কোকোর ঘুষের টাকার পর ফেরানো যায়নি কারও অর্থ

প্রকাশ | ১২ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:১১

মোসাদ্দেক বশির, ঢাকাটাইমস

বিদেশে অর্থ পাচার নিয়ে কথা হচ্ছে বহু বছর ধরে। এই অর্থ ফিরিয়ে আনা নিয়েও আলোচনা, চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য নেই বললেই চলে। চার বছর আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো এবং অন্য একজনের টাকা ফিরিয়ে আনাই এখনও উদাহরণ হয়ে রয়েছে।

২০১২ এবং ২০১৩ সালে তিন দফায় সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংকে থাকা খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ২১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ফেরত আনতে পেরেছিল দুদক। এ ছাড়াও আরও একজনের টাকা দুদক দেশে ফেরাতে পেরেছে। এরপর সাফল্যের আর কোনো উদাহরণ নেই।

কোকোর নাম নিশ্চিত করলেও দ্বিতীয় ওই ব্যক্তির নাম জানাতে পারেননি দুদকের উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য। ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দুদকের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে এখন পর্যন্ত দুইজন আরাফাত রহমান কোকো ও আরো একজন ব্যক্তির অর্থ ফেরত আনা হয়েছে।’ 

কোকোর টাকা যেভাবে ফেরত এসেছে

দুদকের নথিপত্র অনুযায়ী ২০০৫ সালে কোকো রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানি টেলিটকের যন্ত্রাংশ কেনার কাজ পাইয়ে দিতে বহুজাতিক কোম্পানি সিমেন্সের কাছে ঘুষ নেন। আবার চট্টগ্রাম বন্দরে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের ক্ষেত্রে অর্থ গ্রহণ করেন। পুরো অর্থই সিঙ্গাপুরে লেনদেন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতে এ বিষয়ে সিমেন্সের পক্ষ থেকে স্বীকারোক্তিও দেয়া হয়। 

আর এ ঘটনায় দুদকের উপপরিচালক আবু সাঈদ বাদী হয়ে ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ কোকো ও বিএনপির সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী আকবর হোসেনের ছেলে ইকবাল হোসেনকে আসামি করে মামলা হয়। ২০১১ সালের ২৩ জুন মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে আদালত কোকোর ছয় বছরের কারাদণ্ডসহ ৩৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা জরিমানা দেয়ার পাশাপাশি পাচার করা টাকা ফেরত আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় আদালত।

কোকোর ওই জাটা ছিল সিঙ্গাপুরের ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংকে। যুক্তরাষ্ট্র আদালতে সিমেন্সের স্বীকারোক্তির পর ওই টাকা ছাড় করা বন্ধ করে দেয় তারা।

সিঙ্গাপুরের নাগরিক লিম ইউ চ্যাং ২০০৪ সালে সিঙ্গাপুর ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন, যার শর্ত ছিল চ্যাং এবং কোকোর যৌথ স্বাক্ষরেই এই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা যাবে।

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৯ সালের ৪ জানুয়ারি ‘অকটোখান’ নামে একটি সংস্থার সঙ্গে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে দুদক একটি চুক্তি করে। আর এই সংস্থার সহযোগিতাতেই ফেরান হয় কোকোর টাকা। আর এই ২১ কোটি টাকার ১০ শতাংশ কমিশন হিসেবে দেয়া হয় অকটোখানকে।

কোকোর টাকা এসেছে মোট তিন দফায়। প্রথম দফায় ২০১২ সালের নভেম্বরে প্রথম দফায় ২০ লাখ ৪১ হাজার ৫৩৪ সিঙ্গাপুরি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা), দ্বিতীয় দফায় ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ২৩ হাজার ৮০০ সিঙ্গাপুরি ডলার (প্রায় ১৫ লাখ টাকা) এবং তৃতীয় দফায় একই বছরের আগস্টে আনা হয় নয় লাখ ৫৬ হাজার ৩৮৭ মার্কিন ডলার (সাত কোটি ৪৩ লাখ ৬৯ হাজার ৪১৫ টাকা)।

যে প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় কোকোর ঘুষের টাকা সিঙ্গাপুর থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, সেই ‘অকটোখান’ এর সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়েছে ২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি। এরপর আর কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেনি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।

মামলা-তদন্ত চলছে যাদের বিরুদ্ধে

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে প্রায় ১০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা করে দুদক।

যুক্তরাজ্যের লয়েড টিএসবি অফসর প্রাইভেট ব্যাংকে বাংলাদেশি তার ৯ কোটি ৫৩ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮১ টাকা সমমানের বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া গেছে। আদালতে খন্দকার মোশাররফের আইনজীবীরা দাবি করেছেন, তাদের মক্কেল এই টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে অর্জন করেছেন।

বাংলাদেশের নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশি কোনো নাগরিককে বিদেশে কোনো অ্যাকাউন্ট খুলতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু সেই অনুমতি খন্দকার মোশাররফের ছিল না। তিনি এই টাকা পাচার করেছেন বলেই দুদকের তদন্তে বের হয়ে এসেছে।

২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর এই মামলার বিচার শুরু হয়েছে। তবে এখনও তা শেষ হয়নি।

মোশাররফ ছাড়াও রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা ও বিচারকসহ দেশের প্রভাবশালী বেশ কিছু ব্যক্তির বিদেশে অর্থপাচারের তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেমন সম্পৃক্ত, কেউ কেউ আবার ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানও করছে সংস্থাটি।

পাচারকৃত করা ফেরত আনতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, মালেশিয়া ও থাইল্যান্ডসহ মোট আটটি দেশে এমএলএআর (মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স রিকোয়েস্ট) পাঠানো হয়েছে। অর্থ দেশে ফেরত আনার ব্যাপারে বিদেশি সরকারগুলোর সহায়তা চেয়েছে দুদক।

দুদক কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচারকারী তিন হাজার ৬৫৬ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে সংস্থাটি। অবৈধভাবে অর্থ পাচার করে এরা সবাই দেশটিতে সেকেন্ড হোমের সুবিধা নিয়েছে। এই তালিকার মধ্যে সাবেক দুই জন সংসদ সদস্য, সাবেক এক বিচারক, সাবেক এক সচিব, বর্তমান সরকারের এক মন্ত্রীর ছেলে, গাড়ি আমদানিকারকদের সমিতি বারভিডার সাবেক এক চেয়ারম্যান, চাঁদপুর জেলা বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের এক নেতা, বিএনপির সাবেক এক মন্ত্রী, সাবেক এক অর্থমন্ত্রীর ছেলে, ফেনীতে সরকারদলীয় এক সংসদ সদস্য, বিএনপির বাগেরহাটের সাবেক এক সংসদ সদস্য, বেসিক ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার নাম রয়েছে।

পানামা ও পেরাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের কী হবে

সম্প্রতি অর্থপাচার নিয়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে দুটি তথ্য। এর একটি পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি এবং অপরটি পেরাডাইজ পেপারস কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত। দুটি তালিকাতেই বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির নাম এসেছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দুদক এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল বিদেশে অবৈধভাবে বিনিয়োগকারীদের একটি তালিকা প্রকাশ হয়। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি নামে পরিচিতি পাওয়া এই তালিকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান, প্রভাবশালী রাজনীতিক এবং ব্যবসায়ীদের নাম ছিল।

এই তালিকায় নাম ছিল ১১ বাংলাদেশির। তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল দুদকের উপপরিচালক আখতার হামিদ ভুঁইয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করে দুদক। ওই বছরের ২ মে পানামা পেপারসে নাম আসা ১১ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে দুদক। এদের মধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করে সংস্থাটি। কিন্তু দুদকের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মামলা বা অন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

এই রেশ কাটতে না কাটতেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিশ্বের প্রায় ১৮০ টি দেশের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, রাজনীতিকের নাম প্রকাশ হয়েছে একই ধরনের বিনিয়োগের বিষয়ে। এই তালিকাটি প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এরা সবাই নিজ দেশে কর ফাঁকি দেয়ার জন্য, কর দিতে হয় না বা দিলেও খুবই স্বল্প হারে দিতে হয় এমন দেশে (ট্যাক্স হ্যাভেন) অর্থ বিনিয়োগ করে রেখেছেন।

এই তালিকায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিণ্টু, তার স্ত্রী ফাতিমা আউয়াল এবং তিনপুত্র তাবিথ আউয়াল, তাফসির আউয়াল ও তাজওয়ার মোহাম্মদ আউয়ালেরও নাম আছে।

গণমাধ্যমে এরই মধ্যে মিন্টু পরিবারের বিষয়টি এসেছে। কিন্তু গত ১৯ নভেম্বর এই সংবাদ প্রকাশ হওয়ার তিন সপ্তাহেও দুদক তাদেরকে তলব করা বা অভিযোগ খতিয়ে দেখার কোনো উদ্যোগই নেয়নি।

(ঢাকাটাইমস/১২ডিসেম্বর/এমএবি/ডব্লিউবি)