কারচুপির কারিগর

প্রকাশ | ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:১৩

কাজী রফিকুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস

ভয় পাবেন না, এ কারচুপি সেই কারচুপি নয়। এ কারচুপি সুন্দর, শৈল্পিক। ওড়না, জামা কিংবা শাড়িতে কারচুপির কাজ থাকলে দাম বেড়ে যায় বহু গুণ। হাতের সুনিপুণ নকশায় কারচুপির কারিগরেরা একটি সাধারণ পোশাককেও করে তুলতে পারেন চোখধাঁধানো সুন্দর। রাজধানীর মিরপুরে এবং মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের ভেতর চোখে পড়ে কারচুপির বেশ কিছু কারখানা। এখানে বসেই সারা দিন কাজ করেন কারিগরেরা।

ক্যাম্পের প্রধান মিম্বার গলিতে নূর মোহাম্মাদের কারখানা। কারখানায় ঢুকতেই চোখে পড়ে দুজন কারিগরের নৈপুণ্য। কারচুপির কাজ চলছে বেনারসির ওপর। কোনো যান্ত্রিকতা নেই, পুরোটাই হাতের কারুকাজ।

ব্যবসার বর্তমান হাল জানতে চাইলে ঢাকাটাইমসকে নূর মোহাম্মদ বলেন, 'ব্যবসা আগের মতো নাই। পাঁচ বছর আগের সাথে তুলনা করলে এখন কোনো ব্যবসা নাই। এই লাইনের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার দুজন নিয়মিত কাস্টমার আছে। দুজনই পাইকার। তাগোরে কিছু কিছু মাল দিয়া টিকা আছি। নইলে আমার কারখানাও বন্ধ করতে হবে। আমাদের এখানে তো বেচাকেনা তেমন হয় না। মিরপুরে হয়। ওরা ওখানে বানায়, আবার ওখানেই বেচে। আমাদের এখানে কিছু খুচরা বিক্রির দোকান হইছিল। কিন্তু চলে নাই। এই ধরনের কাপড় কিনতে সবাই মিরপুরে যায়।'

ব্যবসার অচল অবস্থার কারণ জানতে চাইলে ভারত থেকে বাংলাদেশে অবাধে শাড়ি-থ্রিপিছ সরবরাহের অভিযোগ করেন নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘আগে তো ভারত থেকে শুধু কারচুপির পাথর আসত। আমরা সেগুলা দিয়ে শাড়িতে, লেহাঙ্গায়, থ্রি-পিছে কাজ করতাম। এই সরকার আসার পর থেকে পাথর না পুরা ড্রেসই চলে আসে ভারত থেকে। শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রি-পিছ সরাসরি আসতেছে। পাবলিকও ইন্ডিয়ান খোঁজে। আর আমাদের হাতের কাজের জিনিসে প্রতি পিছে ৫০০ টাকা হাতে রাখতে খবর হইয়া যায়। মাসে বিশ হাজার টাকাও থাকে না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, খদ্দেরের অভাবে মাত্র ১২০০ টাকাতেও এখানে মেলে কারচুপির কাজ করা বেনারসি। অবাক করার মতো হলেও এটাই সত্য। ১২০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকা দামের বেনারসি পাওয়া যায় এখানে। লেহেঙ্গাও পাওয়া যাবে প্রায় একই দামে। আবার এসব বেনারসি খুচরা বিক্রি হচ্ছে পাইকারি দামের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি মূল্যে। তবু লাভ পাচ্ছেন না কারখানা মালিক। পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্যের শাড়ি ও লেহেঙ্গা প্রতি লাভ হয় দুই-তিন শ টাকা। দাম পাঁচ হাজার টাকার উপরে হলে লাভ থাকে ৫০০-৭০০ টাকা।

শুধু কারখানা নয়, আয়স্বল্পতায় পেশা ছাড়ছেন অনেকেই। যারা টিকে আছে, তাদেরও দিন কাটে বহু কষ্টে। দৈনিক বারো ঘণ্টা কাজ করেও মাসিক আয় আট থেকে নয় হাজার টাকা। বেনারসি কারিগর মো. চাঁন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘দিন দুই-তিন শ টাকার কাম করি। এই দিয়া চলে? খাটনি তো দেখেন। আমরাও কিছু কইতে পারি না। ব্যবসা ভালো হইলে না মালিক টাকা বাড়াইব। তাই গত পাঁচ-ছয় বছরে বেতন বাড়ে নাই।’

অপর এক কারখানার কারচুপির কারিগর মো. সারোয়ার হোসেন। সারোয়ার মূলত লেহেঙ্গার কাজ করেন। তার আয়ের অঙ্কটাও ছোট। তার সঙ্গের অনেক কারিগর কাজ ছেড়ে দিলেও তিনি ছাড়েননি। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘ইনকাম কম। এত সময় কাম কইরা এই কয়টা টাকা দিয়া হয় না। এ জন্য অনেকে কাজ বাদ দিছে। কারচুপির কাম ছাইড়া কয়েকজন এখন 'বাবা' (ইয়াবা) বিক্রি করে। ইনকাম ভালো। খালি খাড়াইয়া থাকব। কাস্টমার এমনিই আহে। আর না আইলে নাই। দিন শেষে ৭০০ টাকা।  ক্যাম্পের ভিতরে পুলিশ এত আহে না। আইলেও সমস্যা নাই। ধইরা নেয় না। টাকা নিয়া যায় গা।’

আরও কয়েকজন কারিগর একই রকম তথ্য দিলেন। গত দুই বছরে যারা এ পেশা ছেড়েছেন, তাদের অধিকাংশই এখন জেনেভা ক্যাম্পের ইয়াবা বিক্রেতা। কিছু অংশ ঝুঁকেছে অন্য পেশায়। জানালেন নিজ পেশায় পর্যন্ত উপার্জন না থাকায় কারিগরদের অনেকেই ঝুঁকছেন মাদক বিক্রির মতো ভয়ানক পেশায়। ফলে, হারিয়ে যেতে বসেছে জেনেভা ক্যাম্পের কারচুপি শিল্প।

(ঢাকাটাইমস/১৭ডিসেম্বর/কারই/কেএস/মোআ)