সুফিয়ার আর কোনো দুঃখ নেই

জহির রায়হান, জয়পুরহাট থেকে
| আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ২১:৪৪ | প্রকাশিত : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ২১:৩৮

জীবন চলতো অন্যের করুণায়। অসুস্থতার কারণে অন্যের দুয়ারে দুয়ারে যেতে না পারলে থাকতে হতো অনাহারে। ভিক্ষাবৃত্তি যখন নিত্য ঘটনা তখন কেউ ফিরিয়ে দিত, কেউবা করুণা করতো যতসামান্য। যা পাওয়া যেত তা দিয়ে পেট চালানোই কঠিন, সেখানে স্বাস্থ্য, বস্ত্র তো অনেক দূরের বিষয়। কিন্তু এখন ঘুচে গেছে দু:খ, বদলে গেছে সেই দিন। পরনির্ভরশীল সেই ভিক্ষা বৃত্তির জীবনের অবসান হয়েছে, জীননমান এখন সমৃদ্ধির পথে।

সুফিয়া খাতুন। যিনি দীর্ঘ ১৫ বছর ভিক্ষাবৃত্তি করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার বাড়ি জয়পুরহাট জেলার নিক্তিপারা গ্রামে। সরেজমিনে তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কীভাবে তিনি সচ্ছল জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

এ প্রতিবেদককে সুফিয়া জানান, দরিদ্র দিনমজুর পরিবারে জন্ম সুফিয়ার। অভাবের সংসারে ঠিক মত খাবারও জুটতো না। একটু বড় হওয়ার পর অন্যের বাড়িতে কাজ করার জন্য রেখে আসা হয়। এরপর মাত্র ১২ বছর বয়সে পাশের নিক্তিপাড়া গ্রামের মকবুল হোসেন নামে এক ভ্যানচালকের সঙ্গে বিয়ে দেয় সুফিয়াকে। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে বিয়ের ছয় মাসের মাথায় স্বামীকে নিয়ে নিক্তিপাড়া গুচ্ছগ্রামে একটি জীর্ণ বেড়ার ঘরে আশ্রয় নেন।

২০০২ সালে মকবুল পঙ্গু হলে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে সুফিয়ার। এক পর্যায়ে সুফিয়া বেছে নেন ভিক্ষার পথ। সারাদিন ভিক্ষা করে মেয়ে ও অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে চলতে থাকে সংসার। চিকিৎসার অভাবে ২০০৮ সালে মকবুল মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়ে সখিনাকে নিয়ে খুব বিপদে পড়েন। কোনো উপায় না পেয়ে গাইবান্ধা জেলার কামদিয়া এলাকার একজন দিনমজুরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন।

এতে তার কষ্ট আরো বেড়ে যায়। এই অবস্থায় ২০১০ সালে পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সমৃদ্ধি কর্মসূচি ধলাহার ইউনিয়নে জরিপের মাধ্যমে ১০৪ জন ভিক্ষুকের একটি তালিকা করে। পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনায় গঠিত কমিটির সার্বিক যাচাই-বাছাই শেষে সুফিয়ার পরিবারকে পুনর্বাসন কার্যক্রমের জন্য মনোনীত করে। ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় জাকস ফাউন্ডেশন ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দেয়ার মৌখিক ও লিখিত চুক্তির মাধ্যমে দুইটি গাভী ও একটি বাছুর কিনে দেয়। আর এর মাধ্যমে নিজেকে আয় বর্ধনমূলক কাজে সম্পৃক্ত করে জীবনযুদ্ধে হার না মানা সুফিয়ার ভিক্ষাবৃত্তির অবসান ঘটে। বর্তমানে দুইটি গাভী দুইটি বাছুরের মাধ্যমে প্রতিদিন পাঁচ কেজি দুধ হয়। ওই দুধ বিক্রি করে মাসিক আয় আসে পাঁচ হাজার ২৫০ টাকা।

এছাড়াও মুরগী, কবুতর, বিভিন্ন ফল ও সবজি চাষ থেকে প্রচুর আয় হয় তার। বর্তমানে সুফিয়ার বাড়িটি একটি সুন্দর সমৃদ্ধ বাড়ি।

সুফিয়ার আর কোনো দুঃখ নেই। সব সময় তার চোখে-মুখে হাসি লেগেই থাকে।

একই গ্রামে আবু বক্করও দেখেছেন সুখের মুখ। ভিক্ষাবৃত্তি করেছেন ২০ বছর। ছিলেন সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে একজন। তারও দিন বদলেছে। আশপাশের প্রতিবেশীদের তুলনায় তিন কম আয় করেন না। এতে সমাজে তার অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। সামাজিক এই অবস্থান পরিবর্তনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে পিকেএসেফের সমৃদ্ধি কর্মসূচি।

আবু বক্কর বলেন, ২০১৫ সালে স্যারেরা আমাকে টাকা দেন। আমাকে প্রজনন সেন্টার দিতে সহায়তা করেন। দুইটা ষাঁড় ও একটি পাঠা দিয়ে প্রজনন কাজ করা হয়। ছাগল প্রজনন করতে একশন টাকা ও গরু প্রজনন করতে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা নেওয়া হয়। চিনা হাঁস ও রাজ হাঁস পালন করি আমি। আমি এখন ভালো আছি।

পিকেএসেফের কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা জাকস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মো. নূরুল আমিন বলেন, এটা আমাদের অন্যতম প্রজেক্ট। তাদের এ সফলতা ধরে রাখা এখন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। তারা যেন আবার অর্থিক অসুবিধায় না পড়ে সে জন্য আমাদের টিম তাদের দেখাশুনা করছে।

ভিক্ষা একটা লজ্জাকর বিষয়। তাদের এ পেশা পরিবর্তন করে টেকশইভাবে আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি এবং মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় করার লক্ষ্যে ‘ভিক্ষুক পুনর্বাসন’ শীর্ষক এক প্রকল্প হোতে নেয় পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। তারা প্রতি ভিক্ষুকে এক লাখ টাকা দেয়। নিক্তিপাড়া, ধলাহার আওতয় জাকস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ইউনিয়নে ১০ জন ভিক্ষুককে বিভিন্ন আয় বর্ধক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

পিকেএসএফ এর সভাপতি কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক মূল স্রোতে আনার জন্য সরকার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে এই সমৃদ্ধি কার্যক্রম গ্রহণ করেছে পিকেএসএফ। এরমধ্যে অন্যতম হল ভিক্ষুকদের স্বাবলম্বী করা। এই উদ্যোগে বেশ সফলতা পাওয়া গেছে।

গণমাধ্যমের অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইয়ারএফ এর একটি প্রতিনিধি দল এখন ঘুরে রেড়াচ্ছে জয়পুরহাট জেলা। তারা ঘুরে দেখছে এ জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন। শুনছেন উদ্যোক্তাদের গল্প। কীভাবে তারা টার্কি মুরগি পালন করছেন, কুচিয়া চাষ করছেন, প্রাকৃতিকভাবে আলু সংরক্ষণ করছেন। শুনছেন কীভাবে বিদেশে যাওয়ার সপ্ন ছেড়ে দেশেই ব্যবসা করছেন সে গল্প।

(ঢাকাটাইমস/১৫ডিসেম্বর/জেআর/জেডএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :