ছবির কথা কেউ শোনে না!

নিজস্ব প্রতিবেদক,টাঙ্গাইল
 | প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ২০:৪১

কিছু ছবি চিরচেনা। ছবিটি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে এক মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। ছবির মানুষটি নুরে-আলম তালুকদার। ছবি অনেক কিছুই বলতে চায়। কিন্তু কে শুনবে ছবির কথা। একাত্তরের এইসব দুর্লভ ছবিগুলো এখনো অযত্নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরের খাতায় নাম লিখেয়েছেন অনেকেই। জাতি তাদের আজও যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণ করছে। কারো বীরত্বের স্মৃতি মুছে গেছে। কারো বীরত্বে স্মৃতি আজও কথা বলছে। এরকম একটি বীরের নাম নুরে আলম তালুকদার। নুরে আলম টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলকী ইউনিয়নের জশিহাটী গ্রামের মৃত ইউসুফ তালুকদারের ছেলে। ৭ ভাই বোনের মধ্যে নুরে আলম দ্বিতীয়।

ঢাকাটাইমসের সাথে কথা হয় সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরে আলম তালুকদারের। জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ও প্রাপ্তির কথা। শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনে বাড়িতে থাকতে পারেননি আলম। দেশ, দেশের মাটি ও মানুষকে রক্ষা করতে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। কমান্ডার সাইদুর রহমান বীরপ্রতীকের হাত ধরে যোগ দেন কাদেরিয়া বাহিনীতে। প্রশিক্ষণ নিতে চলে যান ভারতের মেঘালয়ে। দেড় মাস প্রশিক্ষণ শেষে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মাত্র ১৬ বছরের ওই তরুণের অবদান অবিস্মরণীয়।

৭১-এ এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন নুরে-আলম। কিন্তু মুজিব ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেয়া হয়নি তার। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় কমান্ডার সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে জেলার কালিহাতী থেকে নৌকা নিয়ে দেড় শতাধিক মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ও প্রায় সাড়ে ৩শ শরণার্থী আশ্রয়ের জন্য ভারতের মেঘালয়ে যাওয়ার পথে বাংলাদেশের রংপুরে পৌঁছালে অপরদিক থেকে আসা আরেক দল মুক্তিবাহিনীর সাথে দেখা। তিনি তখন “ছোটদের-বড়দের, সকলের। গরিবের-নিঃস্বের-ফকিরে। আমার এদেশ সকলের” দেশাত্ববোধক এই গানটি গাইছিলেন। মুক্তিবাহিনীর ওই দল চিনতে না পেরে তাদের উপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। এমন সময় ওই দলের কমান্ডার বাংলা গানের শব্দ পেয়ে তাদের নৌকাগুলো থামিয়ে ডেকে নেন।

ওই কমান্ডার বলছিলেন, নৌকায় গান গাইল কে? তখন আলম এগিয়ে গেলেন। ওই কমান্ডার বললেন, তোর কারণে আজ সবাই বেঁচে গেল। মেঘালয়ে প্রশিক্ষণ শেষে চলে আসে দেশের মাটিতে। তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় সদস্য হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকবাহিনীর ওপর। যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছেন এটাই ওদের আত্মতৃপ্তি।

যুদ্ধের প্রত্যক্ষ একটি ছবি তাকে আরো স্মরণীয় করে রেখেছে। কাগমারী এলাকায় প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সময় তার একটি ছবি ক্যামেরাবন্দি হয়। ছবিটি একসময় ভাইরাল হয়ে পড়ে। ছবির মানুষকে খোঁজে অনেকে। কিন্তু তারপর ছবি অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে।

স্বাধীন দেশে এখনো বেঁচে আছে নুরে আলম। দেশ পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন হয়নি শুধু নুর-আলমের ভাগ্যের চাকা। বিয়ের পর স্ত্রী চলে যাওয়ায় ক্ষোভে আর দ্বিতীয় বিয়েও করেননি তিনি। সন্তানও নেই। বড় ভাই মারা যাওয়ার পর ওই পরিবারের সাথে মিশে আছেন তিনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা এখন কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। সরকারি ভাতাটা পাচ্ছেন। কিন্তু তার ছবিটিকে এখনো কোন মর্যাদা দেয়া হয়নি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর আলম ঢাকাটাইসকে জানান, ওই ছবিটি ক্যামেরাবন্দি করা অজ্ঞাত সেই ফটোগ্রাফার ওই সময় বলছিলেন, যুদ্ধ করে তো আর কিছু পাবে না, ছবিটিই থাকবে। আজ তাই হলো ছবি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। ছবির জন্য বাড়তি কোন মূল্যায়ন পাচ্ছি না। তবে ছবিটি দেখে কিভাবে যুদ্ধ করেছি সেই স্মৃতিগুলোই মনে পড়ে যায়। ছবির সূত্র ধরেই আজ তার বাড়িতে সাংবাদিক আসে। যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য। দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য। নয় মাস যুদ্ধের পর আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি এটাই আমাদের আত্মতৃপ্তি।

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যাতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখার দাবি জানান তিনি। সরকারের কাছে তিনি আরো দাবি করেন, ভাইরাল হওয়া তার ওই ছবিটি জাদুঘরে রাখার হয় এমনকি উপজেলা পর্যায়ে তার ওই ছবি দিয়ে একটি মোড়াল তৈরিরও দাবি করেন। সরকারি ভাতা দিয়ে সরকার তাদের সম্মানীত করেছেন বলে সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি তিনি আক্ষেপ করেন, যে ছবি কথা বলে। যে ছবি পত্যক্ষ যুদ্ধের প্রমাণ দেয়। এবার যাচাই-বাছাইয়ের সময় সেই ছবির মানুষটিকে ওয়েটিং লিস্টে রাখা হয়েছিল। কেন তিনি ওয়েটিং লিস্টে ছিলেন জানতে চাইলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

বাসাইল উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে জানান, নুর আলম একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। ওই ছবিটিও নুর আলমের দাবি করে বলেন, ছবিটি আমাদের বাসাইলের গর্ব। এই ছবিকে সংরক্ষণ ও ছবির ওপর ভিত্তি করে একটি ভাস্কর্য তৈরির জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান তিনি।

কমান্ডার নুরুল ইসলামের সাথে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে বলেন, নুর আলম একজন অর্জিনাল মুক্তিযোদ্ধা। ছবিটির তার নিশ্চিত করেন।

বাসাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামছুন নাহার স্বপ্না ঢাকাটাইমসকে জানান, এ সম্পর্কে আমি অবগত নই। বিষয়টি জানার চেষ্টা করব। যদ্যি সত্যিই নুর আলমের ছবি হয় তাহলে এই ছবিটি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করব।

এর এগে গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মুশুরিয়া গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ ছবির তিন বীর আব্দুল খালেক, আব্দুল মজিদ ও মজিবর রহমানকে নিয়ে “সেই ছবির তিন কিশোর যোদ্ধার সন্ধান” শিরোনামে ঢাকাটাইমসে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর বিষয়টি ভাইরাল হয়। পরদিন থেকে বিভিন্ন প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়াতে প্রতিবেদনটি প্রকাশ পায়। সরকারি ও বেসরকারিভাবে ছবিটি সংরক্ষণে ভাস্কার্যসহ নানা পদক্ষেপের আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত কোন বাস্তবায়ন লক্ষ করা যায়নি।

(ঢাকাটাইমস/১৬ডিসেম্বর/আরকে/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :