চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চেয়েছিলেন মহিউদ্দিন

কাওসার শাকিল, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:০৪
ফাইল ছবি

বড় অসময়ে চলে গেলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর মহিউদ্দিন। চট্টগ্রামে এলে বঙ্গবন্ধু ট্রেন থেকে নেমে প্রথমেই জিজ্ঞেস করতেন “আমার মহিউদ্দিন কই?” আওয়ামী লীগের দু:সময়ের সাথী এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিশ্বস্ততম সহচর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী দলের জন্য নিজের সর্বোচ্চ বিসর্জনেও পিছপা হননি কোনদিন। আওয়ামী লীগের প্রতি তার বিশ্বস্ততা নিয়ে সন্দেহ খুব সম্ভবত কোন দুর্জনও করতে পারবে না।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ধরা পড়েছিলেন চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে ক্যাম্পে নিয়ে পেটাতে পেটাতে বেহুশ করে ফেলে। তারপরও মুখ খোলেননি তিনি। শত নির্যাতনের মুখেও বলেননি কোথায় রয়েছে তার সঙ্গী সাথীরা। নির্যাতন সইতে না পেরে বার বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন। একসময় পিপাসায় কাতর মহিউদ্দিন এক গ্লাস পানি চেয়েছিলেন। পাকিস্থানী এক মেজর বোতলের ভেতর প্রস্রাব করে তাকে খেতে দিয়েছিলো। তবুও মহিউদ্দিন চৌধুরী মুখ খোলেন নি, বেইমানী করেননি দেশের সাথে, দেশের মানুষের সাথে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জাতির জীবনে নেমে আসে ঘোর দুঃসময়। আকস্মিক ট্র্যাজেডিতে বিপর্যস্ত বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এই বিপর্যস্ত সময়ের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের একদল নেতাকর্মী। সশস্ত্র প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার অকল্পনীয় এক দু:সাহসী পরিকল্পনা করেছিলেন তারা। এরকম পরিকল্পনা করার মতন দু:সাহস যিনি দেখিয়েছিলেন তিনিই এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রীরা সবাই তার অনুগত-এটা বোঝাতে পল্টনে জনসভা ডাকলেন খন্দকার মোশতাক। গোয়েন্দা সংস্থা-পুলিশ-সেনাবাহিনীতে ভরপুর পল্টন ময়দান। মহিউদ্দিন চৌধুরী তার সাথের লোকজনকে নিয়ে ঠিক করলেন এই জনসভা ভন্ডুল করবেন বলে ঠিক করলেন। বোমা-গ্রেনেড না, মহিউদ্দিন বললেন “ জনসভায় সাপ ছেড়ে দেবো।“ সবাই লুফে নিল। সাপ জোগাড়ও করা হলো। শেখ মনির বডিগার্ড শাহাবুদ্দিন সাবু’র নেতৃত্বে কয়েকজন গিয়ে সাপ ছেড়ে দিয়ে আসল খন্দকার মোশতাকের মিটিং এ। সাথে সাথে মিটিং ফেলে সব পালিয়ে গেলো। মিটিং আর হলো না।

এমন কান্ড করে পঁচাত্তরের অক্টোবরেই গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন মহিউদ্দিন। সামরিক আইনে গ্রেপ্তারের প্রায় ছয় মাস পর রাজশাহী ‍কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। ততদিনে তার রাজনৈতিক সহচরদের অনেকেই চলে গেছেন ভারতে। মুক্তি পেয়ে মহিউদ্দিনও যান সেখানে। তার কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে স্বশস্ত্র বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা একটা দেশ হিসেবে ঘোষনা দিতে। আগরতলায় ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ নেয়াও শুরু হয়ে যায়। হিমালয়ের তান্দুয়ায় হয় উচ্চতর প্রশিক্ষণ। তাদের পরিকল্পনা ছিলো প্রথমে থানা-ফাঁড়ি আক্রমণ করা হবে, রাস্তায় রাস্তায় গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। চট্টগ্রাম বন্দরকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে পুরো চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। এটাই ছিল তাদের পরিকল্পনা। সেই মোতাবেক চলছিলো অস্ত্র শস্ত্র সংগ্রহের কাজও। প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ কেউ চট্টগ্রামে ফিরে গ্রেনেড বানাতে শুরু করেন। হাতে বানানো বলুয়ারদিঘীর পাড়ের আবু তালেব আর আবু কালাম গ্রেনেডগুলো নিজেদের হেফাজতে রাখতেন। আগ্রাবাদ-আন্দরকিল্লায় কয়েক দফা গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল।

১৯৭৭ সালের প্রথমদিকে ‍তারা হাতে তৈরি কিছু গ্রেনেড পান। কিন্তু গোলদার নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী সেগুলো চট্টগ্রাম স্টেশনে আনতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। অস্ত্রের অভাবে মহিউদ্দিন এবং তার দল বড় কোনো অপারেশন করতে না পারলেও প্রায় প্রতিদিন চট্টগ্রাম শহরে গ্রেনেড চার্জ করতেন। এতে সরকার তাদের সশস্ত্র বিদ্রোহের কথাও জেনে গিয়েছিল।

১৯৭৭ সালের মাঝামাঝিতে ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যায়। বাংলাদেশেও ক্যু, পাল্টা ক্যু’র ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় আসে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান।

প্রশিক্ষণরত নেতাকর্মীদের অনেককে পুশ ব্যাক করে ভারত। টিকতে না পেরে অনেকেই বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এতে সশস্ত্র প্রতিবাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছেদ পড়ে।

তাদেরই এক সহযোগী ১৯৭৮ সালে মৌলভী সৈয়দ দেশে ফেরার সময় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান। তাকে নির্মমভাবে গুলি করে খুন করা হয়। ফিরতে গিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ট সহচর অমল মিত্র গ্রেপ্তার হন। তারপরও গ্রেপ্তারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে ১৯৭৯ সালের দিকে গোপনে দেশে ফেরেন মহিউদ্দিন। জিয়া সরকার শুরু থেকেই তাদের প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিয়ে সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেন।

১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা যখন দেশে আসলেন তখন সবাই বাকশাল নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি পার্টি অফিসও বেদখল, তালা মারা। ঢুকতে পারছেন না। তখন এই এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরি চট্টগ্রাম থেকে দলবল লাঠিসোটা নিয়ে পার্টি অফিসের তালা ভেঙে অফিস দখল করেছিলেন এবং নেত্রীকে অফিস বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

জাতীয় আন্দোলনেও সামনের সারিতে দেখা গেছে তাকে সব সময়। ১৯৯০ সালে চট্টগ্রামে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বন্দর রক্ষা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিলো অবস্মারণীয়।

চট্টগ্রামবাসীর সেবা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়রের দায়িত্ব কাধে নেন এবিএম মহিউদ্দিন। তবে মেয়রের চেয়ার ছাড়বার পরও চট্টগ্রামের দেখ ভাল করা ছাড়েননি তিনি। ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে জন্মদিনে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছার জবাবে মহিউদ্দিন বলেছিলেন, “টিল ডেথ, আই উইল ডু ফর দ্য পিপল অব চিটাগং, চট্টগ্রামের মানুষকে আমি ভালোবাসি।”

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :