সরকারি লোকসানি দুই চিনিকলের শেয়ার নিয়ে ‘কারসাজি’

প্রকাশ | ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:২০

ইউনুছ আলী আলাল, ঢাকাটাইমস

লোকসান আর দেনায় জর্জরিত সরকারি দুই চিনিকল জিলবাংলা এবং শ্যামপুর সুগারের দাম বেড়ে চলছে অস্বাভাবিকভাবে। এর মধ্যে শ্যামপুর সুগারের দাম ১২ নভেম্বর ২৬ টাকা থাকলেও গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস ৭ ডিসেম্বর দাঁড়ায় ৫৮.৮ টাকা। একই ভাবে জিলবাংলার দাম ১২ নভেম্বর ৫৭.৫ টাকা থেকে ১২ ডিসেম্বর দাঁড়িয়েছে ৮৩ টাকায়।

প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ লোকসান দেয়া দুটি কোম্পানির শেয়ারের দাম এভাবে বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারসাজি থাকতে পারে বলে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

দুটি কোম্পানিরই বাজারে শেয়ার সংখ্যা তুলনামূলক কম। আর যেসব কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা কম, সেগুলোকে ঘিরে কারসাজি করা সহজ বলেই ধারণা করা হয়।

শ্যামপুর সুগারের পরিশোধিত মূলধন পাঁচ কোটি টাকা। প্রতিটি শেয়ারের দাম ১০ টাকা। এই হিসাবে কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা মোট ৫০ লাখ। এই শেয়ারের মধ্যে সরকারের কাছে আছে ৫১ শতাংশ শেয়ার। বাকি শেয়ারের মধ্যে অর্থ বছর শেষে গত ৩০ জুন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ১৮ শতাংশেরও বেশি শেয়ার থাকলেও এক শতাংশ রেখে সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে তারা। এখন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে বাকি ৪৮ শতাংশ শেয়ার। এই পরিমাণ ২৪ লাখ।

জিলবাংলা সুগারের পরিশোধিত মূলধন ছয় কোটি। প্রতিটি শেয়ারের দাম ১০ টাকা। অর্থাৎ এর মোট শেয়ার সংখ্যা ৬০ লাখ। এর মধ্যে সরকারের কাছে আছে ৫১ শতাংশ শেয়ার, উদ্যোক্তা-পরিচালকদের কাছে আছে ১.৮২ শতাংশ। শ্যামপুর সুগারের মতোই এই কোম্পানির শেয়ারও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বেচে দিয়েছে। গত ৩০ জুন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে এই কোম্পানির ১০.৭১ শতাংশ শেয়ার থাকলেও এখন আছে মাত্র ০.০২ শতাংশ। বাকি ২৮ লাখ ২৯ হাজারের কিছু বেশি শেয়ার আছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।  

যেসব কোম্পানি লোকসানে এবং যারা কোনো ধরনের লভ্যাংশ ঘোষণা করে না, যাদের উৎপাদন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকে, সেগুলোকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়েছে। এসব কোম্পানির বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে শেয়ার কেনা বেচায় নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা আছে। যেসব মুনাফা ঘোষণা করা কোম্পানির শেয়ার কেনার পর তৃতীয় কার্যদিবসে বিক্রির সুযোগ থাকলেও জেড ক্যাটাগরির শেয়ার বিক্রি করা যায় নবম কার্যদিবসে। আবার এসব কোম্পানির শেয়ার কিনতে কোনো ধরনের ঋণ সুবিধা পাওয়া যায় না।

 

কিন্তু নিরুৎসাহিত করলে কি হবে, গত কয়েক মাস ধরে এই ধরনের বেশিরভাগ শেয়ারের দামেই উল্লম্ফন ঘটেছে। এমনকি মুনাফা ঘোষণা না হলে সচরাচর দাম কমলেও এবার জেড ক্যাটাগরির বেশিরভাগ শেয়ারেই পরবর্তী কার্যদিবসে দাম বাড়তে দেখা গেছে। কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে মুনাফা না দেয়ার পরের কয়েক দিনে।

সাম্প্রতিক সময়ে জেড ক্যাটাগরির যেসব শেয়ারে অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে, তার মধ্যে অন্যতম সরকারি দুই চিনিকলের।

দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে কাজ করছেন এমন একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ঢাকাটাইমসকে বলেছেন, পুঁজিবাজারে কারসাজি হয়, এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু কোনো কোম্পানির শেয়ার যদি কেউ বেশি দামে কেনে, তাহলে তা ঠেকাতে কোনো আইনি কাঠামো নেই। কেনা-বেচায় আইন মেনে চলছে এসইসি বা ডিএসইর কিছু করার থাকে না। এই কারসাজি ঠেকাতে একটি আইনি কাঠামো থাকা জরুরি।

শ্যামপুর সুগার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। এরপর ২১ বছরে তারা একবারও কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। লোকসানের কারণে কোম্পানিটির অবস্থা এতটাই করুণ হয়ে গেছে যে শেয়ার প্রতি সম্পদ ঋণাত্মক হয়ে গেছে। সব শেষ নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী গত ৩১ জুন কোম্পানিটির ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ারে দেনা দাঁড়িয়েছে ৬৬৯ টাকা ৫৫ পয়সা। আর গত আর্থ বছরে শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ৬৫ টাকা ৭৫ পয়সা।

চলতি অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি দায় দাঁড়িয়েছে এই পরিস্থিতি ৬৭৭ টাকা ১৯ পয়সা। আর চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ১০ টাকার শেয়ারে লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৭ টাকা ৬৪ পয়সা।

কোম্পানিটির এই করুণ পরিস্থিতির কোনো প্রতিফল নেই এর দামে। এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে শেয়ারের দাম ২২৫ শতাংশ বেড়েছে।

আর গত এক বছরে দাম হয়েছে চার গুণ। সর্বনিম্ন ১৫ টাকা থেকে ৬০ গত সপ্তাহেই সর্বোচ্চ ৬০ টাকা পর্যন্ত কেনাবেচা হয়েছে এই কোম্পানির শেয়ারের।

‘অস্বাভাবিক’ এ দরবৃদ্ধির সময় গত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত তিনবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কাছে দরবৃদ্ধিও পেছনে কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়। আর কোম্পানির তরফ থেকে জানানো হয় তাদের কাছে এ ধরনের তথ্য নেই। আর গতানুগতিক এই জবাব পাওয়ার পর কেন এভাবে দাম বাড়ছে, তা অনুসন্ধানের কোনো উদ্যোগ নেয়নি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ-এসইসিও এ বিষয়ে চুপচাপ রয়েছে।

এ ব্যাপারে শ্যামপুর সুগার মিল কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া নম্বরে দেয়া একটি ফোনে কল করে সেটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতে দেখা গেছে। অন্য একটি নম্বরে রিং দিলেও কেউ তা ধরেননি।

একই ধরনের অবস্থায় সরকারি আরেক চিনিকল জিল বাংলার। এই চিনিকলও ধারাবাহিকভাবে লোকসান দিয়ে চলেছে আর এ কারণে শেয়ার প্রতি সম্পদ ঋণাত্মক অবস্থায় চলে গেছে। গত ৩০ জুন অর্থ বছরের শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১৮.০৩ টাকা।

১৯৮৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া জিলবাংলাও কখনও লভ্যাংশ দিতে পারেনি। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরেও একই ঘটনা ঘটেছে। গত বছর কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ৫৪.০৯ টাকা। চলতি বছর প্রথম প্রান্তিকেও বিপুল পরিমাণ লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি কোম্পানিটি। বছরের প্রথম তিন মাসে চিনিকলটি ১০ টাকার শেয়ারে লোকসান দিয়েছে ১৫ টাকা ৬২ পয়সা। আর শেয়ার প্রতি দেনা আরও বেড়ে হয়েছে ৪৩৩ টাকা ৬৪ পয়সা।

গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছর প্রথম প্রান্তিকে লোকসান যেরকম বেড়েছে, তেমনি শেয়ার প্রতি দেনাও বেড়েছে। এতে স্বাভাবিক নিয়মে কোম্পানিটির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনীহা থাকার কথা ছিল। কিন্তু হয়েছে উল্টো। এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে শেয়ারের দাম ২৫ টাকারও বেশি বেড়েছে।

শ্যামপুর সুগারের মতই গত ৫২ সপ্তাহে জিলবাংলার দাম প্রায় সাড়ে তিন গুণ হয়েছে। ২৩ টাকা থেকে শেয়ার দর ৮৫ টাকা পর্যন্ত উঠার কী কারণ, কেউ কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াচ্ছে কি না, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করেনি ডিএসই বা এসইসি।

এ ক্ষেত্রেও একাধিকবার গতানুগতিকভাবে ডিএসই কর্তৃপক্ষ কোম্পানিটির কাছে অস্বাভাবিকভাবে দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়েছে। প্রতিবারই কোম্পানিটি জানিয়েছে, এই দাম বৃদ্ধির কারণ তাদের জানা নেই। তাদের কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।

অবশ্য শুধু এই দুই চিনিকল নয়, স্বল্প মূলধনী ও লোকসানি বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের দর গত তিন মাসে বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। সেগুলোর বিষয়েও ডিএসই বা এসইসি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। 

ঢাকাটাইমস/১০ডিসেম্বর/ইউআইইউ/ডব্লিউবি