রাজস্থানে মুসলিম শ্রমিককে পুড়িয়ে হত্যার নেপথ্যে
প্রকাশ্যে একজন মুসলিমকে কুপিয়ে হত্যার পর আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনা পুরো ভারত জুড়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে তোলপাড় সৃষ্টি করে। কিন্তু ঠিক কী কারণে এমন ঘটনা ঘটলো? তা খুঁজতেই পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাজস্থানের রাজাসমান্দ শহরে গিয়েছিলেন বিবিসি হিন্দির সাংবাদিক দিলনেওয়াজ পাশা।
‘আমাদের কিছুই বলার নেই। কি ঘটেছে তা সবাই দেখেছে’- অশ্রুসিক্ত চোখে বলছিলেন স্থানীয় এক ব্যক্তি।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে এ ঘটনায় আটক শম্ভু লালের এই আত্মীয় বলেন তিনি এখনো বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না।
তিন মিনিটের ঐ ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আক্রমণকারী একটি শাবল নিয়ে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করছে। পরে তার গায়ে আগুনও ধরিয়ে দেয়া হয়। তখন আক্রমণকারী এটাকে ভারতের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সংখ্যালঘু ‘মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সর্তকবার্তা’ হিসেবে চিৎকার করে।
রাজস্থান রাজ্যের ঐ শহরটিতে প্রবেশের পর, আমি বুঝতে পারলাম সবাই এই ভিডিওটি দেখেছে। এমনকি শিশুরা পর্যন্ত দেখেছে।
আক্রমণকারী অন্য আরেকজন লোককে দিয়ে মোবাইলে পুরো ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়। পরে পুলিশ তাকে চিহ্নিত করে আটক করেছে। তার নাম শম্ভু লাল। তিনি একজন হিন্দু মার্বেল ব্যবসায়ী এবং দলিত (আগে অস্পৃশ্য সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত ছিল) গোত্রের সদস্য।
নিহত ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আফরাজুল। মুসলিম এবং প্রবাসী এই শ্রমিক রাজস্থানে এক দশকের বেশি সময় ধরে বসবাস করছিলেন। কিছু টেলিভিশন চ্যানেলে এবং বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও অবাক করে দিয়েছে ভারতকে। গত কয়েক বছরে একজন মুসলিমকে প্রকাশ্যে খুন করার এমন অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ রয়েছে।
লাল ঘটনার দায় স্বীকার করে ফেসবুকে একটি ছবি শেয়ার করেছেন। সেই ছবি ছাড়াও অন্যান্য যেসব ভিডিও শেয়ার করেছেন সেখান থেকে বোঝা যাচ্ছে তিনি ধর্মীয় কারণে এই ঘটনাটি ঘটিয়েছেন।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে শম্ভু লাল মুসলিমদের সাবধান করে দিয়ে বলছেন, ‘আমাদের দেশে যদি ‘লাভ জিহাদ' চালাতে চান- আপনারও এই পরিণতি হবে।’
ভারতের ক্ষুদ্র কয়েকটি কট্টর হিন্দু গোষ্ঠির প্রচারণায় এই 'লাভ জিহাদ' শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই গোষ্ঠিগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যে তারা ‘হিন্দু নারীদের ভুলিয়ে ভালিয়ে তাদের নিজেদের ধর্ম থেকে সরিয়ে আনার ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত রয়েছে।
দ্বিতীয় আরেকটি ভিডিওতে অভিযুক্ত হত্যাকারীকে হামলার স্বপক্ষে যুক্তি দিতে শোনা যায় ‘মুসলিমদের হাত থেকে হিন্দুদের সম্মানরক্ষার খাতিরে এই হামলা।’
পুলিশ বিবিসি'কে বলছে, লালের মোবাইল ফোনে আটটি ভিডিও ছিল যেখানে তিনি ‘লাভ জিহাদ’ এবং ‘ইসলামিক জিহাদ’-এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এর মধ্যে চারটি ভিডিও তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন।
কিন্তু লালের পরিবারের সদস্যরা এবং বন্ধুরা ভিডিও তে দৃশ্যমান হত্যাকারীকে তাদের পরিচিত কারো সঙ্গে মেলাতে পারছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রতিবেশী মহিলা জানাচ্ছেন, লালের জন্ম থেকেই তিনি তাকে চিনেন।
‘আমাদের শম্ভু এটা করেনি। ভিডিও'র ঐ লোকটি আমাদের পরিচিত কেউ না। আমরা যাকে চিনি তার শরীরের হাড় একটা ভাঙা’- তিনি বলছিলেন।
লালের পরিচিত অনেকেই বলছেন যে তিনি ‘মৃদুভাষী’ এবং ‘অন্যদের জন্য সবসময় চিন্তা করতেন’।
কিন্তু কয়েকজন এমনও বলছেন যে ঘটনাটি ঘটার আগ পর্যন্ত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাকে নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন।
শম্ভু লালের ব্যবসাটি খুব কষ্টের হলেও তিনি মোবাইলে ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে দীর্ঘক্ষণ যাবৎ ভিডিও দেখতেন। অনেকের ধারণা, এটা তার চিন্তাভাবনা ও কাজে প্রভাব ফেলেছিল।
ভারতে হোয়াটসঅ্যাপে খুব দ্রুত এবং বিস্তৃতভাবে ভিডিওতে নানা গুজব ছড়ানো হয়েছে। এ বছরের শুরুর দিকে, ভারতের পূর্বাঞ্চলে হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর পর শিশু পাচারকারি সন্দেহে সাতজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল।
ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর আমাকে অনেকেই হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করা স্থানীয় কিছু সংবাদের লিঙ্ক দেখায়। সেখানে বলা হয়েছিল, কয়েকজন মুসলিম একজন হিন্দু মেয়ে অপহরণ করে ধর্ষণ করেছে। কিন্তু খবরটির কোন সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র ছিল না বা বড় কোন সংবাদ মাধ্যমও প্রচার করেনি।
‘শম্ভু যা করেছে ঠিক করেছে’- নিউজের লিঙ্ক দেখানোর সময় এক ব্যক্তি বলছিলেন, ‘লাভ জিহাদ ঠেকানোর জন্য এটাই করা উচিত।’
আরেকজন যুবক বলছিলেন, ‘আমরা যখন এমন খবর জানতে পারি, ভেতরে খুব ক্রোধ জেগে উঠে। মুসলিমরা কেন আমাদের মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছে? তারা তাদের ধর্ষণ করে জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণ করাচ্ছে? আমাকে বলুন, কে এসব মেনে নেবে?’
এ রকম কিছু লোক হোয়াটসঅ্যাপে একটি গ্রুপ খুলেছে। যেখানে তারা লালের প্রশংসা করে বলছে, ‘লাভ জিহাদীরা সাবধান। শম্ভু জেগে উঠেছে।’
(ঢাকাটাইমস/১৩ডিসেম্বর/এসআই)