বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে কর্মজীবী নারীর শক্তিতে

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ২০:২২

বছর শেষে এসে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ‘ঘুষ-বাণী’র সংবাদ পড়ে মন যতখানি খারাপ হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি মন ভালো হয়ে যাচ্ছে ফুটবলে নারী জাগরণের ছবিগুলো দেখে, নারী ফুটবলারদের দেখে। ছোট ছোট মেয়েগুলো যেন পুরো বাংলাদেশকে বাঁচানোর মিশনে নেমেছে।

নারী কী এক অমিত শক্তির আধার, সেটি যেমন অনেক পুরুষ জানে না, অনেক নারীও জানে না। যখনই নারী তাঁর শক্তির চর্চা ও বিকাশের সুযোগ পেয়েছে, তখন কেউ তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বিশ্বের মধ্যে সেসব রাষ্ট্রই আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে, যেখানে নারীরা স্ব স্ব প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পেরে উৎপাদন ব্যবস্থার সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করতে পেরেছে। বাংলাদেশেও সমাজ-অর্থনীতিতে সক্রিয় নারী সদস্যের সংখ্যা বাড়ছে। অর্থনীতি শক্তিশালী হলেই সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। আবার অন্যান্য ক্ষেত্রের ইতিবাচকতা অর্থনীতিকে নতুন শক্তি দেয়।

পুরুষ আর নারীর মধ্যে শুধু দৈহিক গঠনকাঠামো সংক্রান্ত পার্থক্যই রয়েছে তা নয়, সমাজ-সভ্যতার ওপর প্রভাব সৃষ্টি সংক্রান্ত পার্থক্যও তাৎপর্যপূর্ণ। পরিবারের ওপর নারীর প্রভাব যেমন গঠনমূলক আবার সমাজের ওপরও নারীর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ১৯৭১ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর ছেলে রুমিকে দেশমাতৃকার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। এ রকম আরও হাজার হাজারো নারী তাদের স্বামী, সন্তান, ভাইকে যুদ্ধে যেতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। নারী আবার নিজেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। নারী হিসেবে নয়, বীর যোদ্ধা হিসেবে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জটিল রাজনৈতিক পথে সঠিক নিশানায় পরিচালিত করতে তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ভূমিকা এখনো যথাযথভাবে মূল্যায়ন পায়নি। আবার তাঁদের জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের অন্যতম সফল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি দুইটা বড় আইনি যুদ্ধে ভারত ও মিয়ানমারকে হারিয়ে বিশাল সমুদ্রসীমা এনে দিয়েছেন দেশকে। এ রকম প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যাবে নারী সুযোগ পেলে অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে।

দেশের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর ফারজানা ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর আগের দুই ভিসি নানা কারণে মেয়াদ শেষ করার আগেই বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখানে ব্যতিক্রম অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। ছোটখাটো কিছু সমস্যা ছাড়া, ক্যাম্পাসে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রেখে সাফল্য প্রদর্শন করেছেন ফারজানা ইসলাম। আর কিছুদিন পরেই দেশের প্রথম নারী উপাচার্যের মেয়াদ পূর্ণ হবে। এ রকম প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী অনবদ্য ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, নারী ছাড়া অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না। দেশের প্রধান দুই অর্থনৈতিক খাত কৃষি ও গার্মেন্টস শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ আমাদের বলে দেয়, নারী বাংলাদেশের প্রাণ। গার্মেন্টস শিল্পে নারী কীভাবে জড়িয়ে আছে, সেটি সকাল, দুপুর, বিকেল আশুলিয়া, টঙ্গীর রাস্তায় গেলেই দেখা যায়। দেশের প্রত্যন্ত নানা অঞ্চল থেকে মেয়েরা এসে গার্মেন্টস কারখানা তথা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এসব গার্মেন্টস কর্মীদের ভরণ-পোষণে মালিক পক্ষের ব্যর্থতা থাকলেও দায়িত্ব পালনে শ্রমিকদের কোনো গাফিলতি নেই। বিস্ময়কর মাত্রার কম মজুরি নিয়ে নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা কাজ করছে।

কৃষিতে নারীর অবদান খুব সহজে মূল্যায়ন করা যাবে না। ‘খনার বচন’ বলে একটা কথা আমরা সকলেই শুনেছি। এই খনা কে? তিনি কি পুরুষ ছিলেন, না নারী? কৃষিতে এই নারীর অবদান কী? এগুলো একটু জানা দরকার। ‘খনার বচন, কৃষি ও কৃষ্টি’ শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক ড. আলী নওয়াজ লিখেছেন, ‘ বাংলাদেশের কৃষির ইতিহাস সুপ্রাচীন। আর্য আগমনের পূর্ব থেকে ইংরেজ আমল পর্যন্ত এদেশের কৃষি-সভ্যতার ক্রমবিকাশ এ গ্রন্থের প্রথম দুই পরিচ্ছেদে সন্নিবেশিত। খনার বচনে এ দেশের আদি কৃষি বিজ্ঞান। এদেশের একটি প্রাচীন জ্যোতিষ ও হোরা শাস্ত্রও বটে। গণ স্বাস্থ্য বিজ্ঞানও বলা চলে। খনার বচন চাষাবাদ, গার্হস্থ্য জীবন ও পশুপান সম্পর্কে নির্দেশাবলী সুশৃংখলভাবে বর্ণিত।অতি প্রাচীন কাল থেকে এদেশের জগৎ ও জীবন দর্শন কৃষি ভিত্তিক হয়ে গড়ে উঠেছে। ফলে, এ দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে খনার বচনের অবদান অপরিসীম। খনার বচন শুধু প্রাচীন ফসলাদি সম্পর্কেই জানা যায়।ধান ও কলা সম্পর্কে অধিক বচন রয়েছে। তন্মধ্যে ধান সম্পর্কে বেশি’।

এ অঞ্চলের কৃষি তাহলে একজন নারীর কাছেই ঋণী! একটি কৃষক পরিবারের দিকে লক্ষ্য করুন। কৃষক, কৃষাণী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার। যৌথ পরিবারই বেশীরভাগ। অনেক ক্ষেত্রে একক পরিবারও দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার যৌথ হলেও কৃষি জমি যৌথ নয়। প্রতিদিনের কৃষি কাজের সাথে একজন কৃষক যতখানি জড়িয়ে থাকেন, একজন কৃষাণীও তাই। এমনকি কৃষক-কৃষাণীর ছেলে-মেয়েরাও কিন্তু এই কৃষি কাজের অংশ। কৃষাণী নিজেও সরাসরি কৃষি জমিতে কাজ করেন। আবার সারাদিন কৃষি জমিতে কাজ করলে হবে না। ঘর-বাড়ি সামলাতে হবে। সংসার সামলাতে হবে। সন্তান হয়ত স্কুলে যাবে, তাকে রেডি করতে হবে। সন্তান হয়ত স্কুল থেকে এসে বাড়িতে অপেক্ষা করছে দুপুরের খাবারের। একটি কৃষক পরিবারে ঘর গোছানো থেকে শুরু করে সরাসরি ক্ষেত-খামারে কৃষি কাজে অংশ নেয় নারী। একটি পোল্ট্রি ফার্ম কিংবা মৎস্য খামারেও স্বামীর সাথে স্ত্রী পাশাপাশি অংশ নিচ্ছে। যে কৃষি-পরিবারে বাবা নেই, মা আছে, সেখানে নারীকেই পুরো ভূমিকা পালন করতে হয়। নারীকে বাদ দিয়ে কৃষি কল্পনাই করা যায় না। কৃষক আর কৃষাণী মিলেই এদেশের কৃষি।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। পেশার প্রতি আন্তরিকতা, সততা, অধ্যবসায়সহ সমস্ত গুণাবলী নিয়ে নারী শিক্ষকরা এদেশের পুরুষ শিক্ষকদের পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুলের শিক্ষকতায় নারীর অবদান অনবদ্য। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষকরা গবেষণা কর্মের পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষার বিস্তারে দারুণ ভূমিকা রাখছেন। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কেন, পরিবারে শিশু প্রথম অ, আ শিখে মূলত মায়ের কাছ থেকেই। এটা করবা না, ওটা করবা না ইত্যাদি নসিহত মায়েরাই বেশি করেন। অর্থাৎ শিশুর নৈতিক শিক্ষা মায়েরাই প্রথম দেন। কারণ মায়ের সাথেই শিশুর বেশির ভাগ সময় কাটে। আর যদি যদি গর্ভধারণের কথা বলি, সন্তান জন্মদান এবং শিশুর যত্নের কথা বলি তাহলে তো নারী অতুলনীয়। নারীকে সন্তানধারণে সক্ষম করে তোলার প্রক্রিয়ায় শারীরিক অংশগ্রহণ ছাড়া পুরুষের ভূমিকা আর তেমন মুখ্য নয়। শিশুর জন্মদানের পরে প্রথম ৬ মাস মা যে কষ্ট করেন, তা কোনো পুরুষের পক্ষে করা অসম্ভব।

এভাবে সন্তান জন্মদান থেকে শুরু করে কৃষি, গার্মেন্টস, রাজনীতি, খেলাধুলা, পররাষ্ট্রনীতি, কর্পোরেট সেক্টর, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী নানা বাহিনী, সামরিক-আধা সামরিক বাহিনী, যাত্রীবাহী ও যুদ্ধ বিমান পরিচালনা, সাংবাদিকতাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও সাফল্য দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী।

কোনো উৎপাদনমুখী কাজ না করে সারাক্ষণ সাজুগুজু নিয়ে যেসব নারী ব্যস্ত থাকেন, কারণে-অকারণে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে শপিং করেন, ‘প্রগতিশীল’ সেজে সমাজ-সংসার নিয়ে উদ্ভট সব যুক্তি দাঁড় করান, নারীর প্রগতি বলতে শুধু বিবাহ-বিচ্ছেদ আর পুরুষের সাথে টেক্কা দেয়াকে বোঝান, তাঁদের বিষয়েও নারী সমাজকে সচেতন করতে হবে। যেসব নারী ঘরে বা ঘরের বাইরে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক বা বস্তুগত উৎপাদনমুখী কাজের সাথে জড়িত নন, তারা প্রকৃত অর্থে প্রগতিশীল নন। অথচ সমাজে এমন নারীর সংখ্যাও অনেক।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে সমাজ-অর্থনীতির সক্রিয় সদস্য হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে। দেশের পুরুষ সমাজের সবার দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন আনতে হবে। নারীকে অবলা, নারীকে ভোগ কিংবা গুনাহের উপাদান মনে করা, নারীকে ঘরে বা পোশাকে বন্দী করে রাখার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আবার নারী সমাজকেও শুধু পোশাকি প্রগতির চর্চা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :