জঙ্গি হামলা আর ‘হিটব্যাকের’ বছর

প্রকাশ | ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:০৯ | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:১৫

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস

আগের বছরের মতো ২০১৭ সালেও দেশে আলোচিত বেশ কিছু জঙ্গিবিরোধী অভিযান হয়েছে। এর মধ্যে একটি আস্তানায় রক্তক্ষয়ী অভিযানে নামনে হয়েছে সেনাবাহীর কমান্ডোদের।

গত এক বছরে ‘অপারেশন টোয়েলাইট’, ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’, ‘অপারেশন হিটব্যাক’, ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’ যেমন আতঙ্ক ছড়িয়েছে দেশে, তেমনি সন্দেহভাজন জঙ্গিদের মৃত্যুতে পরে ফেরে আস্থাও।

বাংলাদেশে ৯০ দশক থেকে জঙ্গি তৎপরতার শুরু হলেও ২০১৬ সালে এসে জঙ্গিদের আরও হিংস্র ও আগ্রাসী মনোভাব দেখা যায়। তবে পাল্টা অভিযানে বেশ সফলই হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৭ সালেও জঙ্গিবিরোধী বেশ কিছু অভিযানে নিহত হয়েছে সন্দেহভাজন শীর্ষস্থানীয় বেশ কজন জঙ্গি নিহত হয়, পাশাপাশি ভেঙেছে তাদের জাল।

চলতি বছরের ৬ মার্চ মাস নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের শীর্ষনেতা মুফতি মোহাম্মদ হান্নানকে ছিনিয়ে নিতে টঙ্গীতে পুলিশের প্রিজনভ্যানে হামলা চালায়। এটিই বছরের প্রথম আলোচিত জঙ্গি হামলা।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ব্যাপক প্রাণহানির পরই সারাদেশে শুরু হয় জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান। ২০১৭ সালেও এই অভিযান অব্যাহত থাকে।

৬ মার্চ টঙ্গীতে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টার পর গোটা মাসেই ঢাকা, নরসিংদীসহ বেশ কিছু এলাকায় অভিযান চালানো হয়।

এর পরের আলোচিত ঘটনাটি ঘটে কুমিল্লায়। প্রকাশ্যে বোমা হাতে নিয়ে পুলিশের ওপর ছুড়ে মারার সময় আটক হয় দুই জন। এরপর তাদের তথ্যে চলে বেশ কিছু অভিযান।

৭ মার্চ কুমিল্লার কোটবাড়িতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে তল্লাশির সময় পুলিশের ওপর বোমা হামলা চালায় সন্দেহভাজর দুই জঙ্গি। পরে তাদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে সন্ধান মেলে চট্টগ্রামের সাধন কুটিরের জঙ্গি আস্তানার। সেখানে জব্দ মোবাইল ফোনসেট ও সিমকার্ড থেকে জঙ্গিদের অন্যান্য বেশ কিছু আস্তানা খুঁজে পায় পুলিশ।

সীতাকুন্ডেঅপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন

মার্চের মাঝামাঝি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বড় ধরনের একটি জঙ্গি আস্তানা ঘেরাও করে পুলিশ। ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান।

১৫ মার্চ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুরুতে ‘সাধন কুটির’ নামে একটি বাড়ি ঘেরাও করে। সেখানে শরীরে বাঁধা বোমা বিস্ফোরণের সময় আটক করা হয় এক দম্পতিকে। ভেতরে পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণ গ্রেনেড ও বিস্ফোরক।

গ্রেপ্তার দুই ‘জঙ্গি’র তখ্যে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সীতাকুন্ড ডিগ্রি কলেজের পেছনে প্রেমতলা চৌধুরী পাড়ার ‘ছায়ানীড়’ নামে অপর একটি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ।

সেদিন বিকাল চারটার দিকে ‘ছায়ানীড়’ ঘেরাও করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সেখানে মূল অপারেশন চলে পরদিন ভোর ৬টা ২০ থেকে ১০টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। অপারেশনে ওই বাড়িতে আটকেপড়া ২০ জনকে উদ্ধার করা হয়। আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন এক নারীসহ পাঁচ ‘জঙ্গি’।

পুলিশ-র‌্যাব, চট্টগ্রামে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াটের সঙ্গে ঢাকা থেকে সোয়াট টিম এবং পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একটি দল মিলে চালায় অভিযানটি। এর নাম রাখা হয় ‘অপারেশন অ্যাসল্ট-সিক্সটিন’।

অভিযানের সময় পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের ব্যাপক গোলাগুলি হয় এবং ওই আস্তানা থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এক পর্যায়ে জঙ্গিরা আস্তানার ভেতর থেকে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। অভিযানে সোয়াট টিমের আহত দুই সদস্যকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়।

পরে গুলিতে এক জঙ্গি নিহত হয় ও অপর জঙ্গি আত্মঘাতী হয়ে জীবন দেন। আত্মঘাতী দুই জঙ্গির দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে ৫০০ থেকে ৭০০ ফুট দূরে ছিঁটকে পড়ে। ছায়ানীড় ভবনের সিঁড়িতে এক নারী জঙ্গির মরদেহ পাওয়া যায়। তার শরীরে সুইসাইডাল বেল্ট ও অবিস্ফোরিত একটি গ্রেনেড বাঁধা ছিল।

আশকোনায় র‌্যাব ক্যাম্পে আত্মঘাতী হামলা

রাজধানীর আশকোনায় র‌্যাব নির্মাণাধীন কার্যালয়ে আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে গত ১৭ মার্চ। হামলায় র‌্যাবের দুই সদস্য আহত হন। প্রাণ যায় হামলাকারীরও। তার বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।

র‌্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান সে সময় জানান, আশকোনায় র‌্যাবের নির্মাণাধীন কার্যালয়ে একজন দেয়াল টপকে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। তখন গোসলে থাকা র‌্যাব সদস্যরা তাকে চ্যালেঞ্জ করলে ওই ব্যক্তি নিজের সঙ্গে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণকারী নিহত হয়। র‌্যাবের দুই সদস্যও আহত হন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

খিলগাঁও র‌্যাবের চেকপোস্টে হামলা

আশকোনায় র‌্যাব ক্যাম্পে আত্মঘাতী হামলার একদিন ১৮ মার্চ পরই ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে রাজধানীর খিলগাঁও নন্দীপাড়ার শেখের জায়গা নামক স্থানে র‌্যাবের চেকপোস্টে হামলার ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণে র‌্যাবের দুই সদস্য আহত হন। র‌্যাবের গুলিতে হামলাকারী নিহত হন। ওই সময় র‌্যাবের ডেপুটি কমান্ডিং অফিসার মেজর মারুফ হোসেন জানান, ভোরে সন্দেহভাজন এক মোটরসাইকেল আরোহীকে চেকপোস্ট এলাকায় থামার জন্য বলে র‌্যাব। এতে ওই ব্যক্তি র‌্যাব সদস্যদের দিকে এগিয়ে এসে ককটেল নিক্ষেপ করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

পরে ধাওয়া দিলে ওই ব্যক্তি র‌্যাব সদস্যদের গুলি করেন। র‌্যাবও পাল্টা গুলি চালালে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ঘটনাস্থল থেকে কয়েকটি ককটেল ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়।

বিমানবন্দর গোল চত্বরে আত্মঘাতী হামলা

আশকোনায় র‌্যাব ক্যাম্প ও খিলগাঁওয়ে র‌্যাব চেকপোস্টে আত্মঘাতী হামলার সাতদিনের ২৪ মার্চ মাথায় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে চেকপোস্টে আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় হামলাকারী। তার নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, লোকটি ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে ফুটপাত ধরে যাচ্ছিলেন। চেকপোস্টের কিছুটা দূরে থাকতেই লোকটির সঙ্গে থাকার বোমার বিস্ফোরণ ঘটে এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। লোকটি বোমা বহন করে কোথাও নেয়ার চেষ্টা করছিল। তার বয়স আনুমানিক ৩০/৩২।

আতিয়া মহলে সেনা কমান্ডোদেরঅপারেশন টোয়াইলাইট

বিমানবন্দরের চেকপোস্টে হামলার দিন দিবাগত রাত সাড়ে চারটার সময়ে সিলেটের শিববাড়িতে ‘আতিয়া মহলে’ জঙ্গি আস্তানা ঘিরে ফেলে পুলিশ। নিচতলার দুটি ফ্ল্যাটে জঙ্গি অবস্থান করছে নিশ্চিত হওয়ার পর পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে পুলিশ।

পাঁচতলা বাড়িটির প্রতিটি তলায় ছয়টি করে মোট ৩০টি ফ্ল্যাট। ঘটনার সময় ২৮টি ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা তাদের পরিবার নিয়ে বসবাস করছিল। জঙ্গিরা পুলিশের উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারে।

সিলেট পুলিশ জঙ্গিদের সক্ষমতা ও ২৮টি পরিবারের নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনা করে সোয়াটের সহায়তা কামনা করে। পরে ২৪ মার্চ বিকাল চারটার সময়ে ঘটনাস্থলে সোয়াট আসে।

তবে অবস্থা দেখার পর বাসিন্দাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনা করে সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়। এরপর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা অভিযান শুরু করে। পরে ৭৮ জনকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়। জঙ্গিদের বিস্ফোরণে ‘আতিয়া মহলে’ ভবনটি পুরো নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ২৮ মার্চ মঙ্গলবার বিকালে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ সমাপ্ত ঘোষণা করেন সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি আনোয়ারুল মোমেন।

জঙ্গি আস্তানায় প্যারা কমান্ডো দলের অভিযানের মধ্যেই ২৪ মার্চ রাতে ভবনের অদূরে দুটি বোমা বিস্ফোরণে দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হয়। আহত হন আইন-শৃঙ্লা বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকসহ অর্ধশত।

বিস্ফোরণে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ গুরুতর আহত হন। চিকিৎসার জন্য তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান তিনি।

মৌলভীবাজারেঅপারেশন হিট ব্যাক

সিলেটের আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শেষ হওয়ার ছয় ঘণ্টার মাথায় ২৮ মার্চ মঙ্গলবার গভীর রাতে পাশের জেলা মৌলভীবাজারে দুটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে। সেখানে অভিযান শুরু করে সোয়াট ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এর নাম রাখা হয় ‘অপারেশন হিট ব্যাক’।

যে দুটি বাড়িতে ঘিরে অভিযান চালানো হয়, তার একটি বাড়ি মৌলভীবাজার শহরের বড়হাট এলাকায়। অন্য বাড়িটির অবস্তান সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের নাসিরপুর গ্রামে।

দুই দিনের অভিযানে নারী ও শিশুসহ আটজন নিহত হয়। এর মধ্যে নাসিরপুর গ্রামে যে আস্তানাটি ছিল সেখানে বিস্ফোরণে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে তাদের শরীরে মাংস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে ঘর জুড়ে।

কুমিল্লায়অপারেশন স্ট্রাইক আউট

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার কোটবাড়ী এলাকার গন্ধমতী বড় কবরস্থানের পাশে সন্দেহভাজন ‘জঙ্গি আস্তানা’র খোঁজ পেয়ে ৩১ মার্চ অভিযান শুরু করে পুলিশ, র‌্যাব ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।

তিনতলা বাড়ির জঙ্গি আস্তানায় পাওয়া তিনটি ১০ কেজি ওজনের বোমা, ছয়টি হ্যান্ডগ্রেনেড ও দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট নিষ্ক্রিয় করে বোমা বিশেষজ্ঞ ইউনিট। জঙ্গিরা ১১টি বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে ওই আস্তানা থেকে কাউটে আটক করা যায়নি। অভিযান শুরুর আগেই পালিয়ে যায় সন্দেহভাজন জঙ্গিরা।

অপারেশন ‘সাউথ প’

২২ এপ্রিল সকালে ঝিনাইদহের সদর উপজেলার পোড়াহাটি গ্রামের ঠনঠনেপাড়ায় জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরু হরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ওইদিন সকাল সোয়া নয়টা  থেকে শুরু হওয়া অভিযান শেষ হয় দুপুর দুইটার সময়ে । অভিযানে ২০ ড্রাম বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক, একটি পিস্তল, পাঁচটি বোমা পাওয়া যায়।

ঝিনাইদহের মহেশপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান

৭ মে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বজরাপুর হঠাৎপাড়া গ্রামে জঙ্গি আস্তানায় ঘিরে রাখে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। অভিযান চলাকালে ‘আত্মঘাতী’ হামলায় দুই জঙ্গি নিহত হয়। অভিযানে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এডিসি এস এম নাজমুল ইসলাম, উপ-পরিদর্শক (এসআই) মহসিন আলী এবং মজিবুর রহমান আহত হন।

ওই বাড়ির মালিক জহুরুল ইসলাম, তার ছেলে জসিম উদ্দিন, ভাড়াটিয়া আলমগীর হোসেনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

‘অপারেশন সানডেভিল এবং ভয়ঙ্কর নারী জঙ্গি

১০ এপ্রিল গোদাগাড়ী উপজেলার বেনীপুরের একটি জঙ্গি আস্তানা খুঁজে পায় পুলিশ। দুই দিন ধরে অভিযান চলে সেখানে।  ফসলের মাঠের ভেতর একটি বাড়িতে আস্তানা গেড়ে থাকা একদল ‘জঙ্গি’কে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালেও রাজি হয়নি কেউ।

এক পর্যায়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে অভিযানে যাওয়া সদস্যদের ওপর। এই হামলার ভিডিও ছড়িয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। এতে দেখা গেছে, এক নারী ধারালো অস্ত্র হাতে কাউকে কোপাচ্ছেন। তার পাশে লুঙ্গি পরিহিত এক পুরুষে হাতে ছিল শাবল বা বল্লমজাতীয় অস্ত্র।

এ সময় নিহত হন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আবদুল মতিন। এর পর পরই সন্দেহভাজন জঙ্গি পরিবারের এক সদস্য ‘আত্মঘাতী’ বিস্ফোরণ ঘটায়, যাতে পাঁচ জন নিহত হয়।

এ সময় আরও একজন নারী মাঠে বসেছিলেন। পরে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তার নাম সুমাইয়া খাতুন। তার দুই সন্তানকেও পুলিশ জীবিত উদ্ধার করে।

ঝিনাইদহের চুয়াডাঙ্গা গ্রামে দুটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান

১৬ মে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার চুয়াডাঙ্গা গ্রামে দুইটি ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযান চালায় র‌্যাব। পরদিন সকালে ওই আস্তানা ঘেরাও করে দ্বিতীয় দিনের অভিযান শুরু করে র‌্যাব। অভিযানে ওই দুই আস্তানার পাঁচটি স্থান থেকে দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট, পাঁচটি শক্তিশালী বোমা, ১৮টি ডিনামাইট স্টিক, বোমা তৈরির ১৮৬টি পিভিসি সার্কিট, চার ড্রাম রাসায়নিক দ্রব্য ও একটি অ্যান্টিমাইন উদ্ধার করা হয়।

সেলিম হোসেন ও প্রান্ত বিশ্বাস নামে দুই জনকে ওই গ্রামের ওহাব বিশ্বাসের বাড়ির পাশ থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এই বাড়ি দুটিতে অভিযান চালানো হয়।

জাতীয় শোক দিবসে হামলার পরিকল্পনা নস্যাৎ

গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা ছিল নব্য জেএমবির। পুলিশের যৌথ টিমের অভিযানে (আগস্ট বাইট) সেই পরিকল্পনা নসাৎ করে দেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ওই ঘটনায় পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতী হয়ে মারা যান সাইফুল ইসলাম নিলয়।

এ ঘটনার পরদিন কলাবাগান থানায় একটি মামলা হয়। মামলায় নিলয়ের পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়। মামলার তদন্তকালে বের হয়ে আসে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থ সরবরাহকারীর নাম আকরাম হোসেন খান নিলয়। তিনি নব্য জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতা।

ওই আত্মঘাতী হামলার পেছনে অর্থ যোগানোর অভিযোগে গুলশান-১ এর ১২৭ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাসা থেকে একই পরিবারের তিনজনকে পরে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

আরও কিছু অভিযান

৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুরে মাজার রোডের পাশে বর্ধনবাড়ি ভাঙ্গা ওয়ালের গলির ২/৩-বি হোল্ডিংয়ে ছয় তলা বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। এর দুই দিন আগে টাঙ্গাইল থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকেই মিরপুরের আস্তানার তথ্য পাওয়া যায়।

৪৮ ঘণ্টার অভিযানে প্রায় ধ্বংকস্তুপে পরিণত হওয়া আস্তানার ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে সাতটি শক্তিশালী বোমা, ৩০টি ইমপ্রোভাইজড হ্যান্ড গ্র্যানেড, ২০টি রাসায়নিক বোমা, নয়টি বোমার ধাতব খোল ও ১৫ কেজি স্পিøন্টারসহ বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

৮ অক্টোবর যশোরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে একটি চারতলা বাড়ি ঘিরে রাখে পুলিশ। সেখানে অবস্থানকারী এক নারী তার দুই সন্তানসহ আত্মসমর্পণ করেন। আর সেখান থেকে তিনটি সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার করে পুলিশ।

২৩ অক্টোবর যশোরের পাগলাদহ মালোপাড়া এলাকায় একটি বাড়িতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দুই ঘণ্টার অভিযান শেষে বাড়িটি থেকে উদ্ধার করা হয় ৫০টি গ্রেনেডের বডি, সুইচ ৫০টি, ৩১টি ব্রেকার, পাঁচ লিটার এসিডসহ বিস্ফোরক দ্রব্য। আটক করা হয় নব্য জেএমবির ‘আঞ্চলিক কমান্ডার’ বাড়ির মালিক মোজাফফর হোসেনকে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের প্রশংসা

গত এক বছর ধরে চলা এসব জঙ্গিবিরোধী অভিযানের বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি এসব ঘটনাকে অবশ্যই পজিটিভলি দেখি। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির হামলার পরে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা একের পর এক জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে তাদেরকে নির্মূল করেছে। এসব অভিযানের কারণে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে জনজীবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ফিরছে।’

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে তথ্য থাকায় একের পর এক জঙ্গি আস্তনায় অভিযান চালিয়েছে জঙ্গিদের নির্মূল করেছে। এটা অবশ্যই ভালো। তবে জঙ্গিবাদ উত্থানের কিছু কারণ রয়েছে সেগুলো বন্ধ না হলে জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নির্মূল হবে না। তবে জঙ্গিবাদ একটি বৈশি^ক সমস্যা।’

(ঢাকাটাইমস/৩০ডিসেম্বর/এএ/ডব্লিউবি)