মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বিভ্রান্তি..

অনুপম মাহমুদ
 | প্রকাশিত : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:১৪

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহুল আলোচিত একটি রাজনৈতিক শব্দ। কারণে অকারণে টেনে আনা হয়েছে যেখানে সেখানে। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৬ বছর পরেও কেন এই বিভ্রান্তি?

কৃতিত্ব নিয়ে যুদ্ধ: মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ, পাকিস্তানের তল্পিবাহক ছাড়া সাথে ছিল সব রাজনৈতিক দল। জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল মুক্তিপাগল বাঙালি। ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ তিনি দিয়েছেন, এর পর আর কিছু না বললেও হতো। তার পরেও সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন তিনি। ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হলে মধ্যরাতেই ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। গোটা মুক্তিযুদ্ধ এমনকি মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্রও তাই বলবে।

স্বাধীনতার ঘোষণা: ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শুরু হয় তথ্য বিকৃতি করে কাস্টোমাইজ ইতিহাস রচনা। একপক্ষ দাবি উত্থাপন করে যে, স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। ইতিহাস বলে তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন ২৭ মার্চ, যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ! বিভ্রান্তির শুরু হয়ত এখানেই, যদিও জীবদ্দশায় জিয়াউর রহমান নিজে এই দাবি কখনোই করেননি।

মুক্তিযোদ্ধা তালিকা: স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও আবেদন আসছে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য। এটা আমাদের জন্য ভীষণ লজ্জার কথা যে আমরা এখনও একটি নির্ভুল তালিকা করতে পারিনি। এরশাদ সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছিল তা এখনো চলমান আছে।। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের তালিকা ও সংজ্ঞা নিয়ে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

রাজনৈতিক হাতিয়ার: জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতারবিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছিল সহযোগী বাহিনী হিসেবে। রাজাকার, আল বদর ইত্যাদি নামে তারা পাকিস্থানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে, নির্মম অত্যাচার এমনকি স্বাধীনতার প্রাক্কালে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞেও যুক্ত আছে এই দলটির নাম। স্বাধীনতার পরপর তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং দালাল আইনে বিচার চলছিল। ৭৫ এর পট পরিবর্তনে থমকে যায় বিচার, মুক্তি পেয়ে ও রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পেয়ে সমাজে পুনর্বাসিত হতে থাকে ওরা ক্রমান্বয়ে।

যুদ্ধাপরাধের বিচার: ২০০৮ সালে স্বাধীনতাবিরোধী তথা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করা হবে, এই নির্বাচনী ইশতেহার দিয়ে গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। একে একে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় এবং তা কার্যকর করা হয়। ইতিমধ্যে জামায়েতে ইসলামের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা অভিযুক্ত হয়েছেন, যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে নাম এসেছে জামায়াতে ইসলামের। কিন্তু তাদের এখনো নিষিদ্ধ করা হয়নি। বলা হচ্ছে এই ইস্যু নিয়ে আদালতে মামলা থাকায় সরকার নির্বাহী আদেশের আশ্রয় নিচ্ছে না।

স্পষ্ট রাজনৈতিক বিভাজন: যুদ্ধাপরাধের বিচারে একটি বিষয় দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে আইনজীবীদের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন একটি রাজনৈতিক জোটের চিহ্নিত এবং সমর্থক আইনজীবীরা। সেই সাথে দল ও গোষ্ঠী সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। চলছে কথার লড়াই।

জয় বাংলা বনাম জিন্দাবাদ: মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ অনেকদিন এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল বাংলাদেশে। অন্যদিকে এই শ্লোগানকে আওয়ামী লীগ অনেকটা নিজেদের করে নিয়েছে। তবে সচরাচর অন্য দলগুলো জিন্দাবাদ ব্যবহার করে থাকে। ইতিমধ্যে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছে ‘জয় বাংলা’কে কেন জাতীয় ধ্বনি হিসেবে ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে।

কোটা বিতর্ক: মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি নাতনিদের জন্য চাকুরি ক্ষেত্রে কোটা বরাদ্দ করা হয়েছে, তা নিয়ে মাঝে বেশ শোরগোল হয়েছিল। সুদীর্ঘ কাল থেকেই নারী, উপজাতি, জেলা, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি কোটা থাকলেও বিতর্কে আসে মুক্তিযোদ্ধা কোটা। এর কারণ হতে পারে অনেক কিছুই। তবে সবচেয়ে সজহ ও সরল ব্যাখ্যা হচ্ছে এই কোটাকে বিতর্কিত করার এটা একটা নোংরা প্রয়াস মাত্র। অথচ এই দেশে গোলাম আযমের মতো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর ছেলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিয়োজিত সেনা বাহিনীর প্রধান হয়েই যাচ্ছিল প্রায়।

অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধা: এই দেশে এখনো মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত। টাঙ্গাইলে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগের এক সংসদ সদস্য বর্তমানে কারাগারে। এছাড়াও দেশের নানা জায়গায় এখনো অপঘাতে মৃত্যু বা আহত হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। চট্টগ্রামে একজন মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করেন বলে আজ একটি অনলাইন পোর্টালে দেখলাম।

সুযোগ সুবিধা: স্বচ্ছতা জরুরি। কারা সুবিধা পাচ্ছেন তা প্রকাশ করা জরুরি। একই পরিবার থেকে একাধিক সুযোগ সুবিধা বন্ধ করা উচিত। সুযোগের সুষম বন্টন জরুরি। সুযোগ সুবিধার জন্য অনেকেই দেন দরবার এমনকি জালিয়াতি করেও সনদ বাগিয়ে নিচ্ছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে এর প্রতিবাদ জানাই। এতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অপমান বোধ করছেন বলে আমার বিশ্বাস।

কিছু প্রশ্ন উঠছে, যেমন কত মানুষ শহীদ হয়েছিল, সত্যিই এত মানুষ মারা গিয়েছিলো কি না? এটা আমাদের জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যের বিষয়, এসব নিয়েও বিতর্ক করা যায়। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা জাতি আমরা, আমরা কত কিছুই না পারি, কেউ কেউ বলেন এইসব বিভেদ ভুলে গিয়ে একসাথে পথ চলতে হবে, দেশের স্বার্থে।

দুঃখিত, পারব না। আমার মা বোনদের যারা অপবিত্র করেছিল তাদের সাথে হাঁটতে পারব না।

আমার বাবাকে যারা হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল তার সাথে আপস করতে পারব না।

যারা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল তাদের সাথে এক মঞ্চে বসতে পারব না।

. নোংরা অপরাজনীতি বাদ দিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন আইনের আওতায় এনে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হউক। ২. এই পর্যন্ত যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন, তাদের পরিপূর্ণ পরিচয় উল্লেখ করে পরিপত্র জারি করা হউক, যেন সবাই জানতে পারে। ৩. এক পরিবারের একাধিক সুবিধা গ্রহণ করা ন্যায়সঙ্গত নয়। সুযোগের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। ৪. বধ্যভূমি, যুদ্ধক্ষেত্র, শহীদ ও মৃত মুক্তিযোদ্ধার সমাধী সম্মানের সাথে চিহ্নিত করে একটি সংক্ষিপ্ত এপিটাফ স্থাপন করা, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এদের সম্পর্কে জানতে পারে। ৫. প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বসতবাড়ি বিশেষ চিহ্নের দ্বারা সংরক্ষণ করা হোক। ৬. অসহায় ও ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে অনতিবিলম্বে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৭. দলীয় ও ক্ষমতাসীনদের বলয় থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সংসদকে মুক্ত থাকতে হবে। ৮. স্বাধীনতাবিরোধীদের নামের তালিকা প্রকাশ করে তাদের সন্তানদের সরকারি চাকরি ও দেশের আইন প্রয়োগকারী ও সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে। ৯. শিক্ষার সকল পর্যায়ে ও মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক বাধ্যতামূলক করতে হবে। ১০. চিকিৎসা ও গণপরিবহনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামুল্যে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা নিশ্চিত করতে হবে। ১১. মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রীক যে কোন প্রকারের অবমাননাকর মন্তব্য বা কুৎসার জন্য কঠোর ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

তা না হলে বিভ্রান্তি হয়তো থেকেই যাবে আর চেতনার নামে রাজনৈতিক ব্যবসা চলবেই। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে কিছু দাবি রাষ্ট্রের কাছে করতেই পারি।

লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :