকে ওঠেন। বহুদিন পর এই নামে কেউ তাকে ডাকল। শুধু একজনই তাকে বড় বাবা ডাকত। সে হলো রাবু। বড় বাবা কৌতূহল ভরা মনে আরও কাছে যান। তার সন্দেহই ঠিক। জড়িয়ে ধরে আজাহার আলী বললেন, ‘কেমন আছো গো, মা?’

‘বড় বাবা তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ? আমার কথা মনে আছে?’

‘তোকে চিনব না! তুই ছাড়া আর কে বড় বাবা ডাকত আমাকে! আয়, বাড়ি আয়।’

অসুস্থ শরীর, হাঁটতে পারছে না রাবু। সাথের লোকটি তাকে ধরতেই আজহার আরী জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কে?’ লোকটি জবাব দেয়ার আগে রাবু বললেন, ‘ওর জন্যই বেঁচে আছি বড় বাবা। ও তোমাদের আব্দুলের ছেলে ইউসুফ। ওকে ওর জন্মভূমিতে ফেরত দিতে এসেছি।’

আজহার আলী আবার চমকে ওঠেন। ‘তুই ছিলি বা কোথায়? সেই যে গন্ডগোলের বছর তোরে মিলেটারিরা নিয়ে গেল তারপর মনে করছিলাম তোর সাথে জীবনে আর দেখা হবে না।’

আজহার আলী সবাইকে বুঝিয়ে বললেন, ওদের সন্দেহ করার কিছু নেই। ওর নাম রাবেয়া। আমাদের পাড়ার মেয়ে। দেখতে খবসুরত ছিল। সবাই আদর করতো। তাই সবাই আদর করে ওকে রাবু বলে ডাকত। গন্ডগোলের সময় রাজাকার আর মিলিটারিরা মেয়েদের নির্যাতন করতো। ওদের লালসা থেকে বাঁচাতে ১৬ বছর বয়সেই ওরে আমরা বিয়ে দেই আব্দুলের সাথে। দুই মাসের গর্ভবতীও হয় রাবু। ভাবলাম, ওর ওপর মিলিটারিদের লালসা থাকবে না। রাবুর স্বামী মুক্তিবাহিনীতে যাওয়ায় একাই থাকতো রাবু। রাবুও মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার রান্না করে খাওয়াতো। জামাইটা মুক্তিবাহিনীতে থাকায় রাজাকার আর পাক মিলিটারিদের লালসায় একদিন রাজাকার বাদশা ধরে নিয়ে গেল রাবুকে। সেই যে হারিয়ে গেল। তারপর থেকে কত না খুঁজেছি। দেখা পাইনি ওর।

চোখ মুছে রাবু বলেন, ‘বড় বাবা, নরপিশাচ রক্তপিপাসু পাক-সৈন্যরা যে অকথ্য বর্বর অত্যাচার আর পৈশাচিক আনন্দে মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তা জানার পর আবেগ ধরে রাখতে পরবে না তোমরা।’

রাবু বলে যায় সেদিনের কথা। ‘একাত্তরের জুন মাস। বয়স ষোল তখনও পেরোয়নি। নির্জন ঘরে আমাকে ১৭ দিন আটকে রেখেছিল বাদশা। পাশবিক নির্যাতন করছিল প্রতিনিয়ত। এরপর বাদশা আমাকে তুলে দেয় মিলিটারি ক্যাম্পে। ওখানেও রীতিমতো নির্যাতন। শুধু আমি না। আমার মতো অনেকেই সেখানে। মুক্তিযুদ্ধে নারী নির্যাতনের প্রকৃত চিত্রের ভয়াবহতা এখনো তোমরা জানতে পারনি। সেখানে শিশুকন্যা থেকে বৃদ্ধাও নিগ্রহের হাত থেকে রেহাই পায়নি। প্রতিদিন পালাক্রমে ওরা আমাদের ওপর নির্যাতন চালাতো। ক্রমাগত শারীরিক নির্যাতনের ফলে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। আরেক নারী দিয়ে নিহতের কবর খোঁড়ানো হতো। কোনো কোনো সৈনিক নারীদের নগ্ন করে আনন্দে ফেটে পড়ত। কোনে মেয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে তখনই হত্যা করা হত। কয়েকজন পাকিস্তানি মিলিটারি আমাদের ওপর বীভৎস যৌন নির্যাতন চালায়। সেই ছিল শুরু। তারপর আমাদের নিয়ে গেছে এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে, এক বাগান থেকে অন্য বাগানে। দিনের পর দিন ওসব ক্যাম্পের মিলিটারিরা আমাদের ওপর নির্দয় নির্যাতন চালিয়েছে। আমি অন্তঃসত্ত্বা হওয়াতে একটু রেহাই পেয়েছিলাম। অন্যদের দীর্ঘ আট মাসের প্রতি রাতে চার-পাঁচজন করে মেলিটারি নির্যাতন করতো। একটি রাতের জন্যও নিষ্কৃতি দেয়নি বন্দীদের। তাদের বাধা দেবার কোনো উপায় ছিল না, মুখ বুজে সব সহ্য করে গেছেন ওরা। আমার কাছে আসত একজন পাক মিলেটারি অফিসার। একবার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এলেও ওরা আবার আমাদের ধরে নিয়ে যায়। তারপর স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত সহ্য করতে হয়েছে ওদের সীমাহীন নির্যাতন। ঠিকমতো খাবার দেয়নি, অসুস্থ হলেও চিকিৎসা করায়নি। দিনের পর দিন কেবল চালিয়ে যেত বীভৎস নির্যাতন।

‘বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও মেয়েদের ধরে আনা হত। আসা মাত্রই সৈনিকরা আনন্দে ফেটে পড়তো। তারা ব্যারাকে ঢুকে প্রতিটি যুবতী ও বালিকাকে নগ্ন করে পাশবিক নির্যাতন করতো। মেয়েদের কোমল অংশগুলো যন্ত্রণাদায়ক হয়ে যেত। প্রতিবাদ করতে গেলে বন্দুকের নল ধরা হত। মেয়েদের রাখা হত মোটা রডের সাথে চুল বেঁধে। এসব ঝুলন্ত মেয়েদের কোমরে ব্যাটন দিয়ে আঘাত করা হত প্রায় নিয়মিত। অনেকে যন্ত্রণায় আত্মহত্যা করেছে। পুরো সময়টা আমাদের যৌনদাসী বানিয়ে রেখেছিল। নয় মাস যুদ্ধের পর যখন বাংলাদেশ জয়ের পথে ঠিক তখনই পাক সেনারা পালাতে থাকে। ওদের একজন খালিদ আমাকে দাসী বানিয়ে নিয়ে যায় পাকিস্তানে। ’

রাবু বলে, ‘পাকিস্তানে নেওয়ার পর ভাবলাম মুক্তি হয়তো আর মিলবে না। ঠিক তাই। দেশের মাটিতে ছিলাম যৌনদাসী। দেশান্তর হয়ে রইলাম দাসী হয়ে। ওখানে জন্ম হল ইউসুফের। শত্রুদের মাটিতে কেটে গেল ইউসুফের ৪৬ বছর। কে ওর বাবা, কি ওর পরিচয়, ওর জন্মস্থান কোথায় সব জেনে ইউসুফের চোখে জলের বন্যা বয়। নিজের দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে ইউসুফ। দেশের মাটিতে ওকে ফিরিয়ে দিতেই ৭১-এর দাসীর দেশে ফেরা।’

রাবুর মুখে এসব কথা শুনতে শুনতে সবার চোখ ভিজে ওঠে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে ইউসুফেরও। রাবু বলে, ‘ভাবছিলাম সুযোগ এলেও দেশে আর আসব না। কিন্তু ইউসুফের ওই চোখের জল আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনে। ইউসুফ বলেছিল, আমার মা আর মায়ের মতো হাজারো নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বাধীন হয়েছিল। তাদের মতো আত্মত্যাগীদের জন্যই আজ দেশের ১৬ কোটি মানুষ স্বাধীন। তখন ইউসুফের গর্বের সাথে আমিও ভুলে যাই নয় মাস বীভৎস নির্যাতনের কথা। বাঁচতে চাই স্বাধীন দেশে। ইউসুফকে দিতে চাই একটি স্বাধীন বাংলাদেশ। ওর জন্য উপহার সবুজের মাঝে গাঢ় লাল সবুজের পতাকা।

লেখক: সংবাদকর্মী।

(ঢাকাটাইমস/৯ডিসেম্বর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :