‘বিপর্যয় নয়, সত্যের কাছাকাছি ফল’

মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০১৮, ২০:৩৩ | প্রকাশিত : ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:২৫

অষ্টম শ্রেণি সমাপনীতে পাসের হার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ কমে যাওয়ায় আলোচনা তৈরি হলেও একজন শিক্ষাবিদ মনে করেন, এটা যৌক্তিক ও প্রকৃত ফলাফলের কাছাকাছি। খাতা দেখায় যথেষ্ট কড়াকড়ি হলে বরং আরও কমতে পারত পাসের হার।

চলতি বছর প্রাথমিক সমাপনীতে আগের বছরের চেয়ে কম পাস নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি, কারণ এই পার্থক্যটা খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি সাময়িকীর ফলাফল আলোচনা চলছে দুই দিন ধরে। বিশেষ করে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে পাসের সংখ্যা ২৭ শতাংশ কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন বোর্ড কর্মকর্তা থেকে শুরু করে খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান মনে করেন ফলাফলে কোনো বিপর্যয় হয়নি। এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘আমি মনে করি গত পাঁচ বা ছয় বছরে হাইব্রিড ফল প্রকাশ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার চেয়ে বেশি নম্বর দেওয়া হয়েছিল। তাই তাদের জিপিএ প্রাপ্তির হার বেড়েছিল। পাসের হার বেড়েছিল।’

২০১৬ সাল থেকেই এইচএসসি এসএসসি, জেডিসি পরীক্ষার ফল আগের বছরের চেয়ে খারাপ হতে শুরু করে। এর আগের পাঁচ বছর বলতে গেলে উত্তরোত্তর পাসের হার বেড়েছিল। এই হঠাৎ করে যাওয়ার কারণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। দুই জনই জানিয়েছেন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি পাল্টানোয় এই ঘটনা ঘটছে।

শিক্ষামন্ত্রী শনিবার স্কুল পর্যায়ের জেএসসি এবং মাদ্রাসা পর্যায়ের জেডিসি পরীক্ষার ফল ঘোষণার পরও একই কারণ উল্লেখ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। জানান, উত্তরপত্র মূল্যায়নে নতুন পদ্ধতি চালু এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করার প্রেক্ষিতে এই ফল হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রী স্কুলে নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে বলেছেন, ঠিকমতো পড়ালেখা হচ্ছে কি না, সেটি দেখতে হবে।

শিক্ষামন্ত্রী উত্তরপত্র মূল্যায়নে নতুন পদ্ধতির কথা বললেও এর বিস্তারিত জানাননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জিপিএ পদ্ধতি চালুর পর উদারভাবে নম্বর দেয়ার নির্দেশনা ছিল। এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ছিল। তারা অতিরিক্ত উদার হয়ে নম্বর দিতেন। তবে গত দুই বছর ধরে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে হাতেকলমে দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে কোন উত্তরে কত নম্বর দেয়া যৌ্ক্তিক।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি বাড়াতে, তাদের ঝরে পড়া কমাতে শুরুতে মন্ত্রণালয় উদারভাবে খাতা মুল্যায়ন করার সুযোগ করে দিয়েছে। এতে পড়ালেখার প্রতি অভিভাবক ও শিশুদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এখন সময় এসেছে মানের দিকে জোর দেয়ার।’

‘শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে শুরুতে সংখ্যাগত দিকে নজর দিতে হয়েছে শিশু ও অভিভাবকদের উৎসাহী করতে হয়েছে। এ ছাড়া উপায়ও ছিল না’-বলেন ওই কর্মকর্তা।

একজন শিক্ষক বলেন, এর আগে কোনো শিক্ষার্থী ৭৫ পাওয়ার মতো হলো আমরা কিছুটা নম্বর বাড়িয়ে তাকে ৮০ করে দিতাম এমনকি কেউ ৩০ পাওয়ার মতো হলে তাকে ৩৫ করে পাস করিয়ে দিতাম। কিন্তু এখন থেকে এটা আর করা হবে না। এই বার্তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমরা পৌঁছে দিচ্ছি, ফলে তারা পড়াশোনায় আরও মনযোগী হবে।

শিক্ষাবিদ সিদ্দিকুর রহমান মনে করেন, ‘শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রশ্নপদ্ধতি প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করা উচিত।’

এই শিক্ষাবিদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরে যে ফলাফল প্রকাশ হয়েছে তা নিয়ে বিতর্কের কারণ এই উদার মনোভাব। তিনি মনে করেন, ভবিষ্যতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন আরও কঠোর হবে।

সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘এ বছরও যথাযথভাবে খাতা মূল্যায়ন হয়েছে বলে আমি মনে করি না। তবে আমি মনে করি, এবারের ফল সত্যের কাছাকাছি গেছে।’

চলতি বছর এইচএসসির পর এসএসসি এবং সবশেষ জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার ফলাফলে এটা স্পষ্ট যে দেশে ইংরেজি ও গণিত শিক্ষায় দুর্বলতা রয়েছে। এই দুটি বিষয়ে দুর্বলতা নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত শিক্ষাবিদরা। কারণ, সরকার যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় জোর দিতে চাইছে সেখানে এই দুটি বিষয়ে দুর্বলতা শিক্ষার্থীদেরকে পিছিয়ে দেবে। এ বিষয়ে সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে তৎপর হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তারা।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে প্রচারে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। তার প্রভাবও ফলাফলে পড়েছে।

প্রশ্ন ফাঁস কীভাবে খারাপ ফলাফলের কারণ, সেটি ব্যাখ্যা করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘শিক্ষার্থী যখন শুনে যে তার পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে তখন তার প্রস্তুতিতে বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন ‍কুমার সরকার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আসলে সামগ্রিক পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে জেএসসি-জেডিসি ও সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলে। এবছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলও তুলনামূলকভাবে খারাপ হয়েছে। এসব হয়েছে পরিবর্তনের ফলে। উত্তরপত্র মূল্যায়নে পরিবর্তন এসেছে।’

‘পরীক্ষা অনেক সময় অনেক বিষয় কঠিন হয়। তারও প্রভাব আছে। এখন শিক্ষকরা খাতা মূল্যায়নে বেশ সতর্ক। এসব কারণেই ধারাবাহিক প্রভাব পড়ছে ফলগুলোতে।’

এবার অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় এবার পাস করেছে ৮৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী; এক লাখ ৯১ হাজার ৬২৮ জন পেয়েছে জিপিএ ফাইভ। গত বছর জেএসসি-জেডিসিতে সম্মিলিতভাবে ৯৩ দশমিক ০৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করে।

জেএসসি-জেডিসিতে এবার মোট এক লাখ ৯১ হাজার ৬২৮ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ফাইভ পেয়েছে । গত বছর পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পাওয়ার সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৪৭ হাজার ৫৫৮ জন।

আর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ৯৫.১৮ শতাংশ ও ইবতেদায়ীতে ৯২.৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে এ বছর। গত বছর প্রাথমিক সমাপনীতে ৯৮.৫১ শতাংশ ও ইবতেদায়ীতে ৯৫.৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল।

চলতি বছর প্রাথমিকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে দুই লাখ ৬২ হাজার ৬০৯ জন, আর ইবতেদায়ীতে ৫ হাজার ২৩ জন পূর্ণ জিপিএ পেয়েছে। গত বছর এই সংখ্যাটা ছিল যথাক্রমে ২ লাখ ৮১ হাজার ৮৯৮ জন এবং ৫ হাজার ৯৪৮ জন।

(ঢাকাটাইমস/৩১ডিসেম্বর/এমএম/ডব্লিউবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :