সুষ্ঠু নির্বাচনের হ্যাট্রিক এরপরেও অনাস্থা?

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:০২ | প্রকাশিত : ২২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:৫৯

দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন যে সুষ্ঠু হতে পারে, তার নতুন নজির রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। রসিক নির্বাচন নিয়েও বেরসিকের মতো অনেকে দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে নানা নেতিবাচক মন্তব্য, বিশ্লেষণ দিচ্ছেন। কিন্তু রংপুরে যে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে এ কথা কি অস্বীকার করা যাবে?

২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে হাই ভোল্টেজ সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছিল ঢাকার প্রতিবেশী নারায়ণগঞ্জে। নন্দিত-নিন্দিত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের সাথে সেলিনা হায়াত আইভীর মান-অভিমান-দ্বন্দ্ব, গণভবনে ডেকে নিয়ে শেখ হাসিনার চূড়ান্ত সবক দেয়াসহ অন্যান্য সব রাজনৈতিক বিষয়কে ছাপিয়ে সারাদেশে আলোচিত হয়েছিল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ আয়োজন ও সুষ্ঠু ভোট।

স্মরণকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন ছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। শামীম ওসমান কি আইভীকে সহায়তা করবেন? আওয়ামী লীগ কি পেশীশক্তি প্রদর্শন করবে? পুলিশ-আনসার কি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারবে? এমন অনেক প্রশ্ন ছিল নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। জনমনের সব সন্দেহ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সে নাসিক নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন সেলিনা আইভী। প্রকৃতপক্ষে বিজয়ী হয়েছিল বাংলাদেশ, দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতি।

নাসিক নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায়নি আওয়ামী বিরোধী শক্তিগুলো। সেনাবাহিনী ছাড়াই আয়োজিত একটি শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনে সেলিনা হায়াত আইভী এক লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট পেয়ে পুনঃনির্বাচিত হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান পেয়েছিলেন ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট। নাসিক নির্বাচনে মোট ভোটারের ৬২.৩৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল।

চলতি বছরের মার্চে আরেকটি বহুল আলোচিত সিটি নির্বাচন হয়েছিল কুমিল্লায়। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে ১১ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মনিরুল হক সাক্কু পেয়েছিলেন ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা পেয়েছিলেন ৫৭ হাজার ৭৬৩ ভোট।

নির্বাচন কমিশন এবং নিজের পূর্বের কর্মকাণ্ডের ওপর প্রার্থী সাক্কুর এতই ভরসা ছিল যে, তিনি তখন গণমাধ্যমে বলেছিলেন, নির্বাচনী প্রচারে ঢাকার নেতাদের কুমিল্লায় আসার দরকার নেই।ঢাকাটাইমসকে বিএনপির এই প্রার্থী তখন বলেছিলেন, ‘গত পাঁচবছর কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে যে কাজ করেছি তাতে আগামী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আমি আশাবাদী। তাই মনে করি ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের কষ্ট করে কুমিল্লা আসার দরকার হবে না। তবে কেউ আসলে ওয়েলকাম।’

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রথম পরীক্ষা। ফলে কুমিল্লা নির্বাচনে ব্যর্থ হলে কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা হুমকির মধ্যে পড়ত। ভোটের অনুকূল পরিবেশ পেয়ে কুমিল্লা নির্বাচনে নাগরিক ভোটাররা স্বাধীনভাবে, নির্ভয়ে ভোট দিয়ে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। দেশের গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দলসমূহ, নির্বাচন পর্যবেক্ষক তথা সংশ্লিষ্ট সবাই চোখ বড় করে তাকিয়ে ছিলেন কুসিক নির্বাচনের দিকে। কুমিল্লার মানুষ দারুণ নির্বাচন উপহার দিয়েছিল দেশবাসীকে।

সুষ্ঠু নির্বাচনে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়ে সাক্কু এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে, মেয়র হিসেবে শপথ নিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পা ছুঁয়ে সালাম করে নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সে শপথ অনুষ্ঠানে শুধু সাক্কু নন, তাঁর স্ত্রী জেসমিন আফরোজা জেসমিনও শেখ হাসিনাকে পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলেন।

জাতি আরেকটি শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেখল রংপুরে। ‘আঞ্চলিক’ দলের ভাবমূর্তি থেকে এখনো বের হতে না পারা সামরিক শাসক স্বৈরাচারী এরশাদের দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা। তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুকে এক লাখ ভোটের ব্যাবধানে হারিয়ে রসিক মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। নাসিক, কুসিক ও রসিক নিয়ে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের হ্যাট্রিক করল কমিশন। দিনশেষে স্রেফ রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে বিএনপির প্রার্থী নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন! স্থানীয়-জাতীয় পর্যায়ের সংবাদমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের সামনে এই নির্বাচন হয়েছে। বাঘা বাঘা রিপোর্টাররা নির্বাচনী ত্রুটি খুঁজে বের করার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু বড় কোনো গলদ চিহ্নিত করতে পেরেছেন বলে শোনা যায়নি।

পরপর তিনটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়েও হয়ত নির্বাচন কমিশনকে নানা কথা শুনতে হবে। সামনের বছর হয়ত নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে রাজনীতির মাঠ, রাজপথ আবার গরম হয়ে উঠবে। অথচ নির্বাচন কমিশন কিন্তু প্রমাণ করল তাদের সক্ষমতার দিকটি। তবু কেন ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে এখন থেকেই প্রশ্ন উঠবে? তবে কি ১৯৭১ এর পরাজিত শক্তি, তাদের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অভিভাবকরা বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা দাঁড়াক, এটা চায় না? যাই হোক, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিল, আছে এবং থাকবে। কারণ বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গালে বড় একটা থাপ্পড় মেরে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রধান অভিভাবক হিসেবে কাজ করেছে এবং এখনও করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুব পিয়ারের দল জামায়াত। জনগণকে এই কালো রাজনীতি সম্পর্কে বুঝতে হবে। কারণ শেষ পর্যন্ত জনগণের দায়িত্ব অনেক বেশি।

স্বৈরাচারী এরশাদের দলের প্রার্থীর কাছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয় খুবই দুঃখজনক হলেও এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে এই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য উন্নয়নবিরোধী বলেও প্রমাণিত হতে পারে। যেমন ভারতের বিজেপি ‘গণতান্ত্রিকভাবে’ ক্ষমতায় এসে মুসলমানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সাথে চরম অগণতান্ত্রিক আচরণ করছে। সম্প্রতি কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব নেয়া রাহুল গান্ধী যথার্থই বলেছেন, ভারত মধ্যযুগে ফিরে যাচ্ছে। অথচ ভারতের জনগণের ভোটের কারণেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য কুখ্যাত বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত।

তাই জনগণের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। ভোটের অধিকার পেয়ে কাকে নির্বাচিত করছেন, সেদিকেও আপনার খেয়াল রাখতে হবে। পরিবর্তনের সুযোগ পেয়েই পরিবর্তন করে ফেলা কখনো কখনো নির্বুদ্ধিতার পরিচয় হতে পারে। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ টাইপ মূলমন্ত্রের ইতি টানতে হবে। বরং বলতে হবে, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব না, ভালো-মন্দ বিচার করে দেব’। বাংলাদেশের যেকোনো সরকারের চেয়ে অনেক বেশি উন্নয়ন কাজ করে নির্বাচনে পরাজয় বরণ করা আওয়ামী লীগের জন্য সত্যি দুঃখজনক। তবে সামনের জাতীয় ও অন্যান্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে এই দুঃখ পেতে হবে না, যদি জনগণ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আমলে নিয়ে নিজের ভোটাধিকারকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করে।

এর আগেও আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬-২০০০ মেয়াদে বাংলাদেশকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে আশ্চর্যজনকভাবে বিএনপি-জামায়াত জোটের কাছে পরাজিত হয়। তখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ধর্মকেন্দ্রিক একটা ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এবারো কি কোনো বড় ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে? না হলে পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে কেন? অসৎ আওয়ামী লীগ কোনো নেতা, মজুতদারি করে কালো মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসায়ী আর আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এক হয়ে কি কোনো ষড়যন্ত্র করছে? এগুলো আমাদের জনমনের প্রশ্ন। উত্তর দেবে কে?

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :