থেমে গেছে ডাক হরকরাদের হাকডাক

ফয়সাল আহমেদ, শ্রীপুর (গাজীপুর)
 | প্রকাশিত : ২২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:০৬

‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে, রাতে রানার চলেছে খবরের বুঝা হাতে...’- কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই ‘রানার’ কবিতার রানারের যেমন পদচারণা গাজীপুরের শ্রীপুরে নেই, তেমন এখন আর শোনা যায় না ডাক হরকরাদের হাকডাক। জনবল ও ভবন সংকটের কারণে উপজেলার ৩৬টি উপ-পোস্ট অফিসের কার্যক্রম স্থিমিত হয়ে পড়েছে।

প্রায় পনেরশ’ মাঝারি ছোট ও বড় শিল্প এলাকা সমৃদ্ধ শ্রীপুরের পোস্ট অফিসের কার্যক্রমের গতিশীলতা আনতে দীর্ঘ দিনেও সরকারি এ সেবা প্রতিষ্ঠানের দিকে কর্তৃপক্ষের নজর বৃদ্ধি না করায় উপজেলার ৩৬টি উপ-পোস্ট অফিসের ভবন কালের গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। কোথাও পোস্ট মাস্টারের বাড়িতে কোথাও বা বাজারের কারো দোকানে বসে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই দাপ্তরিক কাজকর্ম করেন পোস্ট মাস্টাররা।

শ্রীপুর উপজেলার বিভিন্ন পোস্ট অফিসে কর্মরত কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, উপজেলার শ্রীপুর পৌর পোস্ট অফিসের অধীনে ১২টি, কাওরাইদ বাজার পোস্ট অফিসের অধীনে ৪টি, বরমী বাজারের পোস্ট অফিসের অধীনে পার্শ্ববর্তী কাপাসিয়া, গফরগাঁও উপজেলার ১৪টিসহ মোট ১৭টি, রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট শাখার অধীন ৪টি পোস্ট অফিসের দাপ্তরিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসব অফিসে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ১৭ জন। এছাড়াও সাব-পোস্ট অফিসে কর্মরত রয়েছেন ৩৬ জন পোস্ট মাস্টার, যাদের প্রত্যেকের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র ব্যবস্থা সম্মানী ভাতা বাবদ সরকার থেকে প্রাপ্ত জনপ্রতি ২৪শ’ টাকা। উপজেলার মূল ৪টি পোস্ট অফিসের দাপ্তরিক কাজকর্মের জন্য ভবন থাকলেও ৩৬টি উপ-পোস্ট অফিসের কোন ভবন নেই। সামান্য আয়ে এখন জীবিকার ব্যবস্থা না হওয়ায় অনেকে এ পেশা ছাড়ার কথা যেমন ভাবছেন। অনেকে আবার নানা কারণে এক সময়ের সম্মানজনক এ পেশা ত্যাগ করতে পারছেন না।

রাজেন্দ্রপুর পোস্ট অফিসে কর্মরত পোস্ট মাস্টার লতিফুর রহমান জানান, তার অফিসের অধীনে চারটি উপ-পোস্ট অফিসের কার্যক্রম চলমান থাকলেও একটিরও দাপ্তরিক কাজকর্ম করার মত অফিস নেই। প্রত্যেক পোস্ট মাস্টার এখন তারা বাড়িতেই বসে কাজকর্ম করেন। এতে সরকারি এ সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আর একজনের পক্ষে সব চিঠিপত্র আদান-প্রদান, দাপ্তরিক কাজকর্ম করতে হয় বিধায় সঠিক সময়ে সেবা দেয়া যাচ্ছে না।

মাওনা বাজার পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার আব্দুল শাহিদ জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাওনা বাজারে মাটির ঘর তুলে চলছিল পোস্ট অফিসের কার্যক্রম। কিন্তু জরাজীর্ণ এই মাটির ঘরটি প্রায় একযুগ আগে ধসে পড়ে। এর পর থেকে বাজারের একটি দোকানে বসে পোস্ট অফিসের যাবতীয় কাজকর্ম করতে হয়। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় আড়াইশ’ এর মত চিঠিপত্র আদান-প্রদান করা হয় তার অফিস থেকে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় গ্রাহকদের টাকা পয়সা লেনদেনের সেবা দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ রয়েছে।

তেলিহাটি পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার বেলাল উদ্দিন কাজী জানান, তার অফিস ঘরটি দীর্ঘদিন আগে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার অবহিত করা হয়েছে। এই পোস্ট অফিসের জায়গা থাকার পরও পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে ভবন নির্মাণ করা যাচ্ছে না। এদিকে দাপ্তরিক কাজের জন্য কোনস্থানে বসার ব্যবস্থা না থাকায় তার বাড়িতেই চলে চিঠিপত্র আদান-প্রদান। তবে এখন আর আগের অবস্থা নেই, নানা কারণে সম্ভাবনাময় সরকারি এ সেবার মান নিয়ে সাধারণ মানুষ অনাগ্রহী হচ্ছেন।

শ্রীপুর প্রধান ডাকঘরের পোস্ট মাস্টার আফরোজা খানম জানান, শ্রীপুর প্রধান ডাকঘরের কাজে কোন ধরনের কমতি নেই। পূর্বের মতই রমরমা অবস্থা এখনও বিরাজমান। তবে চিঠিপত্র সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের ঘাটতির কথা স্বীকার করেন তিনি।

কাওরাইদ বাজারের পোস্ট মাস্টার আক্তার হোসেন জানান, তার অফিসের মাধ্যমে তিনটি উপ-পোস্ট অফিসের কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও একটিরও দাপ্তরিক কাজের অফিস নেই। স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষকের সহায়তায় তার বাড়িতে কোনমতে কাজ চলছে।

গাজীপুর বাজারের পোস্ট মাস্টার আবু বকর জানান, পোস্ট অফিসের সামান্য আয়ে এখন আর সংসার চলে না। তারপরও একসময়ের সম্মানজনক এ পেশাকে অনেকটা সম্মান দিয়েই ধরে রেখেছি। পরিবারের চাপ থাকা সত্ত্বেও তা ছাড়তে পারিনি।

কেওয়া পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার রানী জানান, ভাঙ্গা মাটির দেয়ালে পোস্ট অফিস থাকলেও ধসে পড়ার আতঙ্কে মাটির ঘরে এখন অফিস করা যায় না, এখন বাড়িতেই দাপ্তরিক কাজকর্ম করি।

শ্রীপুর উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি খলিলুর রহমান জানান, এক সময়ের যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম সরকারি ডাক সেবা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে দিন দিন সেবার মান কমে যাওয়ায় সাধারণ লোকজন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এছাড়াও বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে সরকারি সেবামূলক কাজ হওয়া অনেকটা দৃষ্টিকটু। সম্ভাবনাময় সরকারি এ সেবা বৃদ্ধিতে নজর না দিলে খুব দ্রুত তা গবেষণার বিষয়ে পরিণত হবে।

গাজীপুর পোস্ট অফিস পরিদর্শক রাজন ভূষণ দাস উপ-পোস্ট অফিসের ভবন সংকটের কথা স্বীকার করে জানান, ভবন নির্মাণের জন্য সরকারি যে বরাদ্দ তা দিয়ে জমি ক্রয় করে ভবন তৈরি করা যাচ্ছে না। তবে স্থানীয়রা যদি জমি দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেন, তাহলে সরকারিভাবে ভবন নির্মাণ করার মাধ্যমে সবাই এ সেবার সুফল পাবে।

(ঢাকাটাইমস/২২ডিসেম্বর/প্রতিনিধি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :