মহাকাব্যময় মোহন জাদু

সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম
 | প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৪৩

বেশ কয়েকদিন ধরে লিখবো লিখবো ভাবি কিন্তু লিখতে বসলে শরীর রাজ্যের ক্লান্তিতে ছেয়ে ফেলে। সারাদিনের প্রয়োজনীয় কাজ শেষে রাতে যখন অবসর নিয়ে লিখতে বসি তখনই ক্লান্তি এসে চেপে বসে। স্মৃতি হাতড়ে লিখতে হয় বলে ক্লান্তি আরও বেশি লাগে। স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানোর সুবিধা-আসুবিধা দুইটিই আছে। সুবিধা হল স্মৃতি আর বর্তমানকে সমন্বয় করে সত্য আর সঠিককে বেছে চলা যায়। আর অসুবিধা হলো স্মৃতিগুলো মন থেকে খুঁজে বের করার ক্লান্তিময়তা আর এর সাথে থাকে স্মৃতির সাথে বর্তমানের অমিল, যা কিছু বা যাদের জন্য তাঁদের কাছে শত্রুভাবাপন্ন হবার সম্ভাবনা।

ভেবেছিলাম ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস নিয়ে লিখবো। আবার ভেবেছিলাম আমাদের জন্য, বাংলাদেশের জন্য কালজয়ী, ঐতিহাসিক অত্যন্ত মর্যাদাময় অহংকারের স্বীকৃতি- “ইউনেস্কোর মেমরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ অন্তর্ভূক্তকরণ।” এই বিষয় নিয়ে কিছু লেখার সাহস করব কি না সেটাও মাথাতে রেখেছিলাম।

কালজয়ী এই মহাকাব্যতুল্য ভাষণ নিয়ে এতদিন অবাক বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে শুনেছি কবি, সাহিত্যিক আর গুণীজনদের বর্ণময় বর্ণনা। স্বাধীনতার এতবছর পর ৪৬তম মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে গর্বিত অবাক বিস্ময়ে শুনছি:

২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে সংস্থাটির মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এক বিজ্ঞপ্তিতে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্বালাময়ী ওই ভাষণটিকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে ঘোষণা করেন।

৭ মার্চের ভাষণ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত এক ঐতিহাসিক ভাষণ। ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্য অচিরেই বিতরণ করা হয়েছিল। এটি তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক কিছু পরিমার্জিত হয়েছিল। পরিমার্জনার মূল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা। ১২টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়৷ নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে-

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বা ‘বিশ্বের স্মৃতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে সংস্থাটির মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এক বিজ্ঞপ্তিতে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্বালাময়ী ওই ভাষণটিকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে ঘোষণা করেন।

এ ধরনের দলিলগুলো যে 'মেমোরি অব দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে' অন্তর্ভূক্ত করা হয় সে তালিকায় এ ভাষণটিকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

মূলত এর মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে যেসব তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ তালিকা প্রণয়ন করে ইউনেস্কো।

এমন কালজয়ী ভাষণ প্রদান এবং দেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী সেই ভাষণে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত হয়েই বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা।

-অনলাইন থেকে সংগৃহীত

এই মহাকাব্যময় ভাষণ নিয়ে আমার যা কিছু স্মৃতি শুধুই ভাষণটির রেকর্ড শোনা। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে বা যুদ্ধকালীন কখন বা কতবার ভাষণটির রেকর্ড শুনেছি এখন মনে করতে পারছিনা। তবে খুব সম্ভব যতদুর মনে পড়ে আব্বার সাথে লেপের ভিতর মাথা গুঁজে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এই ভাষণের কিছু অংশ না বুঝেও মন দিয়ে শুনেছি। লেপের মধ্যে মাথা গুঁজে থেকেছি আব্বার সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষাতে, আর মন দিয়ে শুনতে হয়েছে কোন শব্দ করা নিষেধ ছিল বলে। সম্ভবত তখন থেকেই এই কালজয়ী ভাষণটি আমার আজান্তেই আমার মনে আর স্মৃতিতে আসন করে নিয়েছিল। এরপর দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত নিয়মিতভাবে আমরা বিভিন্ন উপলক্ষে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাষণটি শুনেছি। তখনো ভাষণের মর্মার্থ খুব ভাল করে বুঝতে না পারলেও এতটুকু বুঝতে পারতাম যে এটি ছিল দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য কখনো বাঘ্রতুল্য হুঙ্কার, কখনো আবার আবেগময় ছন্দময় কাব্যিক উচ্চারণ, যা সবাইকে আবেগাপ্লুত করতো, উদ্দীপ্ত করতো, উজ্জীবিত করতো , অনুপ্রাণিত করতো , অনুরণিত করতো।

এর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভাষণটি বাজানো প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। আমি মনে করতে পারছিনা এই ভাষণটি ব্যাপকভাবে কোথাও এই সময়ের মধ্যে প্রচার হয়েছে কিনা।

আমি আমার পরিপূর্ণ বয়সে ১৯৯৬ সালে ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর যখন আবারো ব্যাপকভাবে ভাষণটি প্রচার করা হয় তখন সব কিছু ছাপিয়ে ভাষণটি মহাকাব্যিক ছন্দময়তা উপলব্ধি করি।

এসময় ভাষণটির প্রচারের নিষিদ্ধতার অশুভকাল শেষে মানুষ পরম উৎসাহে, উদ্দীপনাতে মাঠে ময়দানে সুউচ্চ স্থানে মাইক লাগিয়ে ভাষণটি প্রচার করতে থাকে যাতে প্রাণভরে সবাই আবার সেই ছন্দের যাদুতে অনুরণিত, অনুপ্রাণিত, উদ্দীপ্ত বা উজ্জীবিত হতে পারে। স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানতে পারে। ১৯৯৬ সালের ঠিক সে সময়ে আমরা পঞ্চগড় অবস্থান করছি। আমি আমার ‘কর্পোরেট’ চাকরি সাময়িকভাবে ছেড়ে দিয়ে জেলা প্রশাসক আমার স্বামীর সাথে প্রায় তিন বছর পঞ্চগড় অবস্থান করেছি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রথম মহান বিজয় দিবসে আমি আমার পরিপূর্ণতায় এই ছন্দময় যাদুকরী শক্তির আকর্ষণ অনুভব করতে পারি। সেদিন জেলা প্রশাসক তাঁর জেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত আনন্দ মিছিলে মিলিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাত ১২টা ১ মিনিটে স্থানীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে এবং বিজয় দিবসের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে আমাদের অনেক রাত হয়ে যায়।

পরদিন ভোরে স্থানীয় ময়দানে প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে সার্বজনীনভাবে বিজয় দিবস উদযাপিত হবে সেই আনন্দ চিন্তা মাথায় নিয়ে মধ্যরাত পার করে ঘুমাতে যাই। ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমার অভ্যাস রবীন্দ্র সংগীত অথবা ভাল কোন কণ্ঠে আবৃতি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া। সেদিন সম্ভবত রেকর্ড প্লেয়ারে কাজী সভ্যসাচী’র কণ্ঠে কবিতা আবৃতি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পরেছিলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না- আধো ঘুম আধো জাগরণে একটি ভরাট কাব্য কণ্ঠ আমাকে অনুরণিত করে ভীষণভাবে, যা আমাকে ধাবিত করতে থাকে অথবা আমাকে প্রবলভাবে পেছনে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। আমি ঘোরের মধ্যে চলে যাই, আমার মনে হতে থাকে আমি আব্বার সাথে কাঠ টিন ঘেরা চৌচালা বাংলো বাড়িতে বিছানায় শুয়ে লেপের মধ্যে মাথা গুঁজে কোনো মহাকাব্য শুনছি। আবার কখনো মনে হতে থাকে আমি বজ্রসম হুংকার আকর্ষণে এক হাতে ভাইয়ের ছোট হাত আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে ছোট একটি পতাকা উঁচিয়ে বাসার গেট পেরিয়ে, রাস্তা পেরিয়ে সামনের টাউন মাঠের অন্য প্রান্তে ছুটে চলছি যেখানে বিজয়ের মিলন মেলার আয়োজন চলছে।

আনন্দ অথবা কষ্ট দুটি আবেগময় অনুভূতি ঘুম-জাগরণের ঘোরে আমার কণ্ঠ হতে সম্ভবত অন্য রকম শব্দ হয়ে অস্পষ্ট ধ্বনিতে উচ্চারিত হয়...। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে মা’ মা’ শব্দে আমার ঘোর মেশানো ঘুম ছুটে যায়। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আমার ৬ বছরের মেয়েটি লাল–সবুজ মেশানো ছোট একটি শাড়ি হাতে আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। তার দুচোখে পানির ধারা। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে ‘তুমি কেন ঘুমের মধ্যে কান্না করছ। কেন আমাকে এখনি লাল শাড়িটি পরিয়ে সাজিয়ে বিজয় উৎসব দেখাতে মাঠে নিয়ে যাচ্ছ না। আমার সম্পূর্ণ ঘোর ছুটে যায় আমি চোখ মেলে চেয়ে দেখি কোন কাঠ ঘেরা বাংলো বাড়িতে লেপের মধ্যে মাথা গুঁজে আমি কাব্য কণ্ঠ শুনছি না বা কোন বজ্র কণ্ঠ টানে ভাইয়ের হাত ধরে পতাকা উচিয়ে মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বিজয় উৎসবে মলিত হতে ছুটছি না। আমি শুয়ে আছি চারিদিকে ধবধবে সাদা ওয়ালঘেরা জেলা প্রশাসক বাংলোতে। আমি আব্বার গা ঘেঁষে থাকা বা ভাইয়ের হাত ধরে থাকা শিশু অথবা কিশোরী নই, আমি পরিপূর্ণ বয়সের এক নারী। আমি স্ত্রী, আমি দুই সন্তানের জননী। যে শব্দের কাব্য যাদু এতক্ষণ আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো সে শব্দযাদু ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদেয় ভাষণ, যা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে প্রচার নিষিদ্ধ ছিল।

সেই বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ভাষণটি সর্বসাধারণের জন্য স্বাধীনতার এতবছর পর প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে বিজয় দিবসের উৎসবমুখর পরিবেশে শহরের চতুর্দিকে সুউচ্চ স্থান থেকে মাইকে প্রচারিত হচ্ছিল। যার জাদুকরী শব্দমন্ত্র এতক্ষণ আমাকে আচ্ছন্ন করে ঘোরের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিলো।

আমি বিছানা থেকে উঠে পড়ি বিজয় উৎসবে শামিল হবার জন্য। তৈরি হতে হতে আমি ছেলে মেয়েদের সহজ ভাষায় বুঝাতে থাকি সেই ভাষণের মর্মার্থ। অবাক বিস্ময়ে তারাও শুনতে থাকে সেই জাদুকরী মোহন সুকাব্য নিনাদ।

লেখক

আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ

ডিরেক্টর, প্রশাসন, রোটারি ক্লাব আবাহনিকুঞ্জ , ঢাকা

সাবেক প্রেসিডেন্ট, রোটারি ক্লাব ঢাকা পূর্বাশা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :