‘শরিয়া আইনে’ দোররা, গৃহবধূর মৃত্যু

বদরুল ইসলাম বিপ্লব, ঠাকুরগাঁও
| আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ২১:৩৩ | প্রকাশিত : ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:৫৩

‘শরিয়া আইনে’র কথা বলে দেয়া ফতোয়ার পর দোররার আঘাতে এক কিশোরীর মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে ঠাকুরগাঁওয়ে।

কিশোরীটির চরিত্র নিয়ে অভিযোগ তুলে এই ফতোয়া জারি করা হলেও প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্বজনরা বলেছেন- উল্টো কথা। তাদের অভিযোগ, যৌতুক না পেয় স্বামীই কিশোরীটির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছিল।

এই ঘটনায় কিশোরীটির স্বজনরা হত্যা মামলা করতে গেলে পুলিশ তা না নিয়ে অপমৃত্যুর মামলা করে। পরে দেয়া হয় আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা।

গত ২০ ডিসেম্বর রাতে হরিপুর উপজেলার চৌরঙ্গী বাজার বালিয়াপুকুর গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। সেদিন দোররা মারার পরদিন কিশোরীটি মারা যায়। আর তার মৃত্যুর পর মরদেহ ঝুলিয়ে রেখে তা আত্মহত্যা বলে প্রমাণের চেষ্টা করে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন।

আর কিশোরীটি মারা যাওয়ার সাত দিন পর দোররা মারার ফতোয়াদাতা কাজী আবুল কালামকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

কিশোরীটির স্বজনরা জানিয়েছেন, চৌরঙ্গী বাজার বালিয়াপুকুর গ্রামে জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে নগদ ৩০ হাজার টাকা ও অন্যান্য সামগ্রী দেয়া হয়। কিন্তু আরও যৌতুকের দাবিতে জাহাঙ্গীর তাকে নির্যাতন করতেন। দাবি না মেটানোয় স্ত্রীকে তিনি প্রায়ই বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। গত ১৬ ডিসেম্বর এক লক্ষ টাকা দবি করে মারপিট করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয় তাকে।

পরে ফিরিয়ে আনলেও টাকা না পেয়ে ওই কিশোরীটির সঙ্গে তারই দেবরের অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগ এনে ২০ ডিসেম্বর রাতে গ্রাম্য মাতুব্বরদের নিয়ে সালিশ বসান হয়। আর সেখানেই ‘মাতুব্বর’ কাজী আবুল কালাম ‘শরিয়া আইন’-এর কথা বলে কিশোরী ও তার দেবরকে ১০১টি করে দোররা মারার ফতোয়া জারি করেন। তাৎক্ষণিকভাবে স্বামী জাহাঙ্গীর তাকে দোররা মারতে থাকেন।

দোররা মারার সময় কিশোরীটি কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর আবার চলে শারীরিক নির্যাতন। পরদিন বিকালে মারা যান ওই গৃহবধূ।

এ ঘটনায় ওই কিশোরীর বোন বাদী হয়ে জাহাঙ্গীর ও তার তার ভাই হাসিবুল এবং ফতোয়াবাজ কাজী আবুল কালাম, আব্দুল কাদের, সাবেক ইউপি সদস্য জামাল, তরিকুল ও কিশোরীটির চাচির নাম উল্লেখ করে থানায় অভিযোগ করেন। কিন্তু পুলিশ হত্যা মামলা না নিয়ে অপমৃত্যুর মামলা করে।

ওই কিশোরীটির বড় ভাই বলেন, এক লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে গত ১৬ ডিসেম্বর আমার বোনকে মারপিট করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। পরে সে বাবার বাড়ি চলে আসে। ২০ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীর তাকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং ওই রাতেই মিথ্যা অপবাদ দিয়ে শালিসের নামে নির্যাতন করা হয়।

ওই কিশোরীর ভগ্নিপতি বলেন, সে দোররার আঘাতে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে চিকিৎসাও করানো হয়নি। সে যখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর তারাই আবার লোক দেখাতে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, রাত ১১টায় ওই জাহাঙ্গীরের বাড়িতে সালিশ বসানো হয়। কাজী আবুল কালামের নির্দেশে ‘ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক’ মেয়েটিকে প্রথমে তওবা পড়ানো হয়। এরপর ১০১টি দোররা মারা হয়। তখন মেয়েটির চিৎকারে প্রত্যক্ষদর্শী এবং আশপাশের অনেকে ছুটে আসেন ওই বাড়িতে। কিন্তু কেউ তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসেনি।

স্থানীয়রা জানান, নির্যাতন সইতে না পেরে মেয়েটি বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরলে আবারও তাকে দোররা মারা হয়। এরপর অসুস্থ অবস্থায় অনেকটা বিনা চিকিৎসায় পরদিন বাড়িতে মারা যান তিনি।

কিশোরীর বড় বোন বলেন, যৌতুকের দাবি পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মারপিট করা হয়। পরে সে মারা যায়।

এই ঘটনা শুনেছেন জানিয়ে আমগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পাভেল ইসলাম বলেন, সালিশের নামে দোররা মারার ঘটনা ঠিক হয়নি। যারা এ কাজ করেছে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।

ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে মেয়েটির মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। চিকিৎক সুব্রত কুমার সেন জানান, মৌসুমীর শরীরে দোররার আঘাতের একাধিক চিহ্ন ছিল।

হরিপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম জে আরিফ বেগ জানান, দোররা মারার ঘটনায় গৃহবধূর মৃত্যুর ঘটনাটি চাঞ্চল্য কর মামলা ঘোষণা করে তদন্ত করা হবে।

পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদ জানান, এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে এবং ফতোয়াবাজ স্থানীয় কাজী কালামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য যারা এই ফতোয়াবাজিতে জড়িত, তাদেরকেও গ্রেপ্তার করা হবে।

ঢাকাটাইমস/২৮ডিসেম্বর/প্রতিনিধি/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :