জ্ঞানের ফেরিওয়ালা একজন মিনারা

ফয়সাল আহমেদ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:৫৪ | প্রকাশিত : ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:৩৮

বিদ্যালয় থেকে শিক্ষকদের দেয়া শিশুদের বাড়ির কাজ তৈরি করে দিয়ে গত এক যুগ ধরে তিনি শিক্ষিত বাবা-মায়ের কাজটি করছেন। অনেক পরিবারে এমন রয়েছেন যারা পড়াশোনা একেবারেই জানেন না। এমন বাবা-মায়ের কোমলমতি শিশুরাই তার কাছে পড়েন। বাড়ির কাজের এ শিক্ষকের নাম মিনারা বেগম (৫৫)।

শুধু প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তার কাছে পাঠ গ্রহণ করে থাকে। সারাদিন গড়ে ৪০ জন শিক্ষার্থী তার কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করে। তিনি তার বাড়ির বারান্দা ও উঠানে শিক্ষার্থীদের পড়ান।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনয়িনের কর্নপুর চৌরাস্তার পাশে মৃত তাজউদ্দিন বেপারীর দ্বিতীয় স্ত্রী মিনারা বেগম। ১২ বছর আগে তার স্বামী মারা যান। ছোট বেলা থেকে নিজেই তার সন্তানদের হাতে কলমে পড়াশোনা করিয়েছেন। তার সন্তানেরা সব শ্রেণিতে প্রথম থেকে তৃতীয় অবস্থানের মধ্যে থাকত। তার সন্তানদের সাফল্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রচার হতে থাকে বিদ্যালয় থেকে দেয়া বাড়ির কাজ মিনারা বেগম তার সন্তানদের দেখিয়ে দেন, ভালো পড়ান, যত্ন করে পড়ান ইত্যাদি।

মিনারা বেগম বলেন, সন্তানদের পড়ানোর প্রচারণা তার স্বামী মৃত্যুর পর প্রকাশ পেয়েছে। স্বামী মৃত্যুর পর মানসিক কষ্ট তাকে পীড়া দেয়। অনেকদিন পর্যন্ত এ কষ্ট ভুলতে পারেননি। স্বামী নেই কিন্তু এলাকার মানুষের জন্য কিছু করার চিন্তা তার মাথায় আসে। তবে বড় কিছু করার সামর্থ্য নেই। এসময় এলাকার সহজ সরল শিক্ষাহীন পরিবারের মানুষজন তাদের সন্তানদের পড়ানোর জন্য তাগিদ দেয়। একে একে অনেক অভিভাবক ভিড় জমাতে থাকে। তাদের আর্থিক অবস্থা দেখে কোনো বিনিময় চাওয়ার ভাবনাও আসেনি তার মনে। বিনা পারিশ্রমিকেই শুরু করেন পড়ানো।

তিনি বলেন, শিক্ষা বিলানো একটি মহৎ কাজ। এ কাজটি করার মানসিকতা থেকে কোমলমতি শিশুদের পড়ানো শুরু করি। কেউ পারিশ্রমিক দেয় আবার কেউ দেয় না। কেউ আবার যা পারে তাই দেয়। কারও কাছে আমার কোনো দাবি নেই। আমি কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা দিই এতেই আমার তৃপ্তি।

কর্ণপুর স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী শারমীন আক্তার। তার বাবা গিয়াস উদ্দিন রিকশাচালক, মা কুলসুম আক্তার পোশাক কারখানার শ্রমিক। শারমীনের নানী রমিজা খাতুন ঢাকাটাইমসকে বলেন, তার বাবা-মা কেউই পড়াশোনা জানেন না। বিদ্যালয় থেকে বাড়ির কাজ দিলে শারমীন একা করতে পারে না। তাই তাকে প্রতিদিন মিনারা বুবুর এখানে নিয়ে আসি। গরিব মানুষ মাসিক বেতন দিতে পারি না। বুবুও দাবি করেন না। আমি ও আমার পরিবার তার প্রতি কৃতজ্ঞ।

পার্শ্ববর্তী পাঁচুলটিয়া গ্রামের রিকশাচালক শাহাদাত হোসেনের কন্যা একই শ্রেণির শারমীন সুলতানা। সে জানায়, তার বাবা-মা কেউই পড়াশোনা জানেন না। বিদ্যালয় থেকে দেয়া বাড়ির কাজ তার বড় মা (মিনারা বেগম) করে দেন। বড় মায়ের কাছ থেকে পড়ে বিদ্যালয়ে গেলে ক্লাসে পড়া আদায় করতে পারে।

একই বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী জিহাদ। তার বাবা কবির হোসেন কর্ণপুর চৌরাস্তার সবজি বিক্রেতা। মা লতিফা খাতুন গৃহিণী। বড় ছেলে নাহিদুল ইসলামকে পড়াশোনা করাতে পারেননি। তার বাবা সবজি বিক্রেতা কবির হোসেন বলেন, আমরা (স্বামী-স্ত্রী) কেউ শিক্ষিত নই। ছেলেটা স্কুল থেকে এসে বাড়ির কাজ করে দিতে বলে। নিজে পারি না। কী করব? তাকে তো বাড়ির কাজ করে দিতেই হবে। অবশেষে মিনারা কাকীর কাছে পাঠিয়েছি। আয় রোজগার তেমন একটা নেই। কাকী টাকা নিতে চাননা। তাও জোর করে মাসে দেড়শ টাকা দিই।

কর্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও ইব্রাহীমের ছেলে ইসমাইল হোসেন জানায়, বিদ্যালয় থেকে দেয়া বাড়ির কাজ দাদু ভালো করে বুঝিয়ে দেন। পরদিন ক্লাসে গিয়ে স্যারদের কাছে তা উপস্থাপন করি। স্যারেরাও বাহবা দেন।

পাঁচুলটিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান বেপারীর কন্যা চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আফসানা সুলতানা জানায়, দাদু একবার পড়ালে খুব সহজেই বুঝে ফেলি।

সিটপাড়া গ্রামের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সাকিব, সিফাত, আক্তার হোসেন ও সালমা জানায়, দাদুর কাছে পড়তে যেমনি ইংরেজি ভালো লাগে, তেমনি গণিতও।

মিনারা বেগমকে তার শিক্ষার্থীরা কেউ দাদু, কেউ বুবু, কেউ বড় মা আবার কেউ কাকী মা বলে ডাকেন। মিনারা বেগম বলেন, যারা তার কাছে পাঠ নেন তারা একই এলাকার। কোনো না কোনো উপায়ে তারা আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। এজন্যেই একেকজনের সম্বোধনের উপাধি একেকরকম।

মিনারা বেগম ঢাকাটাইমসকে বলেন, দিনে তার কাছে তিনটি ব্যাচ রয়েছে। সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত (দুই ঘন্টা) তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি, বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত (দুই ঘণ্টা) শিশু শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত (দুই ঘণ্টা) পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পাঠ গ্রহণ করে। সকালের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে শিফট শুরু হয় দুপুর ১২টার পর, দুপুরের ব্যাচের বিদ্যালয় পাঠ শুরু হয় সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আর বিকেলে ব্যাচের বিদ্যালয় পাঠ শুরু হয় দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত। এ সময়ের সাথে মিল রেখে তিনি তার কাছে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের পাঠ সময় নির্ধারণ করেন।

মিনারা বেগমের শিক্ষা জীবন মাধ্যমিকের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। তার দুই ছেলে। একজন হাফেজ মানজুরুল ইসলাম ও আরেকজন স্থানীয় শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছেন। একই সংসারে মিনারা বেগমের স্টেপ বোন (সতীন) রয়েছে। তার নাম আফরোজা। সংসার জীবনে তার সন্তানাদি নেই। এ সংসারে স্টেপ বোনের (ছোট সতীন) জ্ঞান বিলানোর কাজে সহায়তা করেন। পড়ানোর সময় কোমলমতি অমনোযোগী শিশুদের মনোযোগ আকর্ষণ করার প্রতি তার দেখভালের প্রতি তার দায়িত্ব।

একই এলাকার মাহবুব আলম মাস্টার বলেন, অনেক আগে থেকেই মিনারা বেগম প্রাইমারি শিক্ষার্থীদের পড়ান। সারাদিনই তার বাড়িতে শিক্ষার্থীদের যাতায়াত করতে দেখি।

একই গ্রামের রিকশা চালক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা জানি মিনারা বেগম কারও কাছ থেকে চেয়ে কোনো টাকা পয়সা নেন না, পড়ানও ভালো। যে যা পারেন তাই দেন, তিনিও তা নেন। এ নিয়ে কোনো বাগবিতণ্ডা হয় না।

কর্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, মিনারা বেগমের কাছে যেসব শিক্ষার্থী পড়েন তাদের পারফরমেন্স শ্রেণিতে ভালো। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা তার কাছে পড়েন। কিন্তু তার পড়ানো দরিদ্র নয়।

একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সামসুন্নাহার বলেন, মিনারা বেগমের কাছে যারা পড়ে তাদের বেশিরভাগই আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার দিন মিনারা বেগম নিজে বিদ্যালয়ে চলে আসেন। তার শিক্ষার্থীদের ফলাফল জানতে প্রবল আগ্রহ থাকে তার মধ্যে। তিনি একজন শিক্ষানুরাগী মানুষ।

শ্রীপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুল হাসান ঢাকাটাইমসকে বলেন, প্রতিটি এলাকায় এরকম উদ্যোগী মানুষ থাকলে বাংলাদেশ নিরক্ষরমুক্ত হতে সময় লাগবে না। মিনারা বেগম অতি মহৎ কাজ করছেন, যা জাতির জন্য গৌরবের।

(ঢাকাটাইমস/২৩ডিসেম্বর/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :