ষোড়শ সংশোধনী: রিভিউ আবেদনে ৯৪ যুক্তি
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনে রাষ্ট্রপক্ষ ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরেছে। আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে যেসব মন্তব্য করা হয়েছিল, তারও বেশ কিছু বাতিল চাওয়া হয়েছে এই আবেদনে।
রবিবার সকালে এ রিভিউ আবেদনটি করা হয়। পরে সংবাদ সম্মেলনে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, আপিল বিভাগের রায় ও রায়ে দেয়া পর্যাবেক্ষণের কিছু অংশ বাতিল চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
বিচারক অপসারণ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিয়ে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বর্তমান সরকার সংবিধানে যে সংশোধনী এনেছিল, সেটিই ষোড়শ সংশোধনী নামে পরিচিত। এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট আবেদনের পর ২০১৬ সালের ৫ মে সেটি অবৈধ ঘোষণা করা হয়। আর এই রায়ের বিরুদ্ধে গত ৩ জুলাই আপিল সরাসরি খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতি থাকাকালে এই রায়ের পর্যবেক্ষণে বেশ কিছু মন্তব্য করেন যা বিতর্কের সৃষ্টি করেছ। এই বিতর্কের মধ্যে সিনহা এক মাসের ছুটি নিয়ে আর দেশে ফেরেননি। ছুটি শেষে গত ১০ নভেম্বর দেশে না ফিরে তিনি পদত্যাগ করেন।
ষোড়শ সংশোধনী বহালে যেসব যুক্তি
ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার ফলে বিচারক অপসারণে এর আগের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা ফিরে এসেছে। এই পদ্ধতিটি জিয়াউর রহমানের সেনা শাসনামলে চালু হয়েছিল।
রিভিউ আবেদনে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আদালত ‘মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে প্রণীত কোনো আইনকে (ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে) বৈধ হিসেবে বিবেচনা করেনি। কিন্তু সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান সংক্রান্ত বিষয়টি বৈপরীত্য দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ (সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের ধারণা) করে ভুল করেছে। যা সংশোধনযোগ্য।
রাষ্ট্রপক্ষ তাদের যুক্তি দেখিয়ে রিভিউ আবেদনে বলছেন, মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশটি তৎকালীন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ দ্বারা গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এই আইনকে (মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ) মার্শাল ল’ এর অধীনে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। যার কারণে এই অধ্যাদেশটি দেশে আইন (বর্তমানে) হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এই কারণে মার্শাল ল’ অধ্যাদেশটি ষোড়শ সংশোধনীর সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। যা আদালত তুলনা করে ভুল করেছে। এটি সংশোধনযোগ্য।
রাষ্টপক্ষের কৌসুলিদের যুক্তি হলো, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অনুযায়ী সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান রেখে একটি আইন করার কথা ছিল। কিন্তু সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে সেই আইন এখনো করা হয়নি। অথচ এই আইন করার পূর্বেই রিট করা হয়েছে। তাই এই রিটটি অপরিপক্ক। অথচ এই অপরিপক্ক রিটটি আদালত আমলে নিয়ে রায় দিয়েছে।
রিভিউ আবেদনে বলা হয়, মূল সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ কার্যকর রেখে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করার মাধ্যমে সরকার কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচারণ প্রমাণিত হলে আইন অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংবিধানে সংশোধনী আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু এই আদালত (আপিল বিভাগ) সেই সংশোধনীকে একটি ‘কালারফুল অ্যামেন্ডমেন্ট’ মন্তব্য করে এবং কোনো প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নিয়ে এই সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করার মাধ্যমে ভুল করেছে।
রাষ্ট্রপক্ষ রায়ের আরেক অংশের বিষয়ে রিভিউয়ে যুক্তি দেখিয়ে উল্লেখ করেছেন, মার্শাল ল’ এর যাবতীয় কার্যক্রম সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর রায়ের মাধ্যমে মার্জনা করা হয়েছিল। যা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধীর রায়ে ক্ষেত্রে বিবেচনা না করে ভুল করা হয়েছে। এ বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছে। যার কারণে এটি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
যেসব মন্তব্য বাতিল চাওয়া হয়েছে
রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘ফাউন্ডিং ফাদারস অব দি কান্ট্রি’ বলে যে কথা বলা হয়েছে, সেটি বাতিল চাওয়া হয়েছে বলে জানান মাহবুবে আলম। আবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির জনক হিসেবে ইতিমধ্যে স্বীকৃত। কিন্তু রায়ে ‘ফাদার’ না লিখে বহুবচন ‘ফাদারস’ ব্যবহার করা হয়েছে। যা সংশোধনযোগ্য।
রায়ে বলা হয়েছে, ‘আমাদের অবশ্যই আমিত্ত্বের ধারণা থেকে মুক্তি পেতে হবে’। এই অংশও বাতিল চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। বিষয়টি বাতিলে যুক্তিতে বলছে, ‘আদালতের এই পর্যবেক্ষণ ভিত্তিহীন ও অপ্রত্যাশিত। যা এই মামলার বিবেচ্য বিষয় নয়।
আপিলের রায়ে বলা হয়েছে, ‘১. আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সংসদ এখনো শিশুসুলভ। ২. এখনো এই দুটি প্রতিষ্ঠান মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। রায়ের এই অংশটা বাতিল চাওয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রে রাষ্টপেক্ষের যুক্তি হলো, এই পর্যবেক্ষণ আদালতের বিচার্য বিষয় নয়। যা বিচারিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, ‘সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ক। যদি সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয় তবে তা হবে আত্মঘাতী।’ এই অংশটুকুও বাতিল চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হচ্ছে, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ শুধু অবমাননাকরই নয় বরং ভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নও বটে। আদালতের বিচারিক এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে এই মন্তব্য করা হয়েছে। রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ অন্য একটি অঙ্গের বিরুদ্ধে এরুপ মন্তব্য করতে পারে না।
আপিলের রায়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়েও সমালোচনা করা হয়। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তার সদস্য পদ বাতিল হবে।
রিভিউ আবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা নিশ্চিত ও সরকারের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ আনয়ন করা হয়। জাতীয় রাজনীতি থেকে দুর্নীতি ও অস্থিতিশীলতা অপসারণ করাই ছিলো এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য। সংবিধানের এই যে উদ্দেশ্য তা বিবেচনা না করে আদালত একটি ভুল করেছে।
(ঢাকাটাইমস/২৪ডিসেম্বর/এমএবি/ডব্লিউবি)