খেলাধুলা কি শুধুই বিনোদন দেয়?

সদর উদ্দীন লিমন
 | প্রকাশিত : ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৫৯

বর্তমান সময়ে বিনোদনের অন্যতম একটি মাধ্যম খেলাধুলা। আমাদের উপমহাদেশে ফুটবল ও ক্রিকেট বেশি জনপ্রিয় হলেও ইউরোপ, আমেরিকা সহ কিছু অঞ্চলে ব্যাডমিন্টন, রাগবি, টেনিস, টেবিল টেনিস, অ্যাথলেটিক্স খুবই জনপ্রিয়। বিংশ শতাব্দী বা তার পূর্ববর্তী সময়ে খেলাধুলা অতটা জনপ্রিয় না হলেও একবিংশ শতাব্দীতে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বিশেষ করে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় খেলাধুলা দেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।

অনেকেই খেলাধুলা দেখে ভবিষ্যতে নিজেকে স্পোর্টসম্যান হিসাবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বা নিজেকে স্পোর্টস হিরো হিসাবে দেখতে চায়। অনেকেই আছেন পেলে-ম্যারাডোনার খেলা দেখে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন এবং পরবর্তীতে হয়েছেন। আবার অনেকেই শচীন টেন্ডুলকারের খেলা দেখে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এবং পরবর্তীতে হয়েছে।

একবিংশ শতাব্দীতে খেলাধুলার প্রচার এবং প্রসারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বড় ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের কথা যদি বলি তাহলে আশির দশকে বা নব্বইয়ের দশকে এমনকি একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও বিটিভিই ছিল খেলাধুলা দেখার অন্যতম মাধ্যম। অনেকে গ্রাম থেকে শহরে চলে যেত পছন্দের দলের খেলা দেখতে। কিন্তু এখন মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন হয়ে যাওয়ায় এবং ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় যেকোনও জায়গা থেকেই খেলাধুলা উপভোগ করা যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, খেলাধুলা কি আমাদের শুধুই বিনোদন দেয়, না এর অন্যান্য আরও প্রভাব আছে। আসলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে, সামাজিক পরিবর্তনে খেলাধুলার অনেক ইতিবাচক প্রভাব আছে। তার কয়েকটি আমি নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

১.অর্থনৈতিক প্রভাব: অর্থনৈতিক উন্নয়নে খেলাধুলার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। যখন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনও টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয় তখন সেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটি কোটি ডলারের লেনদেন হয়। যেমন একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হলে সেদেশের ট্যুরিজম সেক্টর ব্যাপক পরিমাণে আয় করতে পারে। আয়োজক দেশের জিডিপিও বৃদ্ধি পায়। আগামী বছরের জুন-জুলাইয়ে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে ফিফা বিশ্বকাপের ২১তম আসর। এই বিশ্বকাপের বাজেট হচ্ছে ১১.৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি টাকা তা প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা। আশা করা হচ্ছে, এখান থেকে ফিফারও বিপুল পরিমাণ আয় হবে। ২০১৪ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ থেকে ৪.৮ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয় করেছিল ফিফা। ওই বিশ্বকাপে ব্যয় হয়েছিল ২.২ বিলিয়ন ডলার। টিভি রাইটস ফি থেকে ২.৪ বিলিয়ন ডলার, স্পন্সরশিপ থেকে ১.৬ বিলিয়ন ডলার ও টিকিট বিক্রি থেকে ৫২৭ মিলিয়ন ডলার পেয়েছিল ফিফা।

২.চাকরির সুযোগ: স্পোর্টসের সঙ্গে অনেক বিষয় সংশ্লিষ্ট। ক্রিকেট দিয়েই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। ক্রিকেট খেলার জন্য বিভিন্ন রকমের সরঞ্জামাদি প্রয়োজন হয়। স্টেডিয়াম বানাতে হয়, খেলোয়াড়দের জন্য জার্সি তৈরি করতে হয়, গ্রাউন্ডসম্যানের প্রয়োজন হয়, মিডিয়া কাভারেজের দরকার হয়, খাদ্য সরবরাহ করতে হয় ইত্যাদি। এজন্য হাজার হাজার লোকের চাকরির সুযোগ হয়। তাছাড়া যারা খেলেন তাদের জন্যও তো এটা একটা চাকরি। খেলোয়াড়দের জন্য মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলার খরচ করে কোচ রাখতে হয়।

৩.জাতীয় ঐক্য: একটি দেশের মানুষের মধ্যে যতই ভেদাভেদ থাকুক না কেন জাতীয় দল মাঠে খেলতে নামলে সবাই এক হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষের মিলনমেলা তৈরি হয়। পতাকা হাতে রাস্তায় মিছিলে বের হয় সববয়সী মানুষ। ফিফার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের দুই লাখ সমর্থক টিকিট কেটে মাঠে গিয়ে খেলা দেখেছিল। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও পর্তুগালের মধ্যকার ম্যাচটি দেখেছিল ২৪.৭ মিলিয়ন ভক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি সর্বাধিক মানুষের দেখা একটি ফুটবল ম্যাচ।

৪.রোল মডেল: আপনি যদি আপনার কোনও বন্ধু বা ছেলে-মেয়ে বা ছোট ভাই-বোনকে জিজ্ঞাসা করেন যে তোমার জীবনে রোল মডেল কে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই কোনও বিখ্যাত খেলোয়াড়ের নাম বলবে। বর্তমান প্রজন্মের কেউ উত্তরে বলবে মাশরাফি বিন মুর্তজা, কেউ বলবে সাকিব আল হাসান, কেউ বলবে লিওনেল মেসি। আবার কেউ বলবে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।

৫.বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক: দুইজন ব্যক্তি, দুইটি গোষ্ঠী বা দুইটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে খেলাধুলা। খেলার সময় দুই বা ততোধিক দেশের মানুষের মিলনমেলা হয়। বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

৬.যুব সমাজকে গড়ে তোলা: অলস মস্তিষ্ক মানুষকে খারাপ কাজ করতে প্রভাবিত করে। এজন্য দেখা যায় কিশোর বা যুবক বয়সে অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে নিজের জীবন ধ্বংস করার পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যুব সমাজকে যদি খেলাধুলার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাহলে তারা মাদক এবং অনিষ্ট কাজ হতে দূরে থাকে।

৭.ভাবমূর্তির উন্নয়ন: বিশ্বে অনেক দেশই আছে যাদের নাম আমরা জানি শুধু খেলাধুলার কারণে। অনেকেই আছেন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে চিনেন শুধু খেলাধুলার কারণে। পেলে-রোনালদো-নেইমারকে চিনেন। কিন্তু ব্রাজিলের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানেন না। সুতরাং, একটি দল যখন দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে, ভালো পারফরম্যান্স করে, জয় ছিনিয়ে আনে সেটি বিশ্ব দরবারের অবশ্যই দেশটির ভামূর্তির উন্নয়ন ঘটায়।

৮.লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ: খেলাধুলায় শুধু পুরুষরাই অংশ নেয় না। এখানে নারীরাও অংশ নেন। ক্রিকেট, ফুটবল, অ্যাথলেটিক্স সব খেলাতেই নারীরা অংশগ্রহণ করছে। কৃতি নারী খেলোয়াড়দের দেখে অনেক মেয়ে ভবিষ্যতে খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। সুতরাং, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে খেলাধুলাও ভূমিকা রাখছে।

৯.মানসিক বিকাশ: শিশুদের বেড়ে উঠা ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে খেলাধুলার ভূমিকা রয়েছে। ছোটবেলায় যদি ছেলেমেয়েদের বাসার মধ্যে আটকে রাখা হয় তাহলে তাদের মানসিক বিকাশ ঠিকভাবে হয় না। পরবর্তীতে দেখা যায় তারা সমাজের মানুষের সঙ্গে মিশে চলতে পারে না।

১০.সুস্থ দেহ: কথায় আছে ‘সুস্থ দেহ সুন্দর মন’। আপনি যদি সুস্থ থাকেন তাহলে আপনার কাজেও মন বসবে। আর সুস্থ থাকতে হলে আপনার খেলাধুলা/ব্যায়ামের কোনও বিকল্প নেই। আপনি যদি খুব বেশি খাবার খান কিন্তু ব্যায়াম না করেন তাহলে আপনার অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা আরও বাড়বে।

লেখক: সদর উদ্দীন লিমন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

খেলাধুলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

খেলাধুলা এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :