আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করে উপস্থাপন করছে ভারত

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ২২:২৪

পরাজিত শক্তি পাকিস্তান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করবে, এটাই স্বাভাবিক। এদের কাছ থেকে ভালো কিছুর আশা আমরা করিনা। কিন্তু ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ ভারতের গণমাধ্যম, এমনকি সেদেশের সেনাবাহিনীর পেইজে যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিকৃত ব্যাখা দেয়া হয় তখন বড্ড অস্বাভাবিক লাগে। অথচ এই অস্বাভাবিক কাজটি দিনের পর দিন করে আসছে ভারত। কেন ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে, তাদের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে চালিয়ে দেয়? আমাদের ইতিহাসবিদ, সরকার কিংবা সুশীল সমাজই বা কী ভূমিকা রাখছে এ বিষয়ে?

বাংলাদেশের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক দ্যা ডেইলি স্টার এর বাংলা ভার্সনের অনলাইনে এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল অভয় কৃষ্ণ বলেছেন, ‘১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেটা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায়। মুক্তিযোদ্ধারাও এই যুদ্ধের অংশীদার এবং সেই কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে’। বাংলাদেশের বিজয় দিবস উদযাপনের ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবে শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছিলেন। ওই কর্মকর্তার লেখা ‘১২ দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ শীর্ষক একটি বইয়েরও মোড়ক উন্মোচন হয় সেদিন সকালে। ভারতীয় প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তার এই বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়’।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘শনিবার কলকাতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চল শাখার বিজয় দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা এই বিতর্কের বিষয়ে দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় সেনা সদর দফতরের প্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল অভয় কৃষ্ণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তখন তিনি বলেন, “অবশ্যই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা ছিল। তারাও এর অংশীদার ছিলেন। আর সেই কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে’।

দেশের অন্যতম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ইতিহাস বিকৃতি আর কাকে বলে! আবারও এ কাজটি করলো বলিউড। কথার ধরনটা এমন- ১৯৭১ সালে নাকি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। আর এই যুদ্ধে ভারতের বিজয়ের ফল হিসেবে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ! বলিউডের ‘আইয়ারি’ তৈরি হচ্ছে এই প্রেক্ষাপট নিয়ে’। প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে-‘গত ১৬ ডিসেম্বর ভারতের শীর্ষস্থানীয় তিন সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস ও বলিউড হাঙ্গামা ‘আইয়ারি’র পোস্টার নিয়ে পৃথক তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সব খবরেই বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে! ওই যুদ্ধে ভারতের সাহসী সৈন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেই ছবিটি বানানো হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইয়ারি’র পরিচালক নিরাজ পাণ্ডেও সংবাদমাধ্যমে একই দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিজয় দিবস আমাদের দেশের সামরিক বাহিনীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৭১ সালে ভারতের বিজয়ের জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের জন্য আমাদের এই শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাই এইদিনেই পোস্টারটি ছাড়লাম। আমরা এটি উৎসর্গ করছি ভারতের সামরিক বাহিনী ও তাদের সাহসী পরিবারদের উদ্দেশ্যে।’ বাংলা ট্রিবিউনের এ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সিনেমার পোস্টারের পুরোটা জুড়েই আছে ভারতীয় পতাকা। এর আগে ‘গুন্ডে’, ‘দ্য ঘাজি অ্যাটাক’ (তেলেগু, বলিউড), ‘১৯৭১ বিয়ন্ড বর্ডারস’ (মালায়লাম) শীর্ষক চলচ্চিত্রেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ হিসাবে চালিয়ে দেয়া হয়েছে।

প্রশ্ন হল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিলে, আমাদের ক্ষতি কী? ক্ষতি বিশাল এবং সুদূরপ্রসারী। ক্ষতি ইতিহাসের, তার চেয়েও বড় ক্ষতি আমাদের অনাগত প্রজন্মের। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের। যুদ্ধ হয়েছিল পূর্ব-পাকিস্তান নাম মুছে ফেলে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ১৯৪৭ সাল থেকে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের চেষ্টা করে আসছিলেন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার সময় ভারত আর পাকিস্তানের যথাক্রমে জহরলাল নেহেরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর তাদের অনুসারীদের স্বার্থপরতার জন্য বাঙালি জনগোষ্ঠী নিজেদের পৃথক রাষ্ট্র পায়নি। সে সময়কার অধরা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন, অত্যাচার সহ্য করেছেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৪ বছর জেল খেটেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানীরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালি হত্যা করেছে। শেষপর্যন্ত ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ঢাকায় বাঙালি নিধন শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে এই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। দুই লাখ মা-বোনের উপর চালিয়েছে পাশবিক নির্যাতন।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে তাদের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ হয়। তবে শুরু থেকেই ভারত সরকার ও জনগণ আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সীমান্ত খোলা রেখেছে। হিন্দু-মুসলমান মিলে আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের সহস্রাধিক সেনা সদস্য আমাদের মাটিতে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। ভারতের সব অবদান আমরা সারাজীবন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে যাব। তাই বলে, আমাদের ৩০ লাখ শহীদ, দুই লাখ নির্যাতিত নারী, সাহসী জনসাধারণ, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, রাজারবাগের পুলিশ সদস্যদের, আমাদের সামরিক অফিসার ও সদস্যদের বীরোচিত অবদানকে অস্বীকার করে ভারত নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ইতিহাস বর্ণনা করে যাবে, আমরা নতুন প্রজন্ম এটা মেনে নিব না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্য একটি দেশ কথা বলবে, কিন্তু শ্রদ্ধার সাথে আমাদের জাতির পিতার নাম উচ্চারণ করবে না, এটা হতে পারে না।

এর আগে ২০১৪ সালে ‘গুন্ডে’ শীর্ষক বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে অত্যন্ত অপমানজনকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। সে সময় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে সে বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি নিজেদের ব্লগে এক পোস্টে দুঃখও প্রকাশ করে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যশরাজ ফিল্মস। তাদের পোস্টে বলা হয়, “চলচ্চিত্রে যেভাবে গল্প তুলে ধরা হয়েছে তাতে অনেক বাংলাদেশি ভাই আপত্তি জানিয়েছেন। তবে এর কাহিনি ও গল্প পুরোপুরি কাল্পনিক। কোনো জাতি, সমাজের বিশেষ কোনো অংশ বা কোনো ব্যক্তির প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানোর অভিপ্রায় নেই। “তারপরেও এতে কেউ আহত হলে বা কারো প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে করলে আমরা তার জন্য ক্ষমা চাইছি।” যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে গুন্ডে সিনেমা নিয়ে বলা হয়, গুন্ডেতে বাংলাদেশের জন্মকে দেখানো হয়েছে ভারত-পাকিস্তানের ১৩ দিনের যুদ্ধের ফল হিসেবে, যা শুরু হয় ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর।

আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি এবার কিছু করবে না? ভারতের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, ভারতের সিনেমা ইচ্ছে করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের যুদ্ধ বলে চালিয়ে দেবে, আমাদের স্বাধীনতাকে বাইপ্রোডাক্ট বলে প্রচার করবে, এটা মেনে নেয়া যায় না। আমাদের ইতিহাসকে ভারতের সম্মান করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ হুট করে হয়নি। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একটা জনগোষ্ঠীকে জাতিতে পরিণত করতে নিজের জীবন বাজি রেখে সাংগঠনিকভাবে কাজ করে গেছেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়াতে ভারতের প্রাপ্তিও কম নয়। আমরা স্বাধীন হয়েছি, ভারত পেয়েছে তাঁর একমাত্র নিরাপদ প্রতিবেশী। ভারতের একপাশে পাকিস্তান, আরেক পাশে চীন। নেপাল, শ্রীলঙ্কা কারো সাথেই ভারতের সম্পর্ক ভালো নয়। তদুপরি জন্ম থেক আজ অবধি বাংলাদেশ ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখে চলেছে। সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা নিধনে বাংলাদেশ ভারতের হয়ে অনেক কাজ করে দিয়েছে। ভারতীয় নানা পণ্যের অবাধ বাজার বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রার উৎস। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতের রেমিট্যান্স আয় ছিল ৩.৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার। লাখ লাখ ভারতীয় বৈধ/অবৈধভাবে বাংলাদেশ চাকরি/ব্যবসা করে।

এসব কিছু মাথায় নিয়ে ভারতের উচিত হবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হয়, এমন যে কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকা। ভারতকে আমরা বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবেই চাই, প্রভু হিসেবে নয়। বন্ধুত্ব আর দাসত্ব এক বিষয় নয়। আমাদের নিজস্ব পতাকা, সীমান্ত আছে। আমরা পৃথিবীর অন্যতম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমাদেরকে সম্মান না করলে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা বাড়বে। এতে দুই দেশেরই ক্ষতি।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :