হিমুর খোঁজে নুহাশ পল্লীতে

আসাদুজ্জামান, নুহাশ পল্লী থেকে ফিরে
| আপডেট : ১০ জানুয়ারি ২০১৮, ১৬:০৯ | প্রকাশিত : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ২০:৪৯

শেষ বিকালের আলোয় সোনালি আভা। গোধূলি বেলায় সেই আলো হলুদ রঙ ধারণ করেছে। নুহাশ পল্লীর শালগাছের পাতার ফাঁক গলে সেই আলো চুইয়ে পড়ছে সবুজ ঘাসে। আর তাতে খনিক শিশিরভেজা ঘাসের ডগা ঝলমল করছে। তারই তলায় লাল মাটির নিচে শুয়ে আছেন বাংলার নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।

চত্বরটি সাদা পাথরে বাঁধানো। ঠিক অনেকটা বেঁদির মতো। তাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য আছে কয়েকটি লিচু গাছ। জায়গাটা তার প্রিয় ছিল। আর তাই তো তার গড়া নুহাশ পল্লীর এই লিচুতলায় চিরশয্যা নিয়েছেন হিমু-মিসির আলীর স্রষ্টা।

জীবদ্দশায় প্রিয় লেখক হুমায়ূনের সঙ্গে দেখা মেলেনি আশিকের। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা করার বড় আকুতি ছিল তার। বহু দূর পথ পেরিয়ে আজ এসেছেন প্রিয় লেখকের সমাধি দেখতে। এখানে এসে তার চোখ অশ্রু সজল হয়ে ওঠে। আকাশের দিকে দু হাত তুলে লেখকের আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করেন। তারপর ফিরে যান নিজের গন্তব্যে।

প্রতিদিনই আশিকের মতো বহু হুমায়ূন-ভক্ত আসেন এখানে। আজও শেষ বিকালে অনেকের দেখা মেলে। এদেরই একজন রুবেল। প্রিয় লেখকের কথা বলতে গিয়ে তার গলা কিছুটা ভারী হয়ে আসে।

চোখে টলটল করে জল। নিজেকে সামলে নিয়ে রুবেল বলেন, ‘হুমায়ূন স্যারের গল্প পড়ে বড় হয়েছি। তিনি আমাদের জীবনকে নতুনভাবে চিনিয়েছেন।’

৪০ বিঘা জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা নুহাশ পল্লী সবুজ শ্যামলীমায় ভরা। শেষ বিকালে জায়গাটা অনেকটাই শুনশান হয়ে যায়। দ্বাররক্ষীর সঙ্গে আলাপচারিতা শেষে ভেতরে ঢোকার অনুমতি মেলে। জায়গাটা বেশ সাজানো গোছানো। চারপাশের সাজসজ্জায় রুচির ছাপ মেলে। প্রথমেই চোখ পড়ে ছোট্ট একটি সুইমিং পুলের দিকে। জলের মাঝে মাথা উঁচু করে আছে জলপরী, যেন অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছে।

তার পাশেই হুমায়ূনের প্রতিকৃতি। দু হাত মুঠো করে চেয়ারে বসে আছেন। ভঙ্গিটা অসাধারণ। সামনে খোলা মাঠ। মাঠে সবুজ ঘাস। সেখানে খুঁটিতে বাঁধা কয়েকটা গরু। মাঠের ঠিক মাঝখানে ট্রি হাউজ। এসব দেখতে দেখতে এগিয়ে যাওয়া।

খানিকটা যেতেই চোখ আটকে যায় এক কিশোরীর ওপর। বেঞ্চে উবু হয়ে থাকা কিশোরীর চোখের সামনে দুই হাতে বই মেলে ধরা।আয়েশে বই পড়ছে সে। শিশুটি জীবন্ত নয়। পাথরের তৈরি। কিন্তু দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই তা।

পড়ুয়া শিশুকে একলা ফেলা এগিয়ে যাই ‘বিখ্যাত’ বৃষ্টি বিলাস নামের বাড়ির দিকে। হুমায়ূন বৃষ্টির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। ঝুমঝুম বৃষ্টি তার বড় প্রিয় ছিল। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শোনার জন্য বৃষ্টি বিলাস নামের এই বাড়ি বানিয়েছিলেন তিনি। চারপাশে এখনো হুমায়ূনের স্মৃতি।

মাঠের পাশ ধরে হেঁটে চলি সামনের দিকে। সেখানের পথ কিছুটা ঢালু। এখানে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য ভয়ংকর এক দৈত্যের মূর্তি আছে। মূর্তির পেছনে বাঁশঝাড়। সামনে জলে ভেসে আছে মৎস্যকন্যা। সব মিলিয়ে এক ভৌতিক পরিবেশ।

ঢালু পথ দিয়ে সামনো এগোলেই দীঘি লীলাবতি। সেখানে একটি নামফলক। তাতে লেখা ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছে নয়নে নয়নে’।

দীঘির মাঝে ছোট্ট একটি দ্বীপ। সেখানে কয়েকটি নারিকেল গাছ। দ্বীপে যাওয়ার জন্য কাঠের একটি সাঁকো। দীঘির ঠিক পাড়েই সুন্দর একটা একতলা বাড়ি। তার বারান্দাগুলো ঝুঁকে আছে দীঘির দিকে ।

আছে ঢান্ডা জলের পুকুর। সান বাঁধানো ঘাট আছে। সিঁড়ি বেয়ে ঠান্ডা জলে পা ভেজায় নুহাশ পল্লীতে আগত দর্শনার্থীরা। এদেরই একজন রাহেলা। তিনি বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের সমাধি এবং নুহাশ পল্লী ঘুরতে এসেছি। জায়গাটা খুব ভালো লেগেছে। মন ভরে নুহাশ পল্লীর প্রকৃতি উপভোগ করছি।’

নুহাশ পল্লী দেখতে দেখতে সন্ধ্যাকাশে আকাশে তখন আধখানা চাঁদ। সাঁঝের বেলায় দূর থেকে ডেকে ওঠে নাম না জানা কয়েকটি পাখি। যেন বা বিদায় নেয়ার ঘোষণা। প্রিয় লেখককে পাখির কলকাকলিতে রেখে দর্শনার্থীরা বের হয়ে আসে নুহাশ পল্লী থেকে।

ফটক গলে বের হতেই বাঁশির করুণ একটা সূর ভেসে আসে। বড় চেনা লাগে সুরটা। খানিকটা সামনে এগোতেই বাঁশিওয়ালার দেখা মেলে। টং দোকানে সাজানো নানা পণ্যের পসরা নিয়ে বসে আছেন তিনি। এরই ফাঁকে সাঁঝের বেলায় তার বাঁশিতে সুর তুলেছেন- ‘শুয়া চান পাখি আমার, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি/ তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি/ আজি কেন হইলে নীরব মেল দুটি আঁখি রে পাখি/ আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’।

(ঢাকাটাইমস/২৬ডিসেম্বর/এজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :