জনযুদ্ধের প্রমাণ মিলছে না বীরত্বের খেতাবে

মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:৩৫ | প্রকাশিত : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১০:৪৪

মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করা হয়েছে মোট ৬৭৬ জনকে। এদের মধ্যে সিংহভাগই সামরিক বাহিনীর সদস্য। বেসামরিক যোদ্ধারা খেতাব পেয়েছেন ১৫৯ জন। এর মধ্যে প্রধান দুই খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ এবং বীর উত্তম শাখায় একজন মাত্র রয়েছেন বেসামরিক যোদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে যুদ্ধে অবদানের জন্য চারটি বিশেষ শাখায় খেতাব দেয়া হয়। সবচেয়ে বেশি সাহসিকতার জন্য সাত জনকে দেয়া হয় বীরশ্রেষ্ঠ পুরস্কার। এদের মধ্যে ছয় জন যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন, একজন পাকিস্তান থেকে বিমানসহ পালিয়ে আসার সময় শত্রুর গুলিতে শহীদ হন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক হিসেবে দেয়া হয়েছে বীর উত্তম পদক। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য মোট ৬৮ জন পেয়েছেন এই খেতাব। যদিও পরে অন্য এক জনকে এই পদক দেয়া হয়েছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ পদক বীর বিক্রম পেয়েছেন ১৭৫ জন এবং সবশেষ বীর প্রতীক দেয়া হয়েছে ৪২৬ জনকে।

১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গেজেটের একটি অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই খেতাবপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা অন্য অনেক যুদ্ধের চেয়ে ব্যতিক্রমই বলা যায় যেখানে নেতৃত্ব এবং যোদ্ধা-দুইই এসেছে রাজনৈতিক বলয় বা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে। যার নেতৃত্বে যুদ্ধ হয়েছে সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতি করেছেন। যুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রবাসী সরকারেরও প্রায় সবাই ছিলেন রাজনীতিবিদ। আবার সামরিক বাহিনী ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলা বাহিনী, মুজিব বাহিনীসহ নানা বাহিনীতে যোদ্ধাদের তিন চতুর্থাংশেরও বেশি ছিল বেসামরিক লোকজন।

যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশকে যে পরিমাণ রক্ত দিতে হয়েছে তা অভাবনীয়। ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ আর চার লাখেরও বেশি নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে সাত কোটি মানুষের এক কোটি মানুষ যেমন ভারত-মিয়ানমারে আশ্রয় নিয়েছিল, তেমনি কয়েক লাখ মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়েছিল হাতে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম। এই বাহিনীর মধ্যে যারা দেশের পূর্ব অংশ বা পূর্ব পাকিস্তানে ছিল তাদের একটি বড় অংশ বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়, সেই সঙ্গে পশ্চিম অংশ থেকেও পালিয়ে আসে শত শত সেনা। তারপরও ইতিহাসবিদরা মনে করেন এই যুদ্ধটি জনযুদ্ধ হিসেবেই পরিচিতি পাওয়া উচিত ছিল। কারণ যোদ্ধাদের সিংহভাগই ছিল একেবারেই সাধারণ মানুষ যাদের কখনও হাতে অস্ত্র তুলে নেয়ার কথা ছিল না।

এই সাধারণ মানুষ অল্প সময়ের প্রশিক্ষণে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে দুর্ঘঙ্ঘনীয় হয়ে উঠে তাদের দেশপ্রেম, নিষ্ঠা আর সাহসের কারণে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, যারা নিজেদেরকে অজেয় বাহিনী বলে দাবি করত, তারা বারবার নাস্তানাবুদ হয়েছে বাংলাদেশের গেরিলা যোদ্ধাদের হাতে।।

কিন্তু যুদ্ধশেষে যুদ্ধে অবদানের জন্য যে পদক দেয়া হয়, তার মধ্যে সাত জনকে বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও বেসামরিক যোদ্ধাদের কাউকে কাউকে এই পদক দেয়া হয়নি। একইভাবে বীরউত্তম হিসেবে বেছে নেয়া ৬৯ জনের মধ্যে একজনই মাত্র ছিলেন বেসামরিক যোদ্ধা। একইভাবে বীর বিক্রম ১৭৫ জনের মধ্যে কেবল ৩৮ জন বেসামরিক যোদ্ধা এবং পুলিশ। সেই তুলনায় সবশেষ শাখা বীর প্রতীকে বেসামরিক যোদ্ধার সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। মোট ১২০ জন বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা এই খেতাব পেয়েছেন। আর সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এই খেতাব পেয়েছেন ৩০৬ জন।

ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর কয়েক হাজার সেনার পাশাপাশি সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারাও ব্যাপক অবদান রেখেছেন। খেতাব দেয়ার সময় এই অবদান সেভাবে উঠে আসেনি।

এমনকি খেতাবপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পর প্রথম প্রতিরোধকারী পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও বঞ্চিত হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন ফোরামে বিভিন্ন সময় তারা বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন। তাদের বঞ্চনার এই বিষয়টি সংসদ পর্যন্ত গড়িয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘খেতাব প্রাপ্তদের বেশিরভাগই সামরিক বাহিনীর। এই খেতাব দেখলে মনে মুক্তিযুদ্ধটি সেনা যুদ্ধ ছিল। কিন্তু আসলে তো সেটি ছিল জনযুদ্ধ।’

কেন এমনটি হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমার ধারণা বেসামরিক লোকজন যারা যুদ্ধ করেছে তারা খেতাবের বিষয়টি মাথায় রাখেনি। আর যুদ্ধের রেকর্ডও কেউ রাখেনি। এটির জন্য যে পরে আবেদন করতে হবে বা এরকম কোনো খেতাবের বিষয় আছে সেটির দিকে তারা খেয়াল করেনি। যেকারণে তারা বঞ্চিত হয়েছে।’

মুক্তিযুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে যারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, তাদের একজন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী নিজেও। যুদ্ধের পর খেতাব দেয়ার ক্ষেত্রে কোন নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে কোনো নীতিমালা ছিল না। এই পদক দেয়ার জন্য ওই সময় একটি কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটির দায়িত্বে ছিলেন এ কে খন্দকার।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, এভাবে ঢালাওভাবে সামরিক বাহিনীকে খেতাম দেয়াটা ঠিক হয়নি। বেসামরিক বাহিনীকেও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতে পারতো তারা।

এখন কি সরকার বিষয়টিকে পুনর্মুল্যায়ন করবে- এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘সরকার চাইলে তো মূল্যায়ন করতেই পারে। বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি। তবে যার যা প্রাপ্ত তাকে সেটা দেয়া উচিত বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।’

সশস্ত্র বাহিনীর বাইরে স্বল্পসংখ্যক বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা পদক পাওয়ার ঘটনা নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচিত হয়। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর সংসদের প্রশ্নোত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া। মন্ত্রী তার জবাবে মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক ও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদেরও বীরত্বের জন্য ‘বীরত্বসূচক খেতাব’ পুনর্মূল্যায়ন করার কথা জানান। তিনি বলেন,‘ মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক ও সিভিলিয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের মূল্যায়ন করে খেতাব না দেওয়া হলে মনে হবে এটা সামরিক মুক্তিযুদ্ধ ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সামরিক নয়, রাজনৈতিক জনযুদ্ধ ছিল।’

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার কারণে খেতাব প্রদানে বৈষম্য হয়েছে। সামগ্রিক এই সম্মান ও কৃতিত্বটি কেবল সামরিক ক্ষেত্র নয়, সব ক্ষেত্রকে মূল্যায়ন করা উচিত ছিল।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আশফাক হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা যে খেতাব দেখি তাহলে মনে হয় এই যুদ্ধে প্রধান যোদ্ধা ছিল সামরিক বাহিনীর লোকজন। কিন্তু এক গবেষণায় দেখা গেছে ৭০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাই ছিল বেসামরিক। খেতাব দেয়ার সময় যে কমিটি হয়েছিল তার বেশিরভাগই ছিলেন সামরিক বাহিনীর সদস্য। তারা যে দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখেছেন, সেভাবেই তারা তালিকা করেছেন।’

বীরশ্রেষ্ঠ

বীর শ্রেষ্ঠ বীরত্বের জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ খেতাব। যুদ্ধক্ষেত্রে অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপনকারী যোদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ এই পদক দেয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের খেতাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিটি সামরিক ও আধা-সামরিক সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত সাত জনের মধ্যে পাঁচ জন সামরিক ও দুই জন আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য।

বীরউত্তম

বীর উত্তম বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্বের খেতাব। সর্বশেষ ২০১০ সালেও একজনকে এই পদক দেয়া হয়। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদের মরণোত্তর পদক গ্রহণ করেন তার স্বজনরা। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের আগস্টে বাঁচানোর চেষ্টার জন্য তাঁকে ২০১০ সালে মরণোত্তর বীর উত্তম খেতাব দেয়া হয়।

আর মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে ৬৭ জন বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য। এখানে মাত্র একজন রয়েছেন বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা। তিনি হলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী।

বীরবিক্রম

বীরবিক্রম তৃতীয় সর্বোচ্চ খেতাব। এই পদক পাওয়াদের মধ্যে এর মধ্যে ১৩৭ জন বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর সদস্য। বাকি যে ৩৮ জন জন এই খেতাব পেয়েছেন তারা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলা, মুজিব বাহিনী এবং পুলিশ থেকে আসা যোদ্ধা।

বীরপ্রতীক

বীর প্রতীক চতুর্থ সর্বোচ্চ উপাধি। মোট ৪২৬ জনকে এই খেতাবে ভূষিত করা হয়। এদের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর সদস্য ১২০ জন ও সামরিক বাহিনীর সদস্য ৩০৬ জন।

(ঢাকাটাইমস/১৫ডিসেম্বর/এমএম/ডব্লিউবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :