বুদ্ধিজীবীদের সেকাল, একাল ও আকাল

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:১৭

চট করে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করি বলেন তো, ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কী দিবস কিংবা কাল কততম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস গেল? অনেকেই হয়ত বলতে পারবে না। এ জাতীয় দিবসগুলো জাতি হিসেবে আমরা সিরিয়াসলি পালন করি না বলেই আমি মনে করি। মনের থেকে পালন করলে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলত; আমরা দেশকে ভালোবাসতাম; আমরা স্বার্থপর, ভোগবাদী আর দুর্নীতি ও ময়লা-প্রিয় হতাম না।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে ‘বুদ্ধিজীবী’ কিংবা অন্যান্য জাতীয় দিবস পালন করে। তবে সবাই রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে এসব দিবস পালন করে- একথা বললে, জনগোষ্ঠীর দেশপ্রেমিক ও সৎ অংশটির প্রতি অবমূল্যায়ন করা হয়।

সারাবছর ঘুষ খেয়ে, নানা দুর্নীতি করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠা অনেকেই তো আনুষ্ঠানিকভাবে এসব দিবস পালন করে, ছবি তোলে। টেলিভিশনে, সংবাদপত্র, ফেসবুকে এসব ধূর্ত রাজনীতিবিদ, আমলা ও সাংস্কৃতিক সংগঠকদের ছবিই বেশি আসে। অন্যদিকে বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিকসহ অন্যান্য খেটে খাওয়া মানুষ, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও কৃষিবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন। গ্রামের হাজার হাজার কৃষক হয়ত কোনোদিনই রাজধানী ঢাকায় আসেনি, কিন্তু কী অসীম সততা আর সাধনা নিয়ে প্রতিদিন রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে চলেছে। আশুলিয়া কিংবা সৌদি আরবে কর্মরত শ্রমিক ভাই-বোনেরা প্রতিদিন জন্মভূমির প্রতি নিজেদের ঋণ তিলে তিলে শোধ করছেন। অথচ দেশের গণমাধ্যমে অর্থনীতির এই নেপথ্যের নায়কেরা একেবারেই অনুপস্থিত।

বুদ্ধিজীবী দিবসে তাই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সম্মান জানাতে গিয়ে কিছু তিক্ত, কিন্তু প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কথা বলা জরুরি হয়ে উঠেছে। নির্দিষ্ট একটা দিনে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হলেও ১৯৭১ ‘বুদ্ধিজীবী’ নিধনযজ্ঞ প্রায় পুরো নয় মাস জুড়েই চলে। যেমন ২৫ মার্চ যেদিন ঢাকায় হামলা হল, সেদিনই ইত্তেফাক ও সংবাদের কয়েকজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। আর সে ভয়াল রাতের নিষ্ঠুর হামলায় কত শিক্ষক, ছাত্র, লেখক, কবি-সাহিত্যিক-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার মারা গেছেন, তার সঠিক হিসেব রাখা সহজ কাজ নয়।

রাজারবাগের সে প্রতিরোধযোদ্ধা বীর পুলিশ ভাইদের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। সেই শুরু, এর পর মুক্তিযোদ্ধারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর অত্যাচারও বেড়েছে।

১৯৭২ সালের প্রকাশিত নানা পত্র-পত্রিকার খবর ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ-বক্তৃতা অনুযায়ী, ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের স্থানীয় দোসররা। ৩০ লাখ মানুষের হত্যাকে স্মরণ করার জন্য বিশেষ কোনো দিবস না থাকলেও, ১৪ ডিসেম্বর নিহত শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তারসহ নানা পেশার মেধাবী মানুষগুলোকে হত্যাকে স্মরণ করার জন্য বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রচলন করা হয়। দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী আবুল কাশেম ফজলুল হকের এক টেলিভিশন অনুষ্ঠান থেকে জেনেছি, ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ‘বুদ্ধিজীবী দিবস’ পালন শুরু হয়। ২৫শে মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের একটা দাবি উঠেছিল গতবার। খুবই ন্যায়সঙ্গত দাবি। এত বড় গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাছাড়া আমরা জানি যে, দুই লাখ নারীর উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের স্থানীয় দোসররা। অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করা সেসব নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করার জন্যও আমরা বিশেষ কোনো দিবস রাখিনি।

পরাজয় নিশ্চিত জেনে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি আর্মি অফিসারদের নির্দেশে স্থানীয় জামায়াত, আল-বদর, আল-শামস বেছে বেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের হত্যা করে। উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। স্বাধীনতা-বিরোধীরা তাদের পরিকল্পনায় কতখানি সফল হয়েছে, তা আমরা পরবর্তীতে দেখতে পেয়েছি। ১৬ ডিসেম্বর শত্রুশক্তির পরাজয় নিশ্চিত হলেও হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা থেমে যায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রায় পুরো পরিবারসহ হত্যা করা হয়। কদিন পর ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের চার গুরুত্বপূর্ণ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এএইচ এম কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে হত্যা করা হয়। এগুলো ছাড়াও, সেনাবাহিনীতে যেসব অফিসারগণ মুক্তিযুদ্ধফেরত ছিলেন, তাদের প্রায় সবাইকে নানা অজুহাতে কোর্ট মার্শাল করে বা গুলি করে হত্যা করা হয়।

অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশ যেন কখনোই সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হতে না পারে এ জন্য এ এক হীন প্রক্রিয়া। অবশ্য মেধাবী সন্তানদের হারিয়ে ফেলা শুরু সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু এলিট ও জমিদার শ্রেণির বিশেষ আগ্রহে, তৎকালীন ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক শক্তির সম্মিলিত প্রয়াসে ধর্মের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তৎকালীন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের জন্য সমমনাদের নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললেও দিল্লীতে মুসলিম লীগের জিন্নাহ আর কংগ্রেসের জহরলাল নেহেরুর যৌথ বিশ্বাসঘাতকার জন্য সফল হতে পারেন নি। হিন্দুদের আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ভারত জন্ম নিলে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের মেধাবী হিন্দু শিক্ষক, বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের একটা বড় অংশ পূর্ববঙ্গকে প্রায় শূন্য করে দিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন।

পূর্ব-পাকিস্তান নাম নিয়ে পূর্ববঙ্গ নতুন করে যাত্রা শুরু করে। দীর্ঘদিন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বাংলা কোনো পত্রিকা বের হয়নি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইত্তেহাদ আর মিল্লাত পত্রিকা ছিল প্রথম দিকের ভরসা। পাকিস্তানের জন্মের ঠিক আগে, ১৯৪৭ সালের জুন-জুলাই মাসে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকসহ গুটিকয়েক ‘বুদ্ধিজীবী’ বাংলা ভাষার প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানি এলিটদের অপমানজনক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাঙালি জনসাধারণকে সতর্ক করেছিলেন। ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান টিকবে না, মর্মে সতর্কবাণীও দিয়েছিলেন তাঁরা।

১৯৪৭ এর দেশভাগের ফলে বড় বড় ‘বুদ্ধিজীবী’গণ পূর্ববঙ্গ ছেড়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়ায় পাকিস্তান আমলে ‘বুদ্ধিজীবী’ পরিচয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে আওয়াজ তোলার মত মানুষ ‘বুদ্ধিজীবী’ মহলে খুব বেশি ছিল না। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে যারা ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে’ বড় বড় পজিশন উপভোগ করেছেন, তাদের অনেকেই পাকিস্তান আমলে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ হিসেবে কাজ করেছেন বলে কোনো কোনো বই-পত্রে লেখা আছে। তবে পাকিস্তান আমলে রাজনীতিবিদ হিসেবে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কিংবা সাংবাদিক হিসেবে দৈনিক ইত্তেফাকের মানিক মিয়া ভাষার মর্যাদা ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আপোষহীন চরিত্রের ঐতিহাসিক নজির হয়ে আছেন। তাদের মত আরও কিছু প্রগতিশীল মানুষের সম্মিলিত ও সময়োচিত তৎপরতায় পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর নানা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আগ্রাসন বাঙালির অগ্রযাত্রাকে সে সময় ব্যহত করতে পারেনি। আরবি হরফে বাংলা চালু করার মত অবৈজ্ঞানিক ও আধিপত্যবাদী আচরণও বাঙালি মেনে নেয়নি। বরং স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের প্রক্রিয়ায় বাঙালি একটু একটু করে এগিয়ে গেছে।

প্রকৃত পক্ষে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের নানাবিধ কর্মতৎপরতা দিয়ে বাঙালি জাতির মানসে এতটাই প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান চর্চায় যে বিশাল ঘাটতি ছিল, তা খুব বড় বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমরা দেখি সরকারি টেলিভিশন বা রেডিও চ্যানেলের ঢাকা অফিস সরকারের নির্দেশ অমান্য করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত টেলিভিশন আর বেতারের শিল্পীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ কেন্দ্রের মত মহান গণমাধ্যমের জন্ম দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের মনোবল চাঙ্গা করতে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অসাধারণ।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের কলেজে দিব্যি চাকরি করেছেন, বেতন-ভাতা নিয়েছেন। আমি শুনেছি, কবি শওকত ওসমান ঢাকা কলেজের যে পদ ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, সে পদে পরে এসে একজন জয়েন করেছিলেন। এই ব্যক্তি এখন বাংলাদেশের অন্যতম সুবিধাপ্রাপ্ত ও ‘আলোকিত’ বুদ্ধিজীবী। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে ক্যাম্পাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হামলা চালিয়ে অনেক শিক্ষক-ছাত্রকে হত্যা করেছিল। পরবর্তী নয় মাস, ১৪ ডিসেম্বরের সেই বেদনায়দায়ক দিবসের আগে, ক্যাম্পাসের শিক্ষকরা কী করছিলেন, কত জন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন, কতজন আরাম-আয়েশে দিন-রাত্রি যাপন করেছেন, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। মুরুব্বিদের মুখে এবং লেখায় এমনও জানা গেছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক প্রতিবেশী শেরাটন হোটেলে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে গলা ভেজাতে আসতেন। ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-রাজনীতিবিদরা যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সবাই কী করছিল আমার জানার খুব ইচ্ছা।

বর্তমানে আমরা যেমন দেখি-দুর্নীতি-অনিয়মে সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশে বাংলাদেশের অর্থ-সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে, দেশের হিন্দুরা দিন দিন হিন্দু হয়ে যাচ্ছে, মুসলমানেরা দিন দিন মুসলমান হয়ে যাচ্ছে, জামায়াত নিষিদ্ধ হচ্ছে না, বরং ভারতের বিজেপি-শিবসেনারা বাংলাদেশে শাখা-প্রশাখা খুলছে, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা থামছে না, ভারত থেকে ফেন্সিডিল আর মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এসে আমাদের তরুণ সমাজকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে, বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে আর শিক্ষকদের একাংশের যোগসাজশে প্রায় সকল সরকারি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় পরীক্ষাসমূহ বাতিল করছেন না, ইংলিশ মিডিয়াম ও মাদ্রাসাসহ নানামুখী শিক্ষাব্যবস্থা বিদ্যমান, চমৎকার ইংরেজি জানা ছেলেরা গুলশানে ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে কিংবা শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আমলাতন্ত্র তথা সর্বত্র এক শ্রেণির অদক্ষ ও অসৃজনশীল মানুষের আধিপত্য; কিন্তু দেশের বড় বড় ‘বুদ্ধিজীবী’দের যেন এসব নিয়ে মাথাব্যাথাই নেই।

বুদ্ধিজীবীদের পরিচয় এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা বহিঃশক্তির সাথে সম্পৃক্ততার উপর নির্ভর করে। যতই দেশের সর্বনাশ হোক, বর্তমানের বুদ্ধিজীবীদের একাংশের কোনো নড়চড় লক্ষ্য করা যায় না। অন্যদিকে আরেকদল ‘বুদ্ধিজীবী’ আছেন, যারা অত্যন্ত কৌশলে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন। এদের অনেকেই ‘সুশীল’ সমাজভুক্ত। ভালো ইংরেজি বলতে পারেন; ইনাদেরকে প্রায়শঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের অফিস, বাসায় নানা রঙের পানি পান করতে দেখা যায়। ইনারা বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য পুঁজিবাদী সংগঠনের ‘মুখপাত্র’ হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশ-বিরোধী কোনো দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ইনারা মুখ খুলেন না। বাংলাদেশের কোনো অগ্রগতিই এই বুদ্ধিজীবীদের চোখে পড়ে না। মূলত বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠন ও জাতিগঠন প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান ব্যর্থতার জন্য এই ইংরেজি জানা, মার্কিন-ঘেঁষা বুদ্ধিজীবী মহল আংশিকভাবে দায়ী।

দেশে আরেক শ্রেণির মানুষ আছেন যারা নিজেদের ‘আলেম’ বলে দাবি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পড়ুয়া শ্রেণিকে এই ‘আলেম’ সমাজ পাত্তাই দিতে চান না। নিজেদের এলেমে এই শ্রেণি এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে বিশ্ব সভ্যতায় কী হচ্ছে, সেটা বোঝার প্রয়োজনও বোধ করেন না তারা। দেশের বড় এক আলেম একবার বললেন, মেয়েদের ক্লাস ফাইভের বেশি পড়াশুনার দরকার নাই। আরেক আলেম এই সেদিন ওয়াজ করলেন, নারীরা ধানক্ষেতে যায় বলে ফসল উৎপাদন কমে গেছে! তাই ধানক্ষেতে নারীর যাওয়া মানা! ‘খনার বচন’ বলে একটা শব্দযুগল আমরা ছোটবেলায় শুনেছি। কৃষির জন্ম দিয়েছে এ অঞ্চলে নারীরা। মেয়ে ও স্ত্রীর ভালোবাসা ছাড়া কৃষক অচল হয়ে পড়বে, কৃষকের মুখে হাসি না থাকলে এদেশের কৃষি মুখ থুবড়ে পড়বে। এমন ‘এলেম’ আমাদের আলেম সমাজ কোথায় পেয়েছেন, ভেবে পাই না। এসব লোকের জন্য মুসলমান হিসেবে অন্য ধর্মের মানুষের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। আবার ঢাকার ‘শিক্ষিত’ ও ‘সুশীল’ মহলও ‘আলেম’দের মত চরমপন্থায় নিমজ্জিত হয়েছেন। টুপি-দাঁড়িওয়ালাদের ইনারা মানুষের মর্যাদাও দিতে চান না।

আমাদের নিজস্ব গণমাধ্যম থাকলেও, দেশের মানুষ বিদেশি চ্যানেল, অনুষ্ঠান নিয়েই ব্যস্ত। হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’ আর শাইখ সিরাজের ‘মাটি ও মানুষ’ ছাড়া ভালো কোনো টেলিভিশন প্রোগ্রামের নাম মানুষ বলতে পারবে না। আমাদের মা-খালা-চাচিরা এবং ইদানিং বাবা-চাচারাও ভারতীয় চ্যানেলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন। বাচ্চাদেরকে রক্ষায় যদিও এগিয়ে এসেছে ‘দুরন্ত টেলিভিশন’। অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলের সৃজনশীলতার মান খুবই নিম্নমানের। টক শো, নেতিবাচক সংবাদ আর ডাবিং করা বিজ্ঞাপন দেখানো ছাড়া, এসব চ্যানেলের যেন আর কোনো অনুষ্ঠান জানা নেই।

স্বাধীন বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীরা জাতিকে এক সূতায় গাঁথতে পারেননি। কিন্তু পুঁচকে বয়সী সব ক্রিকেট খেলোয়াড়রা জাতিকে একতা এনে দিয়েছেন। যে কাজ বই-পত্র, গল্প-উপন্যাস, টেলিভিশন-সিনেমা পারেনি, সে কাজে দারুণ ভূমিকা রাখছেন আমাদের ক্রিকেটাররা। একমাত্র ক্রিকেট খেলা হলেই দেখা যায়, হিন্দু-মুসলমানেরা একসাথে হাত হালি দিচ্ছেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামাতসহ সব দলের সাপোর্টাররা নিজ দেশের সাফল্যে উল্লসিত হচ্ছেন। তবে ভারত-পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ-ভারত খেলা হলে এদেশের মানুষের দ্বিধাবিভক্ত বর্ণচোরা চেহারাটা বের হয়ে পড়ে।

এত কিছুর পরেও বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়ে যায়নি। সমুদ্র সীমার আইনি লড়াইয়ে ভারত ও মিয়ানমারকে হারিয়ে, বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রকে পায়ে ঠেলে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করে দিয়ে বাংলাদেশ শক্তিমত্তার প্রমাণ দিয়েছে। বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে বিনিয়োগ-বান্ধব পরবর্তী ১১টি দেশের একটি। অর্থনীতি ভালোই আছে। কিন্তু দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইয়ে বাংলাদেশের পারফর্মেন্স খুব দুর্বল। ছেলে-মেয়েদের পোশাকের দিকে তাকালেই আমার কথার প্রমাণ মিলবে। বিশেষ করে মেয়েদের পোশাক দেখলে মাঝে মাঝে ইউরোপ কিংবা আফগানিস্তান-সৌদি আরব বলে ভ্রম হয়। নিজেদের কিছুই আমরা ধরে রাখতে পারছি না।

উপরের যে অম্লমধুর পরিস্থিতির ছবি আঁকলাম, সেখানে কার ভূমিকা কতটুকু পাঠক আপনারাই একটু ভাববেন। এ লেখা যখন লিখছিলাম, তখন খবর পেলাম, রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা স্মারক হিসেবে রাখা ফুলগুলো ৩০ সেকেন্ড এর মধ্যেই লুটপাট হয়ে গেছে। মাস কয়েক আগে ঢাকায় ‘ডিম’ উৎসবে শহুরে হাভাতে মানুষের হাঙ্গামা আমরা দেখেছি। বাসে উঠতে গেলে, রেলের টিকেট কাটতে গেলেও আমরা মানুষের অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমরা দেখছি প্রতিনিয়ত। কেন এমন হচ্ছে? এত অরাজকতা কেন চারপাশে? এগুলো খুঁজে দেখার দায়িত্ব কিন্তু বর্তমানের বুদ্ধিজীবীদেরই। কিন্তু তাঁরা কি পারছেন দায়িত্বটুকু পালন করতে?

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :