বস্তিতে আলো ছড়াচ্ছেন জাফর

রিমন রহমান, রাজশাহী
| আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৯:৪৯ | প্রকাশিত : ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৯:৩৬

রাজশাহীতে ছিন্নমূল শিশুদের শিক্ষার জন্য কাজ করছে ‘আলোর পথে বিদ্যানিকেতন’ নামের একটি স্কুল। স্কুলটিতে বস্তি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাগ্রহণের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আবু জাফর নামের এক যুবক। শুধু নিজের চেষ্টা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে স্কুলটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

রাজশাহী মহানগরীর ছোটবনগ্রাম কৈইটাপুকুর এলাকায় তার স্কুল। ২০১৫ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত। এখানে সম্পূর্ণ বিনাখরচে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে বস্তি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা। স্কুলটি সরকারি না হলেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বই-খাতা-কলমও সরবরাহ করা বিনামূল্যে। আর এ জন্য নিজের আয়ের একটা অংশ স্কুলের পেছনে ব্যয় করেন আবু জাফর।

এই স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী অন্তর কাজ করে ফার্নিচারের দোকানে। সেখান থেকেই ধরে এনে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন আবু জাফর। এখন অন্তর পড়তে শিখেছে, লিখতেও পারে। অন্তরের মতো এখানকার অনেক শিক্ষার্থীই আবার আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে টোকাইয়ের কাজ করতো। কেউ কেউ জড়িয়ে পড়েছিল ভিক্ষাবৃত্তিতেও। আবু জাফর তাদের মা-বাবাকে বুঝিয়ে স্কুলে এনেছেন।

আবু জাফরের এই সংগ্রামটা অনেক আগে থেকেই। তখন ২০০৩ সাল। সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করে চাকরি খুঁজছিলেন। হঠাৎ বাড়ির পাশের একদল সুবিধাবঞ্চিত শিশু তার কাছে গিয়ে আবদার করে বসে তাদের পড়াশোনা শেখানোর জন্য। আবু জাফর তাদের কথা ফেলতে পারেননি। বিনা পারিশ্রমিকে তিনি তাদের পড়াশোনা শেখাতে শুরু করেন। এক সময় ঝোঁক চেপে বসে শিক্ষকতায়।

আবু জাফর তখন এলাকার বস্তিতে বস্তিতে ঘুরতে শুরু করেন। তালিকা তৈরি করেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের। তারপর সবার সঙ্গে মিশে যান বন্ধুর মতো। পুরাতন বইয়ের দোকান থেকে কেজি দরে কিনে আনেন বই-খাতা। তারপর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে বস্তিতেই খোলা আকাশের নিচে শুরু করেন পাঠদান।

আবু জাফর ঢাকাটাইমসকে জানান, ওই সময় বস্তির লোকজন তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতেন। বলতেন, শিশুরা বাবা-মায়ের সঙ্গে টোকাইয়ের কাজ করলে নগদ টাকা আয় হবে। জাফর তাদের ক্ষতি করছেন। অনেকে তার কাছে সন্তানকে পড়তে যেতে দিতেন না। অনেকটা অভিমানেই আবু জাফর তখন পাঠদান ছেড়ে একটি বেসরকারি সংস্থার ব্যবস্থাপক পদে যোগ দিয়ে ঢাকায় চলে যান।

তারপর ছোট ছোট ওই শিশুরাই তাকে ফিরে আসার জন্য ফোন করে কান্নাকাটি করতো। অভিভাবকেরাও নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসার অনুরোধ জানাতে থাকেন। ভেঙে যায় আবু জাফরের সব অভিমান। তিনি ফিরে আসেন। এবার তার স্বপ্নটা আরও বড় হয়। আর খোলা আকাশের নিচে নয়, বস্তিবাসীর আগ্রহ দেখে এবার তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।

আবু জাফর জানান, অনেক চেষ্টা করেও তিনি স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করতে পারছিলেন না। তখন তার পাশে দাঁড়ান মা রাহেলা খাতুন। তিনি আবু জাফরকে দেন ৫০ হাজার টাকা। সে টাকায় ১০ বছরের চুক্তিতে ৪ কাঠা জমি ভাড়া নেন জাফর। খুব কম দামি টিন দিয়ে তৈরি করেন চারটি শ্রেণিকক্ষ। নাম দেন ‘আলোর পথে বিদ্যানিকেতন।’ স্কুলটির স্লোগান ‘শিক্ষা এখানে আনন্দময়।’ এখন এই স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০০ জন।

ছোট ছোট শ্রেণিকক্ষগুলোতে জায়গা সংকুলান সম্ভব না হওয়ায় ক্লাস চলে দুই শিফটে। শিশু থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত। আর দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলে ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত। আবু জাফর এই স্কুলটির পরিচালক পদে রয়েছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন আরও চারজন শিক্ষক। সম্পূর্ণ বিনাপারিশ্রমিকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত করছেন তারা।

স্কুলটির একজন শিক্ষকের নাম সাব্বির হোসেন। সম্প্রতি এক সকালে স্কুলটিতে গেলে সাব্বির বলেন, এক সময় তিনি নিজেও আবু জাফরকে ‘পাগল’ ভাবতেন। কিন্তু দিনের পর দিন তার প্রচেষ্টা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। পরে তিনি নিজেই যোগ দিয়েছেন জাফরের স্কুলে। স্কুল, স্কুলের শিক্ষার্থী আর আবু জাফরকে নিয়ে এখন তিনি গর্বিত। স্কুলটিতে শিক্ষকতা করতে পেরে গর্ববোধ করেন নিজেও।

এই স্কুলে ভর্তির আগে শিশুদের অক্ষরজ্ঞান দেয়ার কাজটিও করেন আবু জাফর। ছোটবনগ্রাম লাই ভাইয়ের বস্তিতে প্রতিদিন বিকালে খোলা আকাশের নিচে ছোট ছোট শিশুদের পড়াশোনা করান জাফর। সেখানে অক্ষর চিনতে পারলে শিশুদের ভর্তি করা হয় এই স্কুলে। স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী আবদুল হালিম বলে, সে নিজের নামটি এখন লিখতে পারে। ভবিষ্যতে সে পুলিশ অফিসার হতে চায়। তার মতো প্রতিটি শিশুই শিক্ষার আলো পেয়ে এখন উজ্জীবিত।

আবু জাফর জানিয়েছেন, তার নিজের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যবসার মোট আয়ের ২৫ শতাংশ তিনি স্কুলের পেছনে ব্যয় করেন। আগে বই-খাতাসহ সব কিছুই পুরাতন বইয়ের দোকান থেকে কেজিদরে কিনে এনে শিক্ষার্থীদের দিতেন। এ বছর অনেক বোঝানোর পর বইগুলো পেয়েছেন শিক্ষা অফিস থেকে। এছাড়া এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সহযোগিতা তিনি পাননি।

তিনি জানান, আগে শিক্ষার্থীদের সবাইকে নিয়ে গিয়ে চুল কাটিয়ে আনতেন। সপ্তাহে একদিন একজন হোমিও চিকিৎসক নিয়ে এসে চিকিৎসা করাতেন শিশুদের। মাঝে মাঝে দুপুরে খাবারেরও ব্যবস্থা করতেন। এখন অর্থের অভাবে সেসব পারেন না। স্কুলটি কতদিন চালাতে পারবেন, তা নিয়েও তিনি দুশ্চিন্তায়।

আবু জাফর বলেন, আসছে জানুয়ারিতেই আগামী এক বছরের জন্য স্কুলের জমির ভাড়া দিতে হবে। সে টাকা জোগাড় করা নিয়েও আমি দুশ্চিন্তায়। আমি চাই, সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের এই স্কুলের পাশে এসে দাঁড়াক। কারণ, এসব শিশুদের মাঝেও আছে সম্ভাবনা। তাদের লুকানো প্রতিভা ফুটিয়ে তুলতে শুধু দরকার একটু সুযোগ।

(ঢাকাটাইমস/১০ডিসেম্বর/আরআর/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :