জীবনযুদ্ধে হারেননি বিধবা জরিনা

আতাউর রহমান সানী, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ)
| আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ২১:৫৬ | প্রকাশিত : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ২১:৪৮

প্রবাদ আছে- ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’ পরিশ্রমই মানুষকে সফলতা এনে দিতে পারে। তেমনি জীবনযুদ্ধে হারেননি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের বড়ালু এলাকার মেয়ে জরিনা আক্তার। একটি বেসরকারি এনজিও থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গজা, মিষ্টি, সিঙ্গারা, পুড়ি, সমুচা, লবঙ্গ, পুডিং, আচার, চিকেন ফ্রাই, সবজি রোলসহ ইত্যাদি বেকারি পণ্য তৈরি করে। তারপর বেকারি পণ্যগুলো নিজেই গিয়ে স্থানীয় বড়ালু বাজারে বিক্রি করেন। এসব বেকারি পণ্য বিক্রি এখন জরিনা আক্তার সাবলম্বী।

ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে জরিনা ছিলেন সবার বড়। তাই অভাব-অনটনের সংসারে জরিনার যখন হাতে বইখাতা থাকা দরকার, তখন থেকেই তাকে ইট ভাঙা, জোগালিসহ বিভিন্ন ধরনের কায়িক পরিশ্রমের কাজ করে সংসার চালাতে হতো জরিনা ভেবেছিল বিয়ের পর হয়তোবা তাকে আর কাজ করতে হবে না। স্বামীর সংসারে গিয়ে তিনি সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতে পারবে। কথায় আছে অভাগী যে দিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। বিয়ের পরেও জরিনা পেল না তার কাঙ্খিত সুখ নামে সেই দুর্লভ বস্তু।

জরিনার বাবা অসুস্থ থাকার কারণে ১৫ বছর আগে মাত্র ১৪ বছর বয়সে কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানার নারাইশ এলাকার কাইয়ুম মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ভেবেছিল স্বামীর সংসারে এসে সুখ পাবে সেখানেও অভাব-অনটন তার পিছু ছাড়েননি। বিয়ের পর তারা ঢাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। জরিনার স্বামী কাইয়ুম মিয়ার ঢাকায় ইলেকট্রনিক্স কারখানায় কাজ করতেন। বিয়ের পর তাদের দুজনের সংসারে শান্ত ও শাকিব নামে দুজন ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস বিয়ের ৪ বছর হতে না হতে জরিনার স্বামী কাইয়ুম মিয়া বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। জরিনার শশুর-শাশুড়ি কেউ বেঁচে না থাকার কারণে জরিনা তার দুই ছেলেকে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে চলে আসতে বাধ্য হয়। বাবা-মারা যাওয়ায় জরিনা তার মাকে ও দুই ছেলেকে নিয়ে বসবাস করে। জরিনার ভাই তার বউ নিয়ে আলাদা বাসায় থাকায় বৃদ্ধ মায়ের সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে জরিনা আক্তারের উপর। সংসার চালানোর তাগিদে জরিনা আক্তার ইট ভাঙা, জোগালি, গার্মেন্টসে কাজ করতেন। অভাবের সংসারে ছেলেদের লেখা-পড়া চালানোটা অনেক কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল। বৃদ্ধ মায়ের ওষুধের খরচ, সংসারের ব্যয়ভার ও ছেলেদের পড়ালেখার খরচ চালাতে গিয়ে জরিনা আক্তার দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রায় সবসময় জরিনাকে গার্মেন্টস থেকে কাজ করে রাতে বাড়িতে ফিরতে হতো। বাড়িতে ফেরার সময় প্রায়ই সময়ই সে বখাটেদের কাছে ইভটিজিংয়ের শিকার হতেন। এজন্য গার্মেন্টসের কাজটি বাধ্য হয়ে তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছিলো। ৩ বছর আগে একটি বেসরকারি এনজিও সংস্থা থেকে কিছু কর্মকর্তা এসে প্রশিক্ষণের জন্য জরিনা আক্তারের নাম লিখে নিয়ে যায়। সেখানে জরিনা আক্তারকে ফুড প্রসেসিংয়ের উপর ৭ দিনের একটি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণে জরিনা আক্তার গজা, মিষ্টি, সিঙ্গারা, পুরি, সমুচা, লবঙ্গ, পুডিং, আচার, চিকেন ফ্রাই, সবজি রোলসহ ইত্যাদি বানানো শিখেছিলেন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত ১২৬০ টাকা ও বহু কষ্টে নিজের জমানো ৩ হাজারসহ মোট ৪ হাজার ২শ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে। গজা, মিষ্টি, সিঙ্গারা, পুড়ি, সমুচা, লবঙ্গ, পুডিং, আচার, চিকেন ফ্রাই এগুলো তৈরি করে এলাকার স্থানীয় দোকানগুলোতে পাইকারিভাবে বিক্রি করে। জরিনা আক্তার প্রতিদিন প্রায় ১শ টি দোকানে এইসব বেকারি পণ্য বিক্রি করে থাকে। এসব বেকারি পণ্য বিক্রি জরিনা আকতার প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার টাকা আয় করছেন। বর্তমানে জরিনা আক্তারের মূলধন হচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। জরিনা আক্তার ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তার ব্যবসাকে আরো বড় করার চেষ্টা করছে। এসবের পাশাপাশি জরিনার আক্তারের ৮টি ছাগল, ২টি গরু, ১৫টি চীনা হাঁস, ২০টি মুরগি ও ৩০টি কবুতর রয়েছে। হাঁস মুরগি ও পশু পালন করে জরিনা আক্তার প্রতিমাসে প্রায় ৮-১০ টাকা আয় করেন।

জরিনা আক্তার বলেন, মা-বাবা ছয় বোন এক ভাইয়ের অভাবের সংসারে ছোট বেলা থেকেই জরিনা অক্তারকে কাজ করতে হতো। জরিনা আক্তার কাজকে কখনো ছোট মনে করতো না। স্বামীর সংসারে গিয়ে সুখের মুখ দেখতে না দেখতে বিয়ের চার বছর পর স্বামী কায়ুম মিয়া বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। স্বামী মারা যাওয়ায় জরিনা আক্তার তার দুই ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসে। অভাবের সংসারে জরিনা আক্তার তার দুই ছেলের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে জরিনা আক্তার দিশেহারা হয়ে পরে। একটি এনজিও থেকে ফুড প্রসেসিংয়ের কাজ শিখে গজা, মিষ্টি, সিঙ্গারা, পুরি, সমুচা, লবঙ্গ, পুডিং, আচার, চিকেন ফ্রাই, সবজি রোল তৈরি করে নিজে গিয়ে এলাকার বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে। জরিনা আক্তার এখন সাবলম্বী তার সংসার চালাতে এখন আর কোন কষ্ট হয় না। জরিনা আক্তারের দুই ছেলে শান্ত অষ্টম শ্রেণি ও শাকিব পঞ্চম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। এখন আর তাকে পড়ালেখার খরচ চালাতে কষ্ট হয় না। এখন জরিনার একটিই আশা তার দুই ছেলেকে ভাল করে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করা।

জরিনা আরো বলেন, তিনি কোন ব্যাংক বা এনজিও থেকে আরো বেশি টাকা ঋণ পেলে এ ব্যবসাটিকে আরো বৃহৎ আকারে করতে পারবে। তখন তিনি নিজ এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা এসব বেকারি পন্য তৈরি করে বিক্রি করতে পারবে। জরিনা আক্তার তার এ ব্যবসা দিয়ে ৮-১০ জন গৃহবধূর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

জরিনার মতো আরো যারা আছেন, তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, জীবনে চলার পথে কখনো কোন কাজে হাল ছাড়া উচিত না। জীবনে চলার পথে অনেক বাঁধা আসবে। তাই বলে থেমে থাকলে চলবে না সেসব বাধা অতিক্রম করেই এগিয়ে যেতে হবে।

(ঢাকাটাইমস/২৫ডিসেম্বর/প্রতিনিধি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :