ব্যাংকের মহাজন কারা: পর্ব-২

ব্যাংক খাতে আলোচিত যতো জালিয়াতি

তায়েব মিল্লাত হোসেন
| আপডেট : ০২ মার্চ ২০১৮, ০৮:২৮ | প্রকাশিত : ০২ মার্চ ২০১৮, ০৮:২০

তারা যেন চিরঋণী। হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন নানা কৌশলে। তা দেওয়ার নাম নেই। এ নিয়ে অস্থিরতা ব্যাংক খাতে। এই খাতে সুশাসনের পথ আসলে কী? লিখেছেন তায়েব মিল্লাত হোসেন

উধাও টিপু সুলতান

এক সময় ছোট পরিসরে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা করতেন বগুড়ার টিপু সুলতান। ঢাকা ট্রেডিং হাউজের নামে সীমিত পরিসরে পণ্য আমদানি করতেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে অপ্রত্যাশিত উত্থান হয় তার। প্রায় এক ডজন ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিবহন ব্যবসায় নামেন। এ ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন টিআর ট্রাভেলসের এসি-ননএসি বাসগুলো চলাচল করত ঢাকা থেকে বগুড়া, রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুটে। কিন্তু সেসবই এখন দূর অতীত। পরিবহন ব্যবসায় গিয়ে অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা। এখন প্রায় বন্ধ টিআর ট্রাভেলসের চলাচলও। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী সব বাসের চলাচলই বন্ধ রয়েছে। ধুলো জমেছে টিআর ট্রাভেলসের কাউন্টারগুলোর দরজায়। বাছবিচার না করে জামানত ছাড়াই টিপু সুলতানকে ঋণ দেওয়া ব্যাংকগুলো ঘুরছে আদালতপাড়ায়। জনতা ব্যাংকের ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ২০১৬ সালের মার্চে দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন টিপু সুলতান। এরপর জামিন পেয়ে লাপাত্তা।

ঋণ তাদের হাজার কোটির!

বড় অঙ্কের দায়-দেনাসহ বাবার রেখে যাওয়া ইব্রাহিম কটনমিল বছর দশেক আগে বিক্রি করে দেন মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম। এরপর গড়ে তোলেন ক্রিস্টাল গ্রæপ নামে নতুন প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে একের পর এক ঋণ নিতে থাকেন। ঋণের অর্থ আর ফেরত না দিলেও মালিক হয়েছেন ব্যাংকের। ফারমার্স ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক চট্টগ্রামের এ ব্যবসায়ী। ভাইয়ের স্ত্রীকে বানিয়েছেন এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের উদ্যোক্তা। শুধু ব্যাংক নয়, বীমা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম পরিবারের মালিকানায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম ও তার পরিবারের কাছে দেশের আট ব্যাংক ও চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে যা খেলাপি হয়ে পড়েছে। মামলা করেও অর্থ আদায়ের সম্ভাবনা দেখছে না অধিকাংশ ব্যাংক। ঋণ প্রদানকারী বিভিন্ন ব্যাংকের পর অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে এ ব্যবসায়ী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)।

ঋণের পর বন্ধ কারখানা

দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়া অন্তত ৩ হাজার তৈরি পোশাক কারখানা এখন বন্ধ। এর বেশির ভাগ গার্মেন্টের কোনো অস্তিত্বই নেই। উধাও হয়ে গেছে। সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ না দিয়ে কয়েক শ উদ্যোক্তা সটকে পড়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বাধ্য হয়ে ইতিমধ্যে ৭ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করতে হয়েছে। বাকি টাকার ভবিষ্যৎও একই পথে এগোচ্ছে। এর ফলে বিপাকে পড়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের কম-বেশি সব কটি ব্যাংক। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তালিকায় ৩৫টি ব্যাংক।

একজনের জন্য উদার ছিল জনতা ব্যাংক

একজন উদ্যোক্তাকে উদারভাবে ঋণ বিতরণ করেছে জনতা ব্যাংক। তাকে ৬ বছরে তারা দিয়েছে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা। নিয়মনীতি না মেনে এভাবে ঋণ দেওয়ায় বিপদে ব্যাংক, গ্রাহকও ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। জনতা ব্যাংকের মোট মূলধন ২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার সুযোগ আছে। অর্থাৎ এক গ্রাহক ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পেতে পারেন না। দেওয়া হয়েছে মোট মূলধনের প্রায় দ্বিগুণ। ব্যাংক দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের, সরকারের নিয়োগ দেওয়া সেই পরিচালনা পর্ষদই এই বিপজ্জনক কাজটি করেছে।

বন্দি শুধু বেসিকের ব্যাংকাররা

বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারির সময়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা সব নিরাপদে আছেন। আর দুদক যেসব ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে, তারা সবাই জামিনে। আদালত থেকে জামিন পেয়ে তাদের কেউ দেশে আছেন, কেউবা জামিন পাওয়ার দিনই পালিয়ে চলে গেছেন বিদেশে। আর পর্ষদের হুকুম তামিল করা ব্যাংকাররা সবাই জেলে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের অন্যতম প্রধান এই আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় যাঁর প্রধান দায় রয়েছে বলে অভিযোগ আছে, সেই আবদুল হাই বাচ্চু রয়েছেন বহালতবিয়তে। সর্বশেষ গত ৮ জানুয়ারি দুদক তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

যত কাণ্ডে বেসিক ব্যাংকে

২০০৯: ৬ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। ২০১০: ভবন কেনার নামে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু। ২০১১: অস্তিত্বহীন কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া শুরু। ২০১২: এপ্রিল থেকে মাত্র ৯ মাসেই অনিয়মের ৩,৪৯৩ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন। ২০১২: ৫ সেপ্টেম্বর চেয়ারম্যান হিসেবে পুনর্নিয়োগ। ২০১২: ৬ সেপ্টেম্বর অনিয়মের জন্য এমডিকে ডেকে সতর্ক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৩: ১৭ জুলাই ব্যাংকটির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমঝোতা চুক্তি। ২০১৩: ১৮ আগস্ট চেয়ারম্যান-এমডিদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বৈঠক, আবদুল হাই অনুপস্থিত। ২০১৩: ২৭ নভেম্বর ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষক নিয়োগ। ২০১৪: ২৫ মে এমডি ফখরুল ইসলামকে অপসারণ। ২০১৪: ২৮ মে পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে গভর্নরের চিঠি। ২০১৪: ৪ জুলাই আবদুল হাইয়ের পদত্যাগ। ২০১৫: সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন থানায় ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা। ২০১৬: জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৬ জন গ্রেপ্তার। ২০১৭: ২৬ জুলাই পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নিয়ে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্তের নির্দেশ আদালতের। ২০১৭: ৪ ও ৬ ডিসেম্বর দুদকে আবদুল হাইয়ের শুনানি, পর্ষদের অন্যদেরও শুনানি। ২০১৮: ৮ জানুয়ারি আবদুল হাইয়ের তৃতীয় দফা শুনানি।

এখনো হলমার্ক কেলেঙ্কারির জের টানছে সোনালী ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সোনালী ব্যাংক। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের হিসাব থেকে অন্য ব্যাংকের পাওনা হিসেবে পরিশোধ করা টাকা ফিরিয়ে আনতে এ মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। মামলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি, গ্রাহক ও অন্য ব্যাংকগুলোকে আসামি করা হবে বলে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনাটি ঘটেছে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখায়। সোনালী ব্যাংকের হিসাব থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংককে ১০ কোটি ৮৮ লাখ ডলার (৮৯২ কোটি টাকা) পরিশোধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের স্বীকৃত বিলের বিপরীতে নন-ফান্ডেড দায় তৈরি হওয়ায় অন্য ব্যাংকগুলোকে এসব অর্থ পরিশোধ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত সোনালী ব্যাংকের হিসাব থেকেই এ টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু সোনালী ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত বেআইনি। গত ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, অর্থ ফেরাতে মামলা করা হবে। তাতে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থের সুবিধাভোগী ব্যাংক ও গ্রাহক, সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও হলমার্ক গ্রæপের মালিকদের আসামি করা হবে। উল্লেখ্য, সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে ২০১০-১২ সময়ের মধ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে হলমার্ক গ্রæপই হাতিয়ে নিয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি।

১২০০ কোটি টাকার মামলায় বিসমিল্লাহ গ্রুপ

বিসমিল্লাহ গ্রুপ নিয়ে প্রাইম ব্যাংক এখন আর চিন্তিত নয়। ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতনরা এই কথাই বলে থাকেন। অথচ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রাইম ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি করে উধাও হয় বিসমিল্লাহ গ্রুপ। প্রাইম ব্যাংক মতিঝিল শাখা থেকে ৩২৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা সরানো হয়। ব্যাংকের ১২০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে বিসমিল্লাহ গ্রুপের বিরুদ্ধে রাজধানীর তিনটি থানায় মামলা হয় মোট ১২টি। দীর্ঘ তদন্ত শেষে দুদক এই মামলাগুলো দায়ের করে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর।

তাঁরা যা বলেন

ব্যাংক খাতের অস্থিরতার বিষয়টি প্রায়ই স্বীকার করছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সম্প্রতি তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ব্যাংক খাতে অনেক দোষ-ত্রুটি হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে যে মাত্রায় লুটপাট হয়েছে তাকে পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি বলা যায়।’

একই প্রসঙ্গে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানের ভাষ্য হচ্ছে, ‘ব্যাংকিং খাত নিয়ে যথেষ্ট অস্বস্তি রয়েছে। এ খাত নিয়ে অনেক জবাবদিহি করতে হয়। বিশেষ করে নির্বাচনি এলাকায়। বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় সরকারি ব্যাংকের সেবা অনেক দুর্বল। সরকার যা দিচ্ছে তার অনুপাতে ফেরত পাচ্ছে কম। ব্যাংকারদের ন্যায়কে ন্যায় এবং অন্যায়কে অন্যায় বলতে হবে।’

ব্যাংক খাতে অস্থিরতা থাকলে তা পুঁজিবাজারের মতো নাজুক অবস্থা তৈরি করতে পারে। এই ইঙ্গিত করে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেছেন, ‘একটি বেসরকারি ব্যাংক (ফারমার্স ব্যাংক) খারাপ অবস্থায় পড়েছে। পুঁজিবাজারে ভীতি ছিল। এখন সেটা ব্যাংকিং খাতেও চলে আসছে। একটি ব্যাংকের কারণে এমনটি করা ঠিক হবে না।’

একই প্রতিষ্ঠানকে একই ব্যাংক থেকে অনেক বেশি ঋণ দেয়ার মধ্যে যে অনিয়ম থেকে যায়, সেই প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘আইনে আছে, মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি এক গ্রুপকে ঋণ দেওয়া যাবে না। এর বেশি ঋণ গেলে ব্যাংকের জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে যায়।’

ব্যাংক খাতের জালিয়াতির মূল হোতাদের বিচার কঠিন এক বিষয় হয়ে পড়েছে। সেই ইঙ্গিত দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলছেন, ‘দৃশ্যত সমাজের যে তিন অংশ বেসিক ব্যাংকে কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছে, তাদের মধ্যে যদি পর্ষদ সদস্যরা নিরাপদে থাকেন, গ্রাহক ব্যবসায়ীরা বিদেশে সেকেন্ড হোম করে থাকেন আর ব্যাংকাররা জেলে থাকেন, ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাবের যে কথা আমরা বলে থাকি, এর চেয়ে ক্ল্যাসিক উদাহরণ আর হতে পারে না’ [শেষ]

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :